বাৎসরিক ক্যালেন্ডার আবিষ্কার মানবসভ্যতার অন্যতম সামষ্টিক সাফল্য

মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে কয়েকটা কালেকটিভ প্রচেষ্টা মানুষের সামষ্ঠিক জ্ঞানের উদাহরণ তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাৎসরিক ক্যালেন্ডার আবিষ্কার। এই যে ৩৬৫ দিনে একবছর, মানে একটা সাইকেল পূর্ন হয় এটা মানুষ আবিষ্কার করেছে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে।।কল্পনা করা যায়, ৫ হাজার বছর আগেই মানুষ গ্রহ, নক্ষত্র, দিন রাতের হিসাব নিকাশ করে বের করে ফেলেছিলো ৩৬৫ দিনে এক বছর। তখনো মানুষ জানতো না পৃথিবী সূর্যের চারপাশে নিজ অক্ষে ঘুরে। এবং এই পুরো ঘুরাটা কমপ্লিট করতে ৩৬৫ টা দিন রাত লাগে।

তবে ক্যালেন্ডার কিংবা সময় গননা একটা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হলেও আমরা এখন যেভাবে সময় গননা করি সেটা পেয়েছি ধর্মীয় চর্চার মাধ্যমে। এই যে সাত দিনে এক সপ্তাহের সাইকেল এটার প্রথম ধারণা পাওয়া যায় বুক অব জেনেসিস এ। ৬ দিনে স্রষ্টা বিশ্ব সৃষ্টি করে সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছিলো– ইহুদীদের সাবাথ ডে। একে একে আব্রাহামিক বাকি রিলিজিয়ন গুলো সেটা ফলো করলো– খ্রীষ্ঠান ও ইসলাম ও পৃথিবী ৬ দিনে সৃষ্টি এটা বিশ্বাস করে। একদিন বিশ্রাম এটা প্রায় পৃথিবীর বেশির ভাগ ধর্ম ও কালচারে পাওয়া যায়। এটা খুব ইন্টারেস্টিং। আজকালের মত যোগাযোগ তো প্রাচীন কালে ছিলো না, তাহলে কিভাবে সাত দিনের সাইকেল মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় একইভাবে হিসাব রাখা শুরু করলো? এটাকে বলে ইউনিভার্সেল হিউম্যান সাইকি।।প্রকৃতির কমন ফেনোমেনন গুলো থেকে মানুষ একই রকম অনুসিদ্ধান্তে আসে।

২০২৩ সাল শেষ হতে যাচ্ছে, ২০২৪ সাল শুরু হবে।।এটা কিন্ত পৃথিবীর বয়স না।।এটা সভ্যতার বয়স ও না। এটা যীশু খ্রীষ্টের বয়স মানে খ্রীষ্টানিটির বয়স। যদিও এখন সেখানেও বিতর্ক দেখা দিয়েছে মানে যীশুর জন্ম ১ AD তে না, ৪ বিসিই তে। মানে এতদিন আমরা যেভাবে যীশুর জন্মসাল কে প্রমান ধরে বয়স হিসাব করে আসছি সেটাও পরিবর্তন হয়ে গেল। তবে মোটাদাগে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার খ্রীষ্ঠান ক্যালেন্ডার। সেই হিসাবে এই উদযাপন খ্রীষ্ঠানিটি দ্বারা হাইলি প্রভাবিত।

মুলত চন্দ্র ও সূর্যের অবস্থান, দিন রাতের সময়ের পার্থক্য ও গাছ ও ফসলের ফুল ফলের সাইকেল হিসাব করে মানুষ দেখলো একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর সবকিছু একই জায়গায় ফিরে আসে। এবং সেটা যে ৩৬৫ দিন এটা মানুষ সুমেরিয়ান মানে একদম প্রথম সিভিলাইজেশনেই বের করে ফেলতে পেরেছে। সুমের, ইজিপশিয়ান ক্যালেন্ডার এর যে আর্কিওলজিকাল প্রুফ পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় এইগুলো ৩৬৫ দিনে বছর এই হিসাবে ছিলো।

তবে, বিশ্বব্যাপী দুইটা ক্যালেন্ডার গ্রুপ আছে- সোলার গ্রুপ ও লুনার গ্রুপ৷ যদিও সোলার গ্রুপ টাই ডমিনেন্ট ও একুরেট হিসাবে বিশ্বব্যাপী ব্যবহার হয়।।কিন্ত আমরা বিশ্বব্যাপী এখন যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি মানে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার এটা কিন্ত খ্রীষ্ঠান ক্যালেন্ডার।

কিন্ত আমরা যে মাস, মানে ১২ মাসে এক বছর হিসাব করি এটা লুনার সিস্টেম থেকে এসেছে।।তারমানে সোলার ও লুনার সিস্টেম দুইটা মিলেই মডার্ন ক্যালেন্ডার সিস্টেম। সেই সুমেরিয়ান, ইজিপশিয়ান সবাই কিন্ত ৩০ দিনে মাসের কনসেপ্ট ডেভেলপ করতে পেরেছিলো।।তখন মাসের নাম ছিলো নানা প্রাকৃতিক ইভেন্ট, দেব দেবীর নামে। কিন্ত আমরা যে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি, সেখানে মাসের নাম এসেছে রোমান ও গ্রীক ট্রাডিশন থেকে। রোমান এবং গ্রীক ট্রাডিশনের উপর দাঁড়িয়ে আজকের ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড। বারো মাসের নামের মধ্যে ৭ টা গ্রীক আর ৫ টা রোমান অরিজিন।।সবচেয়ে মজার ব্যাপার, সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের নাম গ্রীক যেগুলোর অর্থ সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম মাস। কারণ রোমান ক্যালেন্ডারে জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী পরে যোগ করছে।এই কাহিনিটা খুব মজার।

সাধারণত রোমান ক্যালেন্ডার শুরু হতো মার্চ দিয়ে। মার্চ একজন রোমান যুদ্ধ দেবতার নাম।।রোমানরা দীর্ঘ শীতের পর মার্চ মাসে মিলিটারী ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বছর শুরু করতো তাই যুদ্ধ দেবতার নামে বছর শুরু হতো।। এবং তাদের ক্যালেন্ডার ছিলো ১০ মাসের।।তখন জানুয়ারী ফেব্রুয়ারীকে তারা গোনায় ধরতো না।।রাফলি ৬১ দিন শীত ও বরফে চারপাশ ঢেকে থাকতো, তাই কাজ কর্ম হতো না।।এই কারণে এই অংশ তারা ক্যালেন্ডারে হিসাব ই করতো না।খ্রীষ্ট পূর্ব ৭১৩ সালের দিকে রোমান সম্রাট নুমা পম্পিলিয়াস জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারীকে বছরের হিসাবে যোগ করে লুনার মান্থ ও এগ্রিকালচার সিজনের সাথে বছরকে যুক্ত করে। জানুয়ারী নাম এসেছে রোমান দেবতা জানুস থেকে।।যিনি দরজা কিংবা কোন কিছু শুরু করার দেবতা।।আর ফেব্রুয়ারী এসেছে গ্রীক ওয়ার্ড ফেব্রাম থেকে যার অর্থ পিউরিফিকেশন।। রোমানরা মার্চে যুদ্ধ শুরু করার আগে ফেব্রুয়ারীর এই সময়ে নিজেকে প্রস্তুত করতো।।ডিসিপ্লিন্ড লাইফ লীড করতো।।তাই এই মাস তাদের কাছে আত্মশুদ্ধির মাস ছিলো।

