যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেয় কে?

শিক্ষক-শিক্ষার্থী প্রেম ও যৌনতা নিষিদ্ধ করছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগ এবং ঐ সব পদে অধিষ্ঠিতদের আচরণ বিষয়ে একাধিক সময়ে আমি সংবাদপত্রে লিখেছি।

শাহ্‌জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আমার বক্তব্যেও আমি উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া বিষয়ে আমার অবস্থান বলেছি।

এইবার এবং আগেও যখন আমি এই বিষয়ে মত প্রকাশ করেছি তখন অনেকেই জানতে চেয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান – প্রেসিডেন্ট – কে নিয়োগ দেয়, কীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। এই প্রশ্ন অনেকের, সে কারণে তাঁদের আলাদা করে উত্তর দেয়ার পরিবর্তে আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতার আলোকে এই প্রক্রিয়াটি সংক্ষেপে তুলে ধরার তাগিদ অনুভব করলাম।

২০০২ সালে ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেবার পর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ধরণের কমিটিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তদুপরি আমি রাজনীতি ও সরকারের বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দশ বছর (২০০৭-২০১৭) দায়িত্ব পালন করেছি। সেই সুবাদে এখানকার প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে কাছে থেকে দেখতে পেরেছি।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটিগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, এগুলো স্বায়ত্ত্বশাসিত। এগুলোর পরিচালনার পদ্ধতি প্রায় একই ধরণের, একেবারে একই রকমের না হলেও। এর সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কাঠামো হচ্ছে বোর্ড অব ট্রাস্টি/ বোর্ড অব রিজেন্ট।

ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য আটজন। এদের মধ্যে সাত জনকে গভর্নর মনোনয়ন দেন। তাঁদের কনফারমেশন হয় রাজ্যের সিনেটে। তাঁদের মেয়াদ ছয় বছর। এরা কেউ রাজনৈতিক দলের সদস্য নন।

স্থানীয় ব্যবসায়ী, আইনজীবী, বিভিন্ন পেশাজীবি এবং সমাজকর্মীদের মধ্যে থেকে এদের বেছে নেয়া হয়। বোর্ডে একজন শিক্ষার্থী সদস্য থাকেন – তিনি সরাসরি শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত হন, তাঁর মেয়াদ এক বছর।

প্রেসিডেন্ট পদ শুন্য হবে বা হলে ট্রাস্টি বোর্ড একটি হায়ারিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে যে তাঁরা এই পদের বিজ্ঞাপন দেয়া, প্রাথমিক বাছাই করা, সম্ভাব্য প্রার্থীদের কাছে পৌছানো এবং প্রার্থীদের আনা-নেয়া ইত্যাদি কাজ করে। সহজ ভাষায় এদের কাজ লজিস্টিকাল সাপোর্ট দেয়া।

প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থীদের যাচাই-বাছাই করার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সার্চ কমিটি তৈরি করা হয় যাতে শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে জানানো হয় তাঁরা এই কমিটিতে অংশ নিতে আগ্রহী কীনা।

তাঁদের সেই আগ্রহের ভিত্তিতে এবং ক্ষেত্র বিশেষে নির্বাচিতদের মধ্য থেকে একটি বড় আকারের সার্চ কমিটি তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে সকলের প্রতিনিধি আছে। ফলে এতে সকলের মত প্রতিফলিত হয়।

ইতিমধ্যে ঐ হায়ারিং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া তালিকা থেকে এই কমিটি একটি ছোট আকারে তালিকা করে – সাধারানত পাঁচ/সাত জনের। তাঁদেরকে শহরের নিকটস্থ এয়ারপোর্টে আনা হয় এবং সেখানে তাঁর ইন্টারভিউ করেন প্রশাসনের দুই একজন, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের কয়েক জন, এবং সার্চ কমিটির কয়েক জন। একে বলে এয়ারপোর্ট ইন্টারভিউ।

