তুই মেডিকেলে চান্স পাস নাই, তাই তুই পুলিশ!

তুই মেডিকেলে চান্স পাস নাই, তাই তুই পুলিশ!

ভিডিও’টা আমি সব মিলিয়ে চার চার বার দেখছি।

এক ডাক্তার ভদ্রমহিলার গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ তার আইডি কার্ড দেখতে চেয়েছে।

এতে ক্ষেপে গিয়ে ওই ডাক্তার মহিলা কি কি করেছে জানেন?

প্রথমে বলেছে- আমি কে জানেন? আমি মেডিকেলের সহযোগী অধ্যাপক।

দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ উত্তরে বলেছে- আপনি যে-ই হন; আইডি কার্ড দেখাতে সমস্যা কোথায়?

-আমি আইডি কার্ড আনতে ভুলে গিয়েছি। কিন্তু আপনি আমার গাড়ি থামালেন কেন? দেখতে পাচ্ছেন না এটা ডাক্তারের গাড়ি? ডাক্তারদের হয়রানি করেন; কতো বড় সাহস! জানেন আমি কে? আমি বীর বিক্রমের মেয়ে।

এরপর ওই ম্যাজিস্ট্রেট বলেছে- আমিও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।

পুলিশ বলছে- আমিও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।

তর্ক কিন্তু চলছ!

এক পর্যায়ে ওই ডাক্তার ভদ্রমহিলা তার পরিচিত মন্ত্রী বা এই টাইপ কাউকে ফোন করে বলেছে- আমাকে পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রট আটকিয়েছে; ওদের কতো বড় সাহস। তুমি একটু কথা বলো।

এরপর এই ভদ্রমহিলা; পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ফোনটা ধরিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু উনারা কেউ ফোন না ধরে বলেছে- আমাদের সিনিয়র স্যারদের সাথে কথা বলতে বলুন।

এরপর এই ডাক্তার মহিলা বলেছে

– তোর কতো বড় সাহস হারামজাদা; তুই আমার গাড়ি আটকাস!

পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট বার বার বলছিল – আপনি তুই তকারি করছেন কেন?

ওই ডাক্তার মহিলা এইবার আরেক ডিগ্রী উপরে গিয়ে বলেছে- আমি ডাক্তার। বুঝস, আমি ডাক্তার। তোরা তো ডাক্তারিতে চান্স না পাইয়া পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট হইসস।

তো এই হচ্ছে- দেশের তিন পেশার মানুষজনের আলাপ-আলোচনা।

ভিডিওটা চারবার দেখার পর আমাকে বলতেই হচ্ছে- ওই পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট যথেষ্ট ভদ্র ভাষায় এই মহিলার সঙ্গে কথা বলছিল। আমার কাছে একবারও মনে হয়নি- তারা কোন বাজে ভাষা ব্যাবহার করেছে। কিংবা বাজে আচরণ করেছে।

আপনি ডাক্তার হলে কি আপনার কাছে পুলিশ সদস্য কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট আইডি কার্ড চাইতে পারবে না?

আর আপনার কাছে আইডি কার্ডই তো চেয়েছে; কেন আপনি তাহলে বলে বসলেন- ডাক্তারদের হয়রানি করেন, কতো বড় সাহস!

এখানে কোথায় ডাক্তারদের হয়রানি করা হলো? পুলিশ তো তার দায়িত্ব পালন করছিল।

আপনি ডাক্তার হন আর অন্য যে কোন পেশার মানুষ; আপনার আইডি কার্ড পুলিশ দেখতে চাইতেই পারে।

তাছাড়া এভাবে ডাক্তারের গাড়ি দেখিয়ে সাধারণ মানুষজনও তো শহরে এমনি এমনি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই পুলিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট তো আপনার কাছে আইডি কার্ড চাইতেই পারে। চেক করার জন্য এটা তারা করতেই পারে।

আর এই জন্য আপনি কিনা রেগে মেগে- আমি বীর বিক্রমের মেয়ে! আমি ডাক্তার! তোরা কি চান্স পাইসস ডাক্তারি’তে এইসব বলে বেড়াচ্ছেন!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ভদ্রমহিলা এমন আচরণ কেন করল?

উত্তর হচ্ছে- তিনি তো এইসব দেখেই বড় হয়েছেন।

বুয়েটে পড়লে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আর মানুষ না! আমি’ই সেরা! ডাক্তারিতে পড়লে, অন্যরা আবার পড়াশুনা করে নাকি! পড়ি তো শুধু আমরা! আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মানুষ’ই মনে হয় না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে প্রাইভেটে পড়াদের আমরা গরু-গাধা মনে করি কিংবা বলেও বেড়াই! আবার ধরুন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে, ওরা আবার ছাত্র নাকি।

এইসব তো আমরা দেখে দেখে বড় হয়েছি।

এতে কি হয় জানেন? আমরা আশপাশের মানুষদের আর মানুষ মনে করি না। নিজেদেরই সব চাইতে বড় ভাবতে থাকি!

এই যেমন বিসিএস ক্যাডারে যারা চাকরি করে; তাদের বেশিভাগই নিজেদের বীর পুরুষ কিংবা হিরো মনে করে। সমাজও এদেরকে এই চোখেই দেখে! এদের ধারণা অন্য পেশার মানুষজন বিসিএসে চান্স পায়নি বলেই না অন্য পেশায় আছে!

তো এই হচ্ছে আমাদের দেশের অবস্থা।

অথচ এই ভদ্রমহিলার কাছে আইডি কার্ড চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেখিয়ে দিয়ে বলতে পারতেন- ধন্যবাদ, আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করছেন।

তার মনে যদি ক্ষোভও থাকতো এই ভেবে যে- আজ ডাক্তার বলে আমার গাড়ি চেক করছে। কোন সচিবের গাড়ি কি চেক করতে পারত?

তিনি কিন্তু খুব ভদ্র ভাষায় এটাও বলতে পারতেন- আমাকে চেক করেছেন; আশা করছি সচিবদের গাড়িও চেক করবেন। আপনাদের চোখে তো সবাই সমান হবার কথা।

তাহলেই কিন্তু ল্যাঠা চুকে যেত। খুব ভদ্র ভাবে নিজের ক্ষোভ টুকু ঝারলেন সেই সঙ্গে পুলিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট যা দেখতে চাইছিল; সেই আইডি কার্ডও দেখিয়ে দিলেন।

ডা: সাঈদা শওকত এর স্ট্যাটাস

কিন্তু এই ডাক্তার মহিলা এর কোন কিছু না করে, এভাবে রেগে মেগে কেন বলে বসলো- আমি ডাক্তার। আমাকে চিনিস তোরা, আমি কে?

অর্থাৎ তিনি নিজেকে পৃথিবীর সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং সেরা ভাবছেন। যার কারনে তার গায়ে লেগেছে গাড়ি থামানোর কারনে।

আপনাদের জানিয়ে রাখি- এই মহিলা নিজেই বলেছেন তিনি ঢাকা কিংবা বিএসএমইউ মেডিকেলের সহযোগী অধ্যাপক। তো, তিনি নিশ্চয় তার ছাত্র-ছাত্রীদের এইসবই শেখান- আমরাই সেরা! অন্যরা তো ডাক্তারিতে চান্স পায়নি বলেই না অন্য কিছু করে!

আজ হয়ত ডাক্তার ভদ্রমহিলার শো দেখেছি আমরা। কিন্তু বিষয় হচ্ছে- পুরো বাংলাদেশে এই শো প্রতিনিয়ত চলছে।

আজ হয়ত ওই পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট বেশ ভালো ব্যাবহার করেছে। অন্য এক দিন হয়ত এমনই কোন পুলিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা ব্যাংকের কর্মকর্তাকে বলে বসবে- আরে বিসিএসে চান্স পাও নাই বলেই তো এইসব করছ!

এই দেশে মানুষ বাস করে না। এই দেশে বাস করে- ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার; জজ-ব্যারিস্টার; বিসিএস ক্যাডার ইত্যাদি ইত্যাদি। যারা প্রতিদিন ঘুমাতে যায় এই ভেবে- আমার চাইতে সেরা পৃথিবীতে কেউ নেই!

আমিনুল ইসলাম
আমিনুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক, এস্তেনিয়া

ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওটি ধারণ করেছেন ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ। বিবিসি বাংলাকে ঘটনাটির বিস্তারিত জানিয়েছেন তিনি।

কী ঘটেছিল তখন?

