স্নাতক বিষয় হিসেবে কেমন মেরিটাইমের মেরিন ফিশারিজ?

২০১৯-২০ সেশন হতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ এন্ড ওশান সাইন্স অনুষদের অধীনে মেরিন ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের স্নাতক অধ্যায়ন চালু রয়েছে।

এটি বাংলাদেশের একমাত্র মেরিটাইম, ৩৭তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন হওয়ার এর সুযোগ সুবিধাও বিশেষ।

বর্তমানে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে পড়াশোনা করানো হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিন ফিশারিজ ডিপার্টমেন্ট চালু করা হয়েছে।

মাৎস্যবিজ্ঞান হল যেকোনো পানির অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা। অন্যদিকে সামুদ্রিক মাৎস্যবিজ্ঞান হল সমুদ্রের অ্যন্তরীণ বিষয়াবলী নিয়ে পড়াশোনা।

তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, সাধারণ ও সামুদ্রিক মাৎস্যবিজ্ঞান দুটোই কিন্তু সম্পূর্ণ পৃথিবীর মাৎস্য সম্পদ নিয়ে আলোচনা করে। তবে সামুদ্রিক মাৎস্যবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটি সমুদ্র নিয়ে একটু বেশি আলোচনা করে। এমনিতে দুটো বিষয়েই কোর্স প্রায় একই।

কি কি পড়ানো হয়?

সামুদ্রিক মাৎস্যবিজ্ঞান জীববিজ্ঞানের একটি ফলিত শাখা। ফলে এখানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশই থাকবে জীববিজ্ঞান বিষয়ক।

যাদের পছন্দ জীববিজ্ঞান, তাদের জন্য অবশ্যই বেশ উপভোগ্য হতে যাবে এটি। মোট ১৫০ ক্রেডিটের লম্বা একটি বিষয় এটি। তাই বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে, বলাই যায়।

এই বিষয়ে কোর্সগুলো মূলত গবেষণা ও ক্যারিয়ার ভিত্তিক। ফলে যাদের গবেষণা কিংবা চাকরির দিকে যাওয়ার ইচ্ছে, তাদের জন্য বেশ ভালো সুযোগ।

চার বছরে থাকছে মাছ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণি বিস্তারিত আলোচনা, অন্যান্য সামুদ্রিক জীব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা, বাস্তুসংস্থান, জলজ চাষ (অ্যাকুয়াকালচার), হ্যাচারি ও পোনা বিষয়ক আলোচনা, অণুজীববিজ্ঞান (মাইক্রোবায়োলজি), অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা। সাথে রসায়ন ও গণিতের কোর্স থাকছেই!

শুধু কি বই পুস্তকের জানেই চলবে?

ল্যাব কোর্সগুলোর সাথে আছে বাধ্যতামূলক গবেষণা! হ্যাঁ, চতুর্থ বর্ষে গিয়ে টানা এক বছর বাধ্যতামূলক সকলকেই গবেষণা করে আর্টিকল প্রকাশ করতে হবে।

এতেও শেষ নেই, প্রতিবছর একবার করে মোট চারবার ফিল্ড ট্রিপে নিয়ে যাওয়া হবে কক্স বাজার, সেন্ট মার্টিন, সুন্দরবন, চট্টগ্রাম ইত্যাদি জায়গায়! এগুলোও কিন্তু কোর্সের অন্তর্গত! এগুলোর জন্য বরাদ্দ ৪ ক্রেডিট। তাই পড়াশোনা বই-পুস্তকের পাশাপাশি চলবে হাতেকলমেও!

কর্মক্ষেত্রঃ

সামুদ্রিক মাৎস্যবিজ্ঞানের কর্মক্ষেত্র আসলে দুটো। সমুদ্র এবং অন্যান্য জলজ উৎস, সবই সামুদ্রিক মাৎস্যবিজ্ঞানের ক্ষেত্র। যেহেতু মাছ রপ্তানিতে পুরো বিশ্বে বাংলাদেশ সেরা, অতএব এ বিষয়ক কর্মক্ষেত্র কতটা তা তো সহজেই অনুমান করাই যায়।

অতএব সহজেই এসব প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হওয়া যাবে। এর বাইরে আরো যেসব ক্ষেত্র বিদ্যমান:

সরকারিঃ

১. বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই),

২. জেলা মৎস্য কর্মকর্তা

৩. উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (বিসিএসের মাধ্যমে)

৪. বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন

৫. মৎস্য অধিদপ্তর

৬. ওয়ার্ড ফিশ সেন্টার

৭. বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র (বিএফডিসি) ও এর শাখা কেন্দ্রসমূহ

৮. বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (বার্ক)

৯. ফিশারীজ ও ফিশারীজ সংশ্লিষ্ট একাডেমী ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

১০. সরকারি মৎস্য খামার

১১. সরকারি ক্রাব খামার।

এছাড়াও মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়কে সহায়তাকারী বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা/দপ্তর সমূহে মাৎস্যবিজ্ঞান গ্র্যাজুয়েটদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

যেমন:
১২. ভূমি মন্ত্রণালয়
১৩. স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়
১৪. সেচ, পানি উন্নয়ন ও বন্যা মন্ত্রণালয়
১৫. শিক্ষা মন্ত্রণালয়
১৬. বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
১৭. শিল্প মন্ত্রণালয়
১৮. অর্থ মন্ত্রণালয়
১৯. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
২০. শিপিং মন্ত্রণালয়
২১. পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
২২. যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়
ব্র্যাক রিজিওনাল অফিস

