ভালোবাসতাম শিক্ষকতা, গবেষণা।
ইন্টারমিডিয়েট এ বায়োলজি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম বলে আম্মু প্রচণ্ড মন খারাপ করায় শেষ পর্যন্ত বায়োলজি রেখে দিলাম, এডমিশন টেস্ট এর রেজাল্ট হওয়ার পর আমাকে আর BUET বা Dhaka University তে পরীক্ষা দিতে দেয়া হয়নি।
না, কেউ না করেনি কিন্তু বুঝতাম বাবা ছাড়া সবাই চায় আমি মেডিকেল এ পড়ি।
মন খারাপ করেই মেডিকেল এ ভর্তি হলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে এই লাল দালান, খোলা ছাদ মস্ত আকাশ, বুড়িগঙ্গা আর ২৬ এর বন্ধুত্ব তে ভিজতাম,ঝড়ের তাণ্ডব দেখতাম, দেখতাম নদী আর আকাশের রঙ বদলের অপূর্ব খেলা।
মাঝে মাঝে দূর থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসত বুকের মধে হু হু করত। এই আনন্দ আর অকারন বেদনার দিন ভোলার নয়।
মন খারাপ করে পড়তে পড়তে প্রথম বর্ষে আমি ৭ম হয়ে গেলাম, নিজের প্রতি দায়িত্ব কিভাবে যেন বেড়ে গেল। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
১ম প্রফেশনাল পরীক্ষায় কম্বাইন্ড মেরিট লিস্টে ৯ম হলাম। ২য় প্রফেশনাল পরীক্ষায় সলিমুল্লাহ এ ২য় হলাম। ফাইনাল প্রফে ১ম হলাম ।
আমাদের ভালো রেজাল্ট এর পেছনে প্রফেসর মোজাম্মেল হক স্যার এর ভূমিকা অপরিসীম।
আমরাই বাংলাদেশের প্রথম ব্যাচ যারা ঠিক ৫ বছরে মেডিকেল থেকে পাশ করে বেরিয়েছি তার আগে ১-২-৩ বছরের ও সেশন জট থাকত।
সেই সময় আমরা স্টুডেন্টরা মিলে ‘HELP’ নামের একটা অরাজনৈতিক সংগঠন চালাতাম। প্রত্যেক স্টুডেন্ট এর কাছ থেকে ২০ টাকা চাঁদা তুলে আমরা ওয়ার্ডে গিয়ে গরীব রোগিদের সাহায্য করতাম।
মানুষের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ আর তৃপ্তির কোন তুলনা হয়না।
জীবনে আনন্দ বিনোদনও যে করিনি তা কিন্তু না।
শুধু পড়াশুনা না এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজেও সমান আগ্রহ ছিলো। ক্যাডেট কলেজে নাচ ও বিতর্ক, দাবা ও ক্যারম এ পুরষ্কার পেয়েছি।
মেডিকেল কলেজে উপস্থাপনা, আবৃত্তি ও নাচ করেছি। ফাউন্ডেশন ট্রেইনিং এ বেস্ট কালচারাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি।
মেডিকেল কলেজ লাইফ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল।
অনেক ঘুরতাম আমি, ফ্রেন্ডদের সাথে চিটাগং, রাঙামাটি, রংপুর গিয়েছি। থার্ড ইয়ারে পুরো ব্যাচ গিয়েছি ইন্ডিয়াতে, সেই স্মৃতি ভোলার না।
এক সময় আমি MBBS পাস করলাম। বেশিরভাগ সময় ওয়ার্ডে থাকতাম। আমি মিটফোর্ডের ট্রেইনিং পিরিয়ডে যা শিখেছি তাই আমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
আমার মনে পড়ে প্রায় ৩ দিন গাইনি ওয়ার্ড এ না যাওয়ার( অন্য ward এ প্লেসমেন্ট ছিল) পর ৪র্থ দিনে ওয়ার্ড এ পা দিতেই এক রোগি দৌড়ে আসল,”দোলায় আইছে রে, দোলায় আইছে”।
