যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বৃদ্ধির সফর

ড. দেলোয়ার হোসেন

যুক্তরাষ্ট্রের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগানের বাংলাদেশ সফর বিশেষ কোনো চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্বাক্ষরের জন্য না হলেও কূটনীতির বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১৪ থেকে ১৬ অক্টোবরের ওই সফরের পর ২০ অক্টোবর ওয়াশিংটন ডিসি থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সাংবাদিকদের সঙ্গে বিগানের টেলিফোনিক প্রেস ব্রিফিংয়েও আমরা তার প্রমাণ পাই।

বলাবাহুল্য, তিনি ভারত সফরের পরই বাংলাদেশে আসেন। অনেকে বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি- আইপিএসের জন্য কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যেই তিনি ঢাকা সফর করেন।

আমি মনে করি, এ সফরের তাৎপর্য এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা জানি, ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেখানে নির্বাচনের ফল যাই হোক বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির কোনো পরিবর্তন হবে না বলেই আমি মনে করি।

বস্তুত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়কালে তার প্রশাসনের ‘রিব্যালেন্সিং স্ট্র্যাটেজিতে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশেষ গুরুত্ব পায়।

আমরা দেখেছি, ২০০৯-১০ সাল থেকে এ অঞ্চলটি নতুন রূপে কীভাবে বিশ্ব রাজনীতিতে মনোযোগ পায়।

বিশেষ করে এ সময়েই ভারত ও চীনের উত্থান ঘটেছে। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গুরুত্বও বেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-চীন নীতি কাঠামো পর্যবেক্ষণে আমরা লক্ষ্য করছি, ডোনাল্ড ট্রাম্প আসার পর এ অঞ্চলের গুরুত্ব বিশেষভাবে বেড়ে যায়।

মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের কথা আমরা জানি। সে জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে চীনবিরোধী প্রচারণা আমরা দেখছি।

আঞ্চলিক গুরুত্বের বিচারে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বাংলাদেশের গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি দ্বিপক্ষীয় পর্যায়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন ও বোঝাপড়া রয়েছে।

এর মধ্যে রোহিঙ্গা সংকট এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিঃসন্দেহে। তবে প্রতিরক্ষা বাণিজ্য, প্রশিক্ষণসহ মিলিটারি সহযোগিতা, কাউন্টার টেররিজম ইত্যাদি বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির যেমন আলোচনা রয়েছে, তেমনি খাদ্য নিরাপত্তা, জ্বালানি নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয় আলোচিত হয়ে আসছে।

স্টিফেন বিগানের সফরে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ স্বার্থসংশ্নিষ্ট কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জোরালোভাবে তুলে ধরতে পেরেছে। এগুলোর অন্যতম প্রথম ও প্রধান বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট।

বলা প্রয়োজন যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সবার সঙ্গেই কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে একদিকে যেমন চীন ও ভারতের ভূমিকা প্রয়োজন, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তথা শক্তিশালী দেশগুলোরও এগিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রভাবশালী দেশ হিসেবে আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র এর আগে বসনিয়া-হারজেগোভিনাসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশের সংকট নিরসনে কাজ করেছে।

এটা সত্য যে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্র ইতিবাচক। কিন্তু তাদের আরও জোরালো উদ্যোগ প্রয়োজন। বিগানের সফরে বাংলাদেশ সে বিষয়টিই তুলে ধরেছে। আমি মনে করি, এটি বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিজয়।

আমরা দেখেছি, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ব্যাপারে বাংলাদেশ তার সুরে কথা বলেছে। এক্ষেত্রে মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগানও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন, যা অত্যন্ত ইতিবাচক। প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অবস্থানের প্রতি পূর্ণ সংহতি স্থাপন করে বলেছে যে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের দায়িত্ব বাংলাদেশের একার নয়।

এটি একটি বৈশ্বিক দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর আরও স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। যদিও স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের রোহিঙ্গা নীতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, বিশেষ করে এর কার্যকারিতা প্রসঙ্গে।

তবে বিগানের এ বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। এটি সন্দেহাতীতভাবে বড় অর্জন।

২০ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনেও বিগান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন।

এটি বাংলাদেশের জনগণেরই মনোভাবের প্রতিফলন। এই সংকট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই বাংলাদেশের পাশে আছে। বর্তমানে এ সংকট আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে বিবেচিত হচ্ছে। এ বিবেচনায় এ সংকটের দ্রুত ও স্থায়ী সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দিচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং চীনেরও আরও ভালো ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।