এতক্ষন যা বলছিলাম সেটা জুলিয়ান ক্যালেন্ডাররের গল্প, যেটা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পূর্ব পুরুষ ধারণা করা হয়।। জুলিয়ান আবার এসেছে অল্ড রোমান ( পম্পিলাস যে ক্যালেন্ডার ফলো করতো) থেকে। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার যীশুর জন্মের ৪৫ বছর আগে থেকে প্রচলন হয়। কিন্ত এই ক্যালেন্ডারে সমস্যা দেখা দিছে যখন খ্রীষ্ঠানিটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং রোমান সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্ম হিসাবে পালিত হতে লাগলো।।জুলিয়ান ( জুলিয়াস সিজার প্রবর্তিত) ক্যালেন্ডারে বছর গননা করা হতো বছর ৩৬৫.২৫ দিনে।।এইজন্য প্রতি চারবছর পর পর ১ দিন যোগ হতো ফেব্রুয়ারীতে। কিন্ত সমস্যা দেখা দিলো ইস্টার সানডে পালন করতে গিয়ে। কারণ পৃথিবী তার অক্ষে একবার ঘুরে আসতে এক্সেক্টলি সময় লাগে ৩৬৫.২৪২২ দিন, যেখানে জুলিয়ান ক্যালকুলেট করতো ৩৬৫.২৫ দিন হিসাবে।।এই কারণে যে বছর ১০০ এবং ৪০০ দুটো সংখ্যা দ্বারা বিভাজিত হবে না সেটা লীপ ইয়ার হবে না।।এই যেমন খোলা চোখে ২০০০ সাল লীপ ইয়ার কারণ এটা ১০০ এবং ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য কিন্ত ১৯০০ সাল লীপ ইয়ার ছিলো না সেটা ১০০ এবং ৪ দিয়ে বিভাজ্য হলেও ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য নয়। এর মাধ্যমে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার আরো একুরেটলি যীশুর রিসারেকশন মানে রবিবারে পুনরুত্থানকে বিশ্বব্যাপী ইউনিফাইড করতে পেরেছে।।কারণ ইস্টার সানডে পালনের নিয়ম হচ্ছে — ৩২৫ সালে ফার্স্ট কাউন্সিল অফ নিকায়া ঠিক করেছিলো ইস্টার পালন হবে ভার্নাল ইকুইনক্স ( ২১ শে মার্চ যেদিন দিনরাত সমান মানে পৃথিবী চাঁদ সূর্য একই অক্ষে থাকে) এর পর প্রথম ফুল মুনের পর প্রথম যে রবিবার আসবে সেদিন।। কিন্ত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের স্লাইট ইনেকুরেসির কারণ দেখা গেল, ইস্টার পালন কয়েকশ বছর পর পর সামান্য চেঞ্জ হয়ে যায়। কারণ স্পিং একুইনক্স ( সামান্য পরিবর্তন হয়). এই কারণ পোপ গ্রেগরী ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করেন।।দিন তারিখ মাস ক্ষন সব এক এই ক্যালেন্ডার আর জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের। শুধু কয়েকটা রিলিজিয়াস সেলিব্রেশন যেমন ইস্টার সানডে ক্যালকুলেশন এডজাস্ট করা হয়েছে।।এখন গ্রেগরিয়ান সোলার ক্যালেন্ডার হলেও ইস্টার সানডে লুনার ইভেন্ট।।তাই সোলার ও লুনার দুই ইভেন্টের এডজাস্টমেন্ট এই গ্রেগরিয়ান সিভিল ক্যালেন্ডার। চিন্তা করেন- মার্চ থেকে আমাদের যদি বছর শুরু হতো তাহলে যুদ্ধ দিয়েই আমাদের বছর শুরু হতো।।আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন ক্যালেন্ডারটা দেখেন- মার্চ থেকে শুরু হয়ে ডিসেম্বরে শেষ– একদম যেন অল্ড রোমান ক্যালেন্ডার ইয়ার।

এর বাহিরে ইসলামী হিজরি বছর, চীনা বছর লুনার কিংবা চান্দ্র হিসাবে।।কিন্ত সমস্যা হচ্ছে চান্দ্র মাস ২৯.৫ দিনের তাই বছর শেষ হয় ৩৫৪- ৫৫ দিনে।।এই কারণে ১০ দিন এডজাস্ট করতে হয়। চীনারা মাঝে মাঝে ১৩ মাসে বছর হিসাব করে ট্রাডিশনাল চাইনিজ ক্যালেন্ডারে যাতে চান্দ্র মাস হিসাবের অতিরিক্ত দিনগুলো এডজাস্ট হয়ে যায়।