তাঁদের এই ইন্টারভিউয়ের রিপোর্টের ভিত্তিতে বড় কমিটি কমপক্ষে তিনজন প্রার্থীকে ক্যাম্পাসে আমন্ত্রণ জানান। এই সময় এই তিনজনের নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলকে জানানো হয়। তাঁদের সিভি সকলের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

এই প্রার্থীরা ক্যাম্পাসে এসে কমপক্ষে দুটি পাবলিক অনুষ্ঠানে তাঁদের ভিশন, কেনো তিনি এই চাকুরি চাইছেন, তাঁর যোগ্যতা কী, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি ও দুর্বলতা কী সেই বিষয়ে বলেন এবং সকলের প্রশ্নের উত্তর দেন। এতে শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। এর একটি এমনকি স্থানীয় জনসাধারণের জন্যেও উন্মুক্ত থাকে।

এই সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত এবং যারা কেবল মাত্র সিভি দেখেছেন তাঁরা সকলে নির্ধারিত ফর্মে তাঁদের মন্তব্য এবং রেটিং দেন। সেগুলো পাঠানো হয় কমিটির কাছে। প্রার্থী এর বাইরে ট্রাস্টি বোর্ড প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং ডিনদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

বর্তমান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেন। সার্চ কমিটির একটি ছোট সাব কমিটি তাঁকে ইন্টারভিউ করে।

এই সব বৈঠক, প্রেজেন্টেশনের প্রেক্ষিতে সকলের কাছ থেকে প্রাপ্ত মন্তব্যের ভিত্তিতে সার্চ কমিটি তাঁদের সোপারিশ পাঠান বোর্ড অব ট্রাস্টির কাছে। তাঁরা এই সব বিবেচনা করে একজনকে এই পদের জন্যে নির্বাচন করেন।

বেতন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনায় ঐকমত্য হলে ঐ প্রার্থীকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছরের, তবে যে কোনও ধরণের বিচ্যুতির জন্যে ট্রাস্টি বোর্ড তাঁকে যে কোনও সময়ে পদচ্যুত করতে পারে।

উল্লেখ করা দরকার যে, প্রতি বছর তাঁর কাজের মুল্যায়ন হয়। এই মুল্যায়ন হয় লিখিত, তাতে অংশ নেন শিক্ষক-কর্মচারী-শিক্ষার্থীরা। এই মূল্যায়নের দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের। এই প্রতিবেদনের সার অংশ সকলকে জানানো হয়। ট্রাস্টি বোর্ড বিস্তারিত রিপোর্ট পায়।

এর বাইরে চতুর্থ বছরে আরও বড় আকারের প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্টের কাজের মূল্যায়ন করা হয়।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ভারের একটা অংশ আসে রাজ্যের বাজেট থেকে, তার মানে আসে জনগণের করের অর্থ থেকে। বাকীটা বিশ্ববিদ্যালয় যোগাড় করে শিক্ষার্থীদের টিউশন, গবেষনা প্রকল্প এবং অন্যান্য খাত থেকে।

প্রেসিডেন্টের একটা কাজ হচ্ছে রাজ্যের আইন প্রণয়নকারীদের বোঝানো কেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই খাতে এই টাকা দরকার। সেজন্যে তাঁকে কমপক্ষে বছরে একবার আইন প্রণেতাদের সামনে গিয়ে জবাবদিহি করতে হয়।

আলী রিয়াজ
আলী রিয়াজ। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সব ধরণের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকা, প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, সকলের অংশগ্রহণ এবং যোগ্যতা বিচারের বিভিন্ন ধরণের মাপকাঠির ব্যবহার।

নিযুক্ত হবার পর প্রেসিডেন্টকে জবাবদিহির একাধিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে হয়। উল্লেখ করা দরকার যে, এটি যে কেবল প্রেসিডেন্টের জন্যে কার্যকর তা নয়, যে কোন ধরণের প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োগের প্রক্রিয়া এবং দায়িত্ব পালনকালে জবাবদিহির ব্যবস্থাও প্রায় একই ধরণের।