সেক্যুলারিজম, ভাস্কর্য ও মূর্তি

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন: দশক দুই আগের কথা। আমি তখন আইনের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। একটি শিক্ষা-প্রশিক্ষণ কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ড. কামাল হোসেনকে আমি সেক্যুলারিজমের বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম।

বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি এবং সাবেক আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, কয়েকজন এমপি সেক্যুলারিজমকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আপত্তি করেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে সেক্যুলারিজমকে সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর সুবিবেচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, মুক্তিযুদ্ধসহ সমগ্র পাকিস্তানবিরোধী অন্দোলনে বামপন্থিদের ভূমিকা ছিল অনুঘটকের।

আর বেশ জটিল সমীকরণের নানা বাঁক পরিবর্তনের পরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে বঙ্গবন্ধুও ঝুঁকে পড়েছিলেন ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের দিকে।

এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে সংবিধানে সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তি ছিল যথাযথ। আবার এ কথাও সত্যি যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ গণতন্ত্রের অর্থ সহজে যেভাবে বুঝতে পেরেছে, সমাজতন্ত্রের অর্থটি সেভাবে বুঝতে পারেনি।

আর সেক্যুলারিজমের ব্যাপারে বিরাট এক জনগোষ্ঠীর স্বচ্ছ কোনো ধারণা নেই; বরং অনেকে এটিকে পরকালবিরোধী নীতি বলে মনে করেন।

দুই.

সেক্যুলারিজমের যথাযথ বঙ্গানুবাদটি হওয়া উচিত ইহজাগতিকতা। কিন্তু বাংলাদেশ সংবিধানে সেক্যুলারিজমের বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা।

এটি একটি ‘মিসনোমার’ বা ভ্রান্তিমূলক শব্দ; কেননা, ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময়ে সেক্যুলারিজমের ধারণাটির গোড়াপত্তন হয়ে পরে এটি আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিতে পরিণত হয়।

আবার ভোগবাদ উস্কে দেওয়ার কাজে এ নীতিকে ব্যবহার করায় এটি নিয়ে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়।

মধ্যযুগে ইউরোপে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ক্রিস্টিয়ানিটি ও চার্চ মনে করত, ইহকাল হচ্ছে শয়তানি চাদরে ঢাকা ঈশ্বরের লানতপ্রাপ্ত এক জগৎ, যেখানে নফসের প্ররোচনায় মানুষ জাগতিক ভোগ-বিলাস ও ইন্দ্রিয় সুখে মত্ত হয়ে ওঠে।

খ্রিষ্টধর্ম এবং পৃথিবীর সব প্রধান ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে পরকাল, অথবা মৃত্যু-পরবর্তী জগৎ। পরকালকেন্দ্রিক খ্রিষ্টীয় ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে রেনেসাঁর সময়ে অনেকেই বলতে শুরু করেন, শুধু পরকাল নিয়ে পড়ে থাকলেই হবে না, ইহজাগতিক মনুষ্য জীবনকেও শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ভোগে-সম্ভোগে অর্থপূর্ণ এবং আনন্দময় করে তুলতে হবে।

আমেরিকার স্বাধীনতার ইশতেহারে ‘ফ্রিডম অব লিবার্টি’ এবং ‘পারসুট অব হ্যাপিনেস’-এর মধ্য দিয়ে ইহজাগতিক জীবনকে অর্থপূর্ণ করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল।

ফরাসি বিপ্লব ও ব্রিটিশ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত মানবাধিকারের মধ্যেও ইহজাগতিক জীবনকে পুষ্পিত ও ফলবান করার স্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল।

কিন্তু আমেরিকার স্বাধীনতা-ঘোষণার ‘পারসুট অব হ্যাপিনেস’ বা সুখের অনুসন্ধান এবং পশ্চিমা সভ্যতার ‘দায়িত্বের চেয়ে অধিকারে’র ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ডিসকোর্স ব্যক্তিমানুষকে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। শিল্পায়ন ও পুঁজিবাদের হাত ধরে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর নাগরিক ‘সেলফ’ হয়ে গেছে চরম ভোগবাদী। ফলে, একটা সময়ে এসে ইহজাগতিকতার মানে দাঁড়িয়ে গেল- ‘খাও দাও ফুর্তি করো’।

পশ্চিমা ইহজাগতিকতার সঙ্গে এইখানে প্রাচ্যের ধর্ম-দর্শন ও নীতিবোধের মারাত্মক বিরোধ তৈরি হলো।

প্রাচ্যের ইসলাম, খ্রিষ্ট, ইহুদি ও বৌদ্ধ ধর্ম, কনফুসিয়ানিজম ও হিন্দুইজম ‘খাও দাও ফুর্তি করো’র মতো ভোগবাদী নীতিকে অনুমোদন করে না। এসব ধর্ম পরকালকে সমীহের চোখে দেখে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের সাফল্যের জন্য ইহকালের সুখ-অনুসন্ধানকে পরিহার করতে বলে।