দ্বিতীয়ত, বিগানের সফরে সার্বিক অর্থে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়ে মার্কিন সমর্থনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

এক্ষেত্রে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও জ্বালানি খাতে মার্কিন বিনিয়োগ অতীতে ছিল এবং এটি বর্তমানে বৃদ্ধির সুযোগ আছে। তৃতীয়ত, যে বিষয়টি ঘিরে মার্কিন প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে সদিচ্ছার অভাব দেখাচ্ছে, সেটি হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পলাতক হত্যাকারীদের বাংলাদেশে ফেরত দেওয়া।

এ মুহূর্তে দেশটিতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে দ্রুত বাংলাদেশের হাতে সমর্পণ করা। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের দাবির প্রেক্ষাপটে মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের বিবেচনায় আছে।

এই আশ্বাসটি যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক নয় এবং পর্যাপ্ত সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়নি। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা প্রাপ্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

করোনাকালে এই ভিসার বিষয়টি জটিল হলেও যেখানে যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য করোনায় আক্রান্ত দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের ভিসার সুযোগ করে দিচ্ছে; বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্য গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি সফরের প্রাক্কালে এবং সফরকালে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন।

ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি-আইপিএসের বিষয়ে যদি বলি, তাহলে ভারতে বিগানের আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল ইন্দো-প্যাসিফিক জোটকে আরও জোরদার করা। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে এই বিষয়টি প্রচ্ছন্নভাবে মূল ভূমিকা রেখেছে।

প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। চীন-ভারত ও চীন-মার্কিন ক্রমবর্ধমান বৈরিতার প্রেক্ষাপটে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিনিদের আগ্রহ বেড়েছে। ফলে এই সফরের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির বিষয়ে বাংলাদেশের সমর্থন কিংবা আগ্রহ বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল। বিষয়টি আনুষ্ঠানিক আলোচনার বিষয় না হলেও এই তৎপরতার প্রতিফলন ঘটাই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা না থাকলেও এই জোটে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তবে বাংলাদেশ তার অবস্থান থেকেই এর সুন্দর সমাধান করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

তবে বিগানের সফর যে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সেটা আগেই বলেছি। আঞ্চলিকতার বাইরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নানাদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ।

এখানে বাংলাদেশের স্বার্থ যেমন রয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও কম নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বব্যাপী দৃশ্যমান। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ ঘটাতে যাচ্ছি। আমাদের জিডিপি বাড়ছে। এমনকি করোনাদুর্যোগের এ সময়ে অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যখন খারাপের দিকে, তখনও বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

এমনিতেই আমাদের অবস্থানের কারণে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তার ওপর বাংলাদেশ একটি বড় বাজার। আমাদের পোশাকশিল্পের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থ রয়েছে। একদিকে সস্তায় তারা আমাদের থেকে পোশাক কিনছে, অন্যদিকে বাণিজ্যিক শুল্ক্ক দিয়েই বাংলাদেশের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করছে। ফলে তারাও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। বলা দরকার, তৈরি পোশাক কারখানার কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সালে বাংলাদেশের পণ্যের অবাধ বাজার সুবিধা বা জিএসপি যে স্থগিত করেছে, তা এখনও চালু করেনি। এখানে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের পুনরায় জিএসপি সুবিধার দাবি জানাতে পারি। সম্প্রতি দেশটি বলেছে, পূর্বে ঘোষিত বিভিন্ন দেশের জন্য মার্কিন জিএসপি সুবিধা প্রদান প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ডিসেম্বরে, পরবর্তী প্রকল্প চালু হলে বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা প্রদানের বিষয় বিবেচনা করার সুযোগ আছে। আমি মনে করি, এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে আরও তৎপর হতে হবে।

আমরা জানি, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে নেই, সেখানে মিয়ানমারের সদিচ্ছা রয়েছে। রয়েছে চীন ও ভারতের সহযোগিতার মনোভাব। কিন্তু জিএসপির বিষয়টি একান্তই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে, তাই এ সুবিধা বাংলাদেশকে আদায় করে নিতেই হবে।

সর্বোপরি, স্টিফেন বিগানের সফর বাংলাদেশের কূটনীতির বিজয় বলেই আমি মনে করি। যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির আগ্রহ রয়েছে। বিগান রোহিঙ্গাদের বিষয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলেছে। তার সফর দু’দেশের সম্পর্ক আরও এগিয়ে নিতে ভূমিকা পালন করবে বলেই আমার বিশ্বাস।

অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়