অধ্যাপক ফায়েক উজ্জামানের ১০ বছর ও খুবি’র বাস্তবতা

২০১৭ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে (প্রকৃতপক্ষে ৩য় মেয়াদে, ২০১২ সাল থেকে উনি ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ছিলেন) উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ফায়েক উজ্জামানের একটা সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম আমি। সেই সাক্ষাতকারটি একটি জাতীয় দৈনিকে বেশ বড় করে প্রকাশ করা হয়েছিলো।

প্রথমবার দায়ীত্ব পালনকালে বেশ দক্ষতার সাথে অপেক্ষাকৃত কম সমালোচনা নিয়ে প্রসাশনিক দায়ীত্ব পালন করায় আমি তাকে উপাচার্য হিসেবে তার বেশ প্রশংসা করেছিলাম, এবং জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘উনিই খুবি’র সবচেয়ে সফল উপাচার্য কিনা’।

জবাবে, প্রফেসর ফায়েক বলেছিলেন, আমি সফল কিনা তা বুঝা যাবে নতুন প্রাপ্ত মেয়াদ শেষেও একই ধরনের ইমেজ আমি ধরে রাখতে পারি কিনা কেবল তার উপরই।

প্রফেসর ফায়েক এর মেয়াদ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। বলা যায় এটাই তার শেষ সপ্তাহ। তার প্রোভিসি ও প্রথম মেয়াদে ভিসি থাকাকালীন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম এবং তাকে সামনে থেকে দেখেছি। দ্বিতীয় মেয়াদে তাকে পুনঃমনোনিত করার পর পত্রিকা মারফতে উনাকে দেখেছি ও জেনেছি।

২য় মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাবার একের পর এক অভিযোগে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন অন্য এক নিম্নতায়!

বিশ্ববিদ্যালয়ে গত চার বছরে অজস্র নিয়োগ হয়েছে তার হাত ধরে। যার বেশীর ভাগই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তিনি সফলভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছাত্র নেতাদের পুনর্বাসন করেছেন এখানে, শিক্ষক থেকে কর্মকর্তা প্রায় সকল পজিশনেই তাদের আনাগোনা আজ।

অধিক রাবি’প্রীতি তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে খুবি গ্রেজুয়েট টিচারদের থেকে। ফলে বারবার বিভিন্ন অভিযোগে যখন তার দিকে আঙ্গুল তোলা হয়েছে তিনি ‘তার নিয়োগ’ দেয়া শিক্ষকদের পাশে চেয়েছেন, পেয়েছেনও!

এর ফলে তৈরী হয়েছে বিশাল অন্তকোন্দলের। ‘স্বাধীনতার পক্ষে’র শিক্ষকরা চার ভাগে বিভক্ত। এদিকে বিপক্ষ দলের তো অস্তিত্বই নেই। আর সেইখান থেকেই মূলত শুরু আজকের এই পচনের।

গত চারটি বছরের জন্য খুবি’কে ভুগতে হবে অনেকদিন। কোন কোন শিক্ষক নিজের ক্ষমতার প্রয়োজনে ছাত্রদের ব্যাবহার করতে চেয়েছেন। কেউ চেয়েছেন রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যাবহার করতে। কেউ চেয়েছেন ‘ ছাত্র রাজনীতি আসুক’। কেউ আবার ‘একটা প্রমোশন হলেই চলবে’ বলে পাশে থেকেছেন!

আজকে আমরা দেখি, উনার শেষ সপ্তাহটাতে কি ভয়াবহ রকমের একটা
অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

কয়েকজন ছাত্রকে বহিষ্কার করে দেয়া হলো, তাও সম্পূর্ন অন্যায় ভাবে। কয়েকজন শিক্ষকও সেই তালিকাতে আছেন। যারা সংহতি জানিয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে।

স্যার এইসব যে ব্যাক্তিগত আক্রোশ থেকে করছেন তা আমি বিশ্বাস করিনা। আমার বিশ্বাস এতে কারো ইন্দন আছে। যদিও শেষমেশ তার পক্ষে আমরা কাউকে দেখতে পাইনা।

ফলে অনেকটা ভয় পেয়েই ‘ছাত্ররাজনীতিবিহীন’ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফায়সালা’ করতে আনা হয় ‘রাজনৈতিক’ ব্যাক্তিত্বকে। প্রফেসর ফায়েক ভেবেছিলেন, পরিচ্ছিন্ন ইমেজের রাজনীতিক ব্যাক্তিত্ব এবং এ শহরের মেয়র খালেক সাহেবকে আনলেই ছাত্ররা আন্দোলন তুলে নিবেন।

কিন্তু উনি আবারো ভুল করলেই। উনি এখনো বুঝেননি, খুবি’র শিক্ষার্থীরা এই একশ পাঁচ একরের ক্যাম্পাসে কোন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বকে তার পরিচয় দিয়ে ‘লভ্যাংশ’ আদায়ের সুযোগ দেন নাই কখনো!

‘ভয়’ শব্দটা উল্লেখ করলাম তার পিছনেও একটা কারণ আছে। আমরা ছাত্রাবস্থায় থাকালীন গল্লামারি পুলিশ ফাঁড়িতে ‘ছাত্র-পুলিশ’ সংঘর্ষের জের ধরে বেশ অস্থিতিশীল হয়েছিলো ক্যাম্পাস।

আন্দোলন চলাকালীন খুলনার পুলিশ সুপার যখন গাড়ি নিয়ে আসেন তাকে আমরা গাড়ি চালিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দিইনা। স্যার এসে আমাদের জোরাজুরি করেন।বলেন, উনি আমাদের গেস্ট!

আমরা খুলনা-সাতক্ষীরা রাস্তা অবরোধ করে রেখেছিলাম এবং মব বিস্তৃত ছিলো প্রায় গল্লামারি স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত। স্যারকে বললাম, আপনি একজন ভিসি, একজন পুলিশ সুপারকে এগিয়ে নিতে আপনার এতোদূর আসা লাগেনা।

আপনার মর্যাদাটা আপনি বুঝেন! স্যারকে দেখলাম উত্তর না দিয়ে পুলিশকে এগিয়ে নিয়ে চলে গেলেন।

উনি এমনই ছিলেন। হতে পারে উনার বদান্যতা কিংবা ভয়!

যাইহোক, এই আন্দোলনে মধ্যস্ততা করার জন্য ফায়েক উজ্জামান রাজনৈতিক ব্যাক্তিদের না ডেকে যদি এলামনাইকে ডাকতেন অথবা বর্তমান ছাত্রদেরকেও ডাকতেন তাহলেও উনার উপর হারানো আস্থা ফিরে আসতো শিক্ষার্থীদের।

তবে রাজনৈতিক পরিচয়ে দশ বছর খুবি প্রশাসনের প্রধান থাকা প্রফেসর ফায়েক উজ্জামান বেশ কিছু ক্ষতি করে গেছেন।

– ‘শিক্ষকদের গাড়িতে হামলা’ দেখিয়ে করা অভিযোগে ছাত্রদের বহিষ্কার ‘ছাত্র-শিক্ষক’ সম্পর্ককে আরো অবনতি করবে। ছাত্ররা বিশ্বাসের জায়গা হারাবে। শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হবে।

– ‘আন্দোলন দমাতে রাজনীতিক পরিচয়’ ব্যাবহার ও মেয়রকে অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ সামনের দিনগুলোতে খুবি’র অভ্যন্তরীন বিষয়ে লোকাল রাজনীতির প্রভাবের পথকে আরো সুগম করবে।

– যেকোন ন্যায্য আন্দোলনের শিক্ষকদের সংহতি পাওয়া যাবে না। সংহতি প্রকাশ করলে চাকরি চলে যাবার ভয় থাকবে।

– মধ্যস্থতাকারী হিসেবে এলামনাইকে না ডেকে অন্য উপায়ে সমাধানের চেষ্টা এলামনাই এর উপর বর্তমান শিক্ষার্থীদের আস্থার সংকট তৈরী করবে।

এর ফলে আগামী সকল আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ‘রাজনৈতিক’ প্রভাবকে বেশি ফলপ্রসূ মনে করবে।

প্রাক্তন একজন শিক্ষার্থী হিসেবে উপরোক্ত ব্যাপারগুলো আমাকে ভাবায় এবং কষ্ট দেয়। দিনের পর দিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত রাখার পিছনে সবচে বড় অবদান খুবি’র শিক্ষার্থীদের।

আর এই পরিচয়ে দেশের অনন্য এক উদাহরণ হয়ে উঠেছে গত তিন দশক ধরে। যার মধ্যে ‘চির ধরানোর বীজ’ বপণ করে গেলেন প্রায় বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক ফায়েক উজ্জামান। আমি তাকে ব্যার্থ বলতে চাই!

আহমেদ সাইফ মুনতাসির, ১১ ব্যাচ, ইসিই