সময় গননা একটা অসাধারণ সামষ্ঠিক জ্ঞান।।এর সাথে মানুষের জৌতির্বিদ্যা, আবহাওয়া, কৃষি, পশুপালন, এবং ধর্মীয় আচার সবই কমপ্লেক্সভাবে কানেক্টেড। সময়কে ধ্রুব ধরে মানব সভ্যতা ৫ হাজার বছর পার করার পর একজন বিজ্ঞানী এসে ঘোষণা দিলো সময় ধ্রুব নয়।।এটা আলোর গতির সাপেক্ষে পরিবর্তন হয়, ভরের সাথে বেকে যেতে পারে। স্থান ও সময়ের এই পরিবর্তনশীলতা আমাদের অন্য এক জগত আবিষ্কারের পথ খুলে দিলো।। যে সময়কে কোটি কোটি মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে নির্মান করেছে, আইনস্টাইন একাই সে ধারণা পালটে দিলো।।একেই বলে সম্ভবত “জিনিয়াস”। আমরা এখন জানি সময়ের ধারণা পৃথিবীর ঘূর্ননের গতি এবং সূর্য থেকে এর অবস্থানের উপর।। এই যেমন মংগল গ্রহে প্রায় ৬০০ দিনে একটা সাইকেল পূর্ন হয় মানে বছর হয়। আর সূর্যের কাছে যেসব গ্রহ তাদের বছর পূর্ন হয় আরো কম দিনে। এর অর্থ এই মহাশূন্যের বয়স কত আমরা জানি না, আর যেটা হিসাব করি সেটাও আমাদের পৃথিবীর জানা সময়ের তুলনায়।।কিন্ত অন্য গ্রহে সময়ের একক দৈর্ঘ্য তো এক নয়।মহাশূন্যে এক বছর কাটানো এই পৃথিবীর এক বছর থেকে অনেক কম হবে। মানে কেউ মহাশূন্যে এক বছর কাটিয়ে আসলে দেখবে পৃথিবীতে হয়তো ১০ কিংবা এরো বেশি সময় পার হয়ে গেছে। জুপিটারে এক বছর কাটাই আসলে পৃথিবীতে এসে দেখলে সাড়ে এগারবছর সময় পার হয়ে গেছে। কি অদ্ভুত না?

নতুন বছরে আমার কোন রেজুলেশন নাই। কারণ আমার বছর গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার দিয়ে শুরু হয় না।।আমি প্রতিটা দিন শুরু করি একটা নতুন উদ্যম নিয়ে যাতে পৃথিবীর আগের দিন থেকে আরেকটু বেশি বাস যোগ্য হয়েছে কিনা? তাই আমি দিন গুনি, বছর না। তবুও এই পৃথিবী একট সময়ের সাইকেলে বন্দী। আমি আপনি সবাই এই সাইকেলে কিভাবে আটকে আছি তাও জানিনা।।আমরা হিসাব করি আমাদের দেহের বয়স, জন্মের বয়স,বিবাহের বয়স, স্মৃতির বয়স– কিন্ত হিসাব করি না আমাদের হাসির বয়স, কান্নার বয়স– কারণ হাসি ও কান্না প্রাত্যহিক তাই এইগুলোকে বয়সের হিসাবে বাধা যায় না।।আমিও তেমন হাসি কান্নার মধ্যেই আটকে থাকতে চাই, যা বছরের দৈর্য্যে বাধা যায় না।

আমার কোন নিউ ইয়ার রেজুলেশন নাই। তবে, একটা লাইফ লং রেজুলেশন আছে– যতই পৃথিবীতে কান্নার বিপরীতে হাসির শব্দ বাড়তে থাকবে ততই পৃথিবীর বয়স উদযাপন স্বার্থক হবে।