বাকি ৪/৫ টা পুরানো রোগী এসে গায়ে হাত দিয়ে আমাকে ধরে দেখতে থাকল তাদের মায়াভরা হাসি মুখ আমি আজও ভুলতে পারি না।
Paediatrics ward এ বাচ্চারা আমার আশেপাশে ঘুর ঘুর করত, একটু সাহসীরা জড়িয়েও ধরত। তখন আমার মনে হত এটাই আমার উপযুক্ত পেশা।
যারা মানুষের জন্য মায়া,ভালোবাসা আর দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে চায়, অসুখের symptoms গুলো মিলিয়ে মিলিয়ে অংক করে তার সমাধান বের করতে চায়, research করতে চায় তাদের জন্য এটাই উত্তম পেশা।
পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সময়টুকু একজন ডাক্তারের জন্য সবচেয়ে কষ্টের। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তো কষ্ট কয়েক গুণ।
একদিকে মেডিকেলের অসম্ভব কঠিন পড়া অন্যদিকে সংসার জীবনের কঠিন হিসাব নিকাশ – কি যে শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রম তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
FCPS part 1 পরীক্ষা দেয়ার আগে আমার বাবা অসুস্থ ছিল। প্রফেসর জিয়া স্যার একরকম জোর করেই সার্জারির বদলে আমাকে গাইনীতে ফর্ম ফিলাপ করান।
১৬ দিন হাতে ছিল। এই ১৬ দিন আমি সূর্য দেখি নাই। শুধু সব সাবজেক্ট এর মেইন বই নিয়ে পড়েছি। পরীক্ষা দিতে যাবার সময় আমি আমার হাসবেন্ড কে জিজ্ঞেস করলাম পার্ট-১ এর প্রশ্ন কেমন হয়?
কিন্তু শুধু মেইন বই পড়েও আমি ঠিক পাস করে গেলাম।
FCPS 2nd part এ আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম। তখন GDM ডেভেলপ করে। হিমোগ্লোবিন লেভেল সাড়ে আটে নেমে আসে।
তখন দুই হাতে ভারি ব্যাগ নিয়ে রমনা থেকে BSMMU হেঁটে যাবার সময় মনে হত আর সম্ভব না। নিজেকে বোঝাতাম যত কষ্টই হোক না কেনো, থামা যাবে না।
পার্ট ২ তেও আমি শুধু মেইন বই পড়তাম। প্রায় সবাই এমনকি এক শিক্ষকও বলে ফেললেন এত ডিপ এ পড়লে কেও একবার এ পাস করে না।
আমি সবাইকে বলতাম ভালো ডাক্তার হওয়ার জন্য পড়ছি, পাস করার জন্য নয়। জুলাই মাসে আমার দ্বিতীয় সন্তান জন্ম নেয়। জানুয়ারী তে আমি FCPS পাস করি।
গত দশ বছরে আমাকে অনেক কমপ্লিকেটেড কেসই ডিল করতে হয়েছে। অনেক অপারেশন করেছি।
অনেক জটিল রোগি যাদের বাঁচার কথা না তাদের আল্লাহ আমার হাত দিয়ে বাঁচিয়েছেন এজন্য নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়।
জীবনে কোনো কিছু অর্জন করতে হলে একটা জিনিসই প্রয়োজন– হার না মানা মানসিকতা। কোনো লক্ষ্য স্থির করলে সেটা না পাওয়া পর্যন্ত থামা যাবে না।
হতে হবে আশাবাদী, নিজের উপর ভরসা রেখে পরিশ্রম করে যেতে হবে। চাহিদা কমাতে হবে, সৎ নীতি নিয়ে চলতে হবে, সব কিছুতেই পজেটিভ চিন্তা করতে হবে আর মানুষকে ভালোবাসতে হবে তাহলেই জীবনে সুখ সাফল্য সবই আসবে।”
Dr. Runa Akhter Dola
Assistant Professor
Dept. Gynae & Obs., SSMC&MH
SSMC- 26th Batch