এলিফ্যান্ট রোড এলাকার ঘটনা এটি। জীবন আহমেদের গাড়িও রাস্তায় চেক করে পুলিশ।

পুলিশের চেকিং শেষ হবার পর সেখানেই ছবি তুলছিলেন মি: আহমেদ।

ওই চেকপোস্টেই ডা: সাঈদা শওকতের প্রাইভেট কারটি আটকায় পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট, তার মুভমেন্ট পাস বা আইডি কার্ড দেখতে চান তারা।

“তিনি ডাক্তার কীনা, তা জানতে আইডি কার্ড দেখতে চান তারা”।

“তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। পুলিশ বলছিল, আমিতো আইডি কার্ড দেখতে চাচ্ছি, আমিতো অপরাধ করছি না। আপনি খারাপ ব্যবহার করছেন কেন? এখানেতো অনেকেই অনেক পরিচয় দিয়ে বের হচ্ছে। এজন্যতো আপনি এরকম ব্যবহার করতে পারেন না।”

জীবন আহমেদের তথ্য অনুযায়ী সেখানে নিউ মার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, একজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন।

এক পর্যায়ে ওই ডাক্তার একজন মন্ত্রীকেও কল করার চেষ্টা করেন।

জীবন আহমেদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই ডাক্তার যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে অনেকের ঘনিষ্ঠ সেরকম একটি ব্যাপার দেখানোর চেষ্টা ছিল এটি।

কিন্তু কেন এমন ঘটনা ঘটলো?

নারীর পরনে এপ্রোন, গাড়িতে ডাক্তারের স্টিকার লাগানো থাকা সত্ত্বেও পুলিশের পক্ষ থেকেই কেন বারবার আইডি কার্ড চাওয়া হচ্ছিল? কেনই বা ডা: সাঈদা এত ক্ষেপে গেলেন?

এই ঘটনার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ইফতেখারুল ইসলাম বলছেন, চলাচলে বিধিনিষেধের এই সময়ে পুলিশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে যানবাহন পরীক্ষা বা পরিচয়পত্র যাচাই করা, এটা কিন্তু তাদের নিয়মিত কাজের অংশ। চিকিৎসকসহ জরুরি সেবায় যারা নিয়োজিত, তাদের কিন্তু মুভমেন্ট পাসের কোন দরকার নেই, তাদের আইডি কার্ডই যথেষ্ট।

এলিফ্যান্ট রোডের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ”সেখানে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই কার্ড দেখতে চেয়েছিলেন, পুলিশ সহায়তা করছিল। এটা আমাদের নিয়মিত কাজেরই অংশ। তারপরে পুরো বিষয়টি তো আপনারা দেখতে পেয়েছেন।”

তিনি বলেন, ”অনেক সময় বিভিন্ন জরুরি সেবার নামে অপব্যবহারের ঘটনা ঘটতেও দেখা গেছে। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে রোগী নেই, কিছু নেই, মানুষ যাতায়াত করছে। এরকমও দেখা গেছে।”

তিনি জানান, পরবর্তীতে তার চিকিৎসক পরিচয় নিশ্চিত হওয়ায় তাকে যেতে দেয়া হয়েছে।

অন্যদিকে ডাক্তার সাঈদা শওকতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছেন। এ বিষয়ে পরে যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় – এমনটাই বলা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে।

তবে ঘটনার পরপর ফেসবুকে ডাক্তারদের গ্রুপ ‘বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনে’ নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন ডা: সাঈদা।

সেখানে তিনি লিখেছেন, তার গাড়িতে বিএসএমইউ-র পারমিশনের কাগজ, তার গায়ে প্রতিষ্ঠানের নাম সহ এ্যাপ্রন থাকার পরও পুলিশ ঝামেলা করেছে। তিনি একে ‘ডাক্তার জাতিকে’ অপমানের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি লিখেছেন, পুলিশ তাকে থানায় নেয়ার হুমকি পর্যন্ত দেয়। তিনিও তাই পুলিশকে কথা শোনাতে ছাড়েন নাই।

এই পোস্ট শেয়ার করে ডা: সাঈদাকে স্যালুট জানিয়ে তার পক্ষ নিয়েছেন অনেক ডাক্তার।

কেন ডাক্তারদের এমন প্রতিক্রিয়া?

লকডাউন শুরুর পর থেকে ফেসবুকে অনেক ডাক্তার অভিযোগ করে লিখছিলেন যে চেকপোস্টে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে।

এতে পুলিশের কর্মকাণ্ড সমালোচনার মধ্যে পড়লে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকেও একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয় যেখানে বলা হয় যে লকডাউনে যাতায়াতের সময় আইডি কার্ড দেখতে চাওয়াটা রুটিন ওয়ার্কের অংশ। এটা যাচাই করা পুলিশের দায়িত্ব আর চলমান বিধিনিষিধের প্রেক্ষিতে পুলিশ এমনটা করছে।