বেসরকারিঃ

১. বেসরকারি মৎস্য খামার
২. বেসরকারি ক্রাব খামার
৩. দেশি-বিদেশি এনজিও
৪. বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি (ব্রাক)
৫. প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র
৬. গ্রামীণ ব্যাংক
৭. আরডিআরএস
৮. বাঁচতে শেখা
৯. টিএমএসএস
১০. অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট (আশা)।

আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহঃ

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও মৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

যেমন:
১. ওয়ার্ল্ড ফিশ সেন্টার
২. ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি)
৩. বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ফাও)
৪. জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল (ইউএনডিপি)
৫. কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
৬. কারিতাস বাংলাদেশ
৭. নেচার কনজারভেসন মুভমেন্ট
৮. এশিয়ান ওয়েটল্যান্ড ব্যুরো
৯. ডেনিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (ডানিডা)
১০. সোসাইটি ফর কনজারভেশন অব নেচার এন্ড এনভায়রনমেন্ট (এসসিওএনই)
১১. ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্স (আইইউসিএন)
১২. সাউথ এশিয়া পার্টনারশিপ বাংলাদেশ (এসএপি)

ব্যক্তিগত খাতসমূহঃ

১. মৎস্য খামার
২. মৎস্য হ্যাচারি
৩. মৎস্য খাদ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিসমূহ
৪. মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পসমূহ প্রকল্প ও প্রোগ্রামসমূহ: স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী বিভিন্ন প্রকল্প ও প্রোগ্রামে ফিশারীজ গ্রাজুয়েটের অংশ নেয়ার সুযোগ রয়েছে।

যেমন-
* সরকারী অর্থায়নে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্প ও প্রোগ্রামসমূহ
* আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের (ডিএফআইডি, ইউএস এইড, ডানিডা ইত্যাদি) উদ্যোগে বাস্তবায়িত প্রকল্প ও প্রোগ্রামসমূহ।

ব্যাংকসমূহঃ

বিভিন্ন ব্যাংকের মৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ক ঋণপ্রদানের সেকশনে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমন:

১. বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
২. রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক
৩. সোনালী ব্যাংক
৪. অগ্রণী ব্যাংক
৫. রূপালী ব্যাংক
৬. জনতা ব্যাংক
৭. সমবায় ব্যাংক
৮. কর্মসংস্থান ব্যাংক।

আত্মকর্মসংস্থানঃ

বিএস ইন মেরিন ফিশারিজ (অনার্স) ডিগ্রী অর্জনের পর একজন মেরিন ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েট নিজেই তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন।

অর্থ যোগানোর জন্য দেশের বিভিন্ন ব্যাংকসমূহে ঋণের সুযোগও রয়েছে। প্রথমে স্বল্প পরিসরে উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর সে প্রচেষ্টাকে বৃহৎ পরিসরে বর্ধিত করে নিশ্চিতভাবেই অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও ফিশারীজ গ্রাজুয়েটের পক্ষে সম্ভব।

যেমন:

১. হ্যাচারি ও রেণু উৎপাদন
২. পোনা ও টেবিল-সাইজ মৎস্য উৎপাদন
৩. মুক্তা উৎপাদন
৪. কাঁকড়া উৎপাদন
৫. সি-উইড উৎপাদন
৬. সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রাণি সরবরাহ
৭. বাহারি মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন
৮. মৎস্য খাদ্য উৎপাদন
৯. মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ
১০. মৎস্য সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম (যেমন- জাল) উৎপাদন
১১. চাষকৃত পুকুর/দিঘীতে মৎস্য শিকারপ্রতিযোগিতা আয়োজন
১২. মৎস্য পর্যটন (ফিশারীজ হটস্পট যেমন- সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, হাকালুকি হাওর, চলন বিল মেঘনারইলিশ অভয়াশ্রম ইত্যাদি স্থানে ফিশারীজকে গুরুত্বদিয়ে পরিদর্শনের আয়োজন।

আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোর্স অনুযায়ী শিক্ষা সফরের আয়োজন)
১৩. মৎস্য রোগ প্রবণ এলাকায় মৎস্য ক্লিনিক স্থাপন
১৪. অনলাইন মৎস্য তথ্য কেন্দ্র পরিচালনা

দেশের বাইরেঃ

দেশের বাইরেও মৎস্য বিষয়ক বিভিন্নপ্রতিষ্ঠানে একজন ফিশারীজ গ্রাজুয়েট যোগ দিতে পারেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষত গল্ফ ও আফ্রিকা অঞ্চলের দেশসমূহে মৎস্য চাষ ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে মৎস্য পেশাজীবীর চাহিদা রয়েছে।

আর, গবেষণার বিস্তর সুযোগের কথা না-ই বা বললাম।

যদি জীববিজ্ঞান তোমার প্রিয় বিষয় হয়, মেরিন ফিশারিজ হতে পারে তোমার পছন্দের একটি বিষয়। আশা করছি ৪ বছর উপভোগ করতে পারবে ভালভাবেই।

 

তাসনুর জাহান মীম,

বশেমুরমেবি প্রতিনিধি।

তথ্য সহায়তাঃ মুহাম্মাদ আশরাফুল আলম শিমুল;

কর্মক্ষেত্র সংক্রান্ত তথ্যের জন্য কৃতজ্ঞতাঃ তাহমিদ, ১১শ ব্যাচ, মাৎস্যবিজ্ঞান, নোবিপ্রবি!