ফলে, পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিজমকে প্রাচ্যের অনেক দেশে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানও এর বাইরে নয়। পাকিস্তান তো প্রথম থেকেই ধর্মীয় রাষ্ট্র কায়েম করেছে। ভারতে আরও কয়েক দফা বিজেপি শাসন জারি থাকলে, এটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

আর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকলেও জনমানসে শক্তভাবে কায়েম আছে সাম্প্রদায়িক চেতনা।

ইউরোপে মানবতাবাদীদের সঙ্গে চার্চের বিরোধ এবং সেক্যুলারিজমের হাত ধরে রাজ্য-শাসনের ক্ষেত্রে জমাটবাঁধা যুগান্তকারী নীতিটি হচ্ছে- রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের পৃথকীকরণ; যার শানে-নজুল হচ্ছে, রাষ্ট্র ও সরকার কোনো ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে না এবং নাগরিকরা যার যার ধর্ম ব্যক্তিগত পরিসরে পালন করবেন। বাংলাদেশে এই অর্থে সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করা হয়েছে।

কিন্তু এর অর্থ সহজভাবে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি, ফলে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সেক্যুলারিজম নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে।

তিন.

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদের উত্থান, ২০১৩ সাল থেকে হেফাজতে ইসলামের তৎপরতা, হলি আর্টিসানে নির্মম জঙ্গি হামলা এবং সাম্প্রতিক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে উত্তেজনা ও বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, আশি ও নব্বইয়ের দশকে ‘মডারেট মুসলিম কান্ট্রি’ বলে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, সেটি হুমকির মুখে।

হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার পরে সরকারের পক্ষ থেকে সফলভাবে জঙ্গি নির্মূল করা হলেও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরির প্রক্রিয়াটি এখনও বহাল আছে, এবং সেই সুবাদে জারি আছে জঙ্গি হওয়ার প্রবণতা।

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরির প্রক্রিয়াটি বহাল থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে- এখানকার মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা-দর্শন একমুখী। আল বেরুনি, ইবনে রুশদ, ইবনে সিনা, ইমাম গাজ্জালী, মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি, শেখ সাদীর মতো বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ও সুফি কবিরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় বুৎপত্তি অর্জন করে মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।

অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মাদ্রাসাগুলোতে ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, জীববিজ্ঞান, ইতিহাস, গ্রিক ভাষা ও তার দর্শনসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে শিক্ষা দেওয়া হতো, সেটি কি বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে এখন দেওয়া হয়?

মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম, শিক্ষণ-পদ্ধতি ও শিক্ষা-দর্শনের জায়গায় কোনো সরকারই হাত দিচ্ছে না। ফলে মাদ্রাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর বেশ বড় একটি অংশ সাম্প্রদায়িক, নারী-বিদ্বেষ ও প্রগতিবিরোধী মনোভাব নিয়ে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করছে। উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর যারা ভর্তি হন, তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ মাদ্রাসা-উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী।

তাদের মধ্যে অনেককেই আমার মেধাবী, বৈচিত্র্যপিয়াসী এবং মুক্তমনা বলে মনে হয়েছে। কিন্তু তাতে এ প্রতিপাদ্য খারিজ হয় না যে, মাদ্রাসা উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ প্রগতি ও নারীবান্ধব নয় এবং তারা সংকীর্ণ ধর্মীয় চেতনাকে ধারণ করে। এতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি দায়ী যারা মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রম ও পাঠদান পদ্ধতিকে যুগোপযোগী করছেন না এবং সেইসব মাওলানা যারা নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে সংস্কার হতে দিচ্ছেন না।

এর পরে রয়েছে ধর্মভীরু ও ধর্মান্ধের মতো স্পর্শকাতর বিষয়। ধর্মভীরু ও ধর্মান্ধের ভেদরেখাটি কোথায়? প্রায়ই আমি সেটি বুঝতে পারি না। কেননা, ধর্মভীরুরা ধর্মান্ধে পরিণত হয়, অথবা ধর্মভীরুরা ধর্মান্ধের মতো আচরণ করতে থাকেন।

কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর নজিরবিহীন হামলা, হেফাজতের শাপলা চত্বর ও মতিঝিল তাণ্ডব, নাসিরনগর ও রংপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, ধর্ম অবমাননার অপবাদ দিয়ে একজনকে পুড়িয়ে হত্যা তো ধর্মান্ধের কাজ!

যে দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা প্রতিনিয়ত নানা ঝুঁকি তৈরি করছে, সে দেশে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীক গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য সরানো কি ঠিক হয়েছে? অথচ গ্রিক দেবী থেমিসের এই ভাস্কর্যটি প্রাচীন গ্রিস ও মিসরে যেমন ছিল, তেমনি একবিংশ শতাব্দীতেও এটি ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বে দেখা যায়। হেফাজতের আবদার অনুযায়ী কবিগুরু ও নজরুল ইসলামের লেখা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া কি ঠিক হয়েছে?

মনে রাখা দরকার, যে জাতিকে সেক্যুলারিজমের অর্থ সঠিকভাবে বোঝানো যায়নি, তাদের কি ভাস্কর্য ও মূর্তির পার্থক্য বোঝানো যাবে?

লেখকঃ অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়