ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও নতুনের ভয়

ফাহমিদুল হক
ফাহমিদুল হক

বর্তমান বাংলাদেশে মতপ্রকাশ পরিস্থিতি বেশ করুণ। ডিজিটাল মাধ্যমে স্বাধীনভাবে কিছু প্রকাশ করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮।

এই আইনের কারণে কেবল সামাজিক মাধ্যমের সাধারণ ব্যবহারকারী নয়, মূলধারার পেশাদারি সাংবাদিকতাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারী ছাড়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, তাদের এক বড় অংশই সাংবাদিক।

সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে যদি এমন পরিস্থিতি, তবে মতপ্রকাশের অন্যান্য মাধ্যমও রয়েছে বিপদে। পুলিশ বইমেলায় বই পরখ করে দেখে, প্রয়োজনে স্টল বন্ধ করে দেয়, বই নিষিদ্ধ করে। চলচ্চিত্র মাধ্যমও এ ক্ষেত্রে বিপদের বাইরে নেই।

চলচ্চিত্রকর্মীদের অনেক দিনের দাবির পর সেন্সর আইনের পরিবর্তে আসছে সেন্সর সার্টিফিকেশন আইন, যেখানে জেলা প্রশাসকদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সার্টিফিকেট পাওয়ার পরও যেকোনো চলচ্চিত্রকে তার জেলায় প্রদর্শন সাময়িকভাবে বাতিল করতে পারবেন।

সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যানের সেই ক্ষমতা রয়েছে সারা দেশের জন্য প্রয়োগ করার। এখন পর্যন্ত সেন্সর বোর্ডের পুলসিরাত পেরোলে প্রযোজকের আর চিন্তা থাকে না। কিন্তু সেন্সরবিধির পরিবর্তে সার্টিফিকেশন আইন চালু হয়ে গেলে, চিন্তা-দুশ্চিন্তার প্রহর শেষ হবে না কখনো।

এসব আইন-কানুন চালু করার ফলে সামাজিক-রাজনৈতিক নানা অব্যবস্থাপনার চিত্র সাংবাদিকতায় বা সাংস্কৃতিক মাধ্যমে তুলে ধরার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।

২০১৫ সালে তো পুলিশ কর্তৃপক্ষ একটা চিঠি পাঠিয়েছিল সব টিভি চ্যানেলে ও চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজকদের সমিতিতে, যে পুলিশের চরিত্র থাকলে তাদের কনটেন্ট দেখিয়ে নিতে হবে।

সম্প্রতি পুলিশ বিস্ময়কর এক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। তারা পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে এই অভিযোগ এনে এক চলচ্চিত্র পরিচালক ও পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতাকে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে।

অনন্য মামুন পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘নবাব এলএলবি’র একটি দৃশ্যে ধর্ষণের শিকার একজন নারী পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে গেলে, দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার যেসব প্রশ্ন তাকে করেছেন, এটা ঠিক তা বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্রে এর আগে দেখা যায়নি; কিন্তু এ ধরনের অভিযোগ থানায় লেখার ক্ষেত্রে কি পুলিশের প্রশ্ন এর চেয়ে শোভন হয়?

চলচ্চিত্রের পুলিশ যেমন বলেছেন, এগুলো তো অভিযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে জরুরি প্রশ্ন ছিল, নইলে মামলা এগিয়ে নেওয়া যাবে না।

এমন নয় যে চলচ্চিত্রে এগুলো জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে পুলিশ চরিত্রটি নিজে বিকৃত আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করছেন (বা পরিচালক বাণিজ্যিক ব্যবহার করছেন পরিস্থিতির, দর্শকদের বিকৃত আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করছেন), দৃশ্যটি দেখে এ রকম মনে হয়নি।

অবশ্যই এটা বলা যায়, এই আলাপ ছিল অস্বস্তিকর এক প্রসঙ্গে এবং এটি পরিবারের সব সদস্যের একসঙ্গে বসে দেখা মুশকিলই হবে। কিন্তু দৃশ্যটি অবাস্তব ছিল এমনটি একেবারেই বলা যাবে না।

বরং কুৎসিত বাস্তবতার প্রতিফলন এতে দেখা গেছে। আমরা একে শিল্পমাধ্যমে না তুলে আনার মাধ্যমে চোখ-কান বন্ধ রাখতে পারি, কিন্তু পরিস্থিতি তাতে বদলাচ্ছে না মোটেও।

নারীর প্রতি সহিংসতা কী ভয়ংকর হতে পারে তা আমরা কয়েক মাস আগেই দেখেছি বেগমগঞ্জের ভিডিওতে।

আর এ ধরনের সংলাপ ভারতসহ পৃথিবীর নানা দেশের চলচ্চিত্রে প্রায়ই দেখা যায়। কখনো পুলিশকে আমরা আপত্তি জানাতে দেখিনি।

আর এ ঘটনায় আপত্তি দূরের কথা, দ্রুততম সময়ে মামলা করে, আদালতে বিষয়টি তুলে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে অভিযুক্তদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

চলচ্চিত্রের মান যেমনই হোক, একটি শিল্পমাধ্যমের একটি বিশেষ অংশকে বিচার করার ক্ষমতা পুলিশ বিভাগের থাকতে পারে না, যা করা হয়েছে তা বাড়াবাড়ির শামিল। শিল্পীর বা স্রষ্টার ব্যাখ্যাকে আমলে নিতে হবে, তবেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।

আরেকটি বিষয় এবং বিষয়টি খুব জরুরি। চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে অনলাইন স্ট্রিমিংয়ের জন্য। এ ধরনের প্ল্যাটফর্মকে বলা হয় ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্ম।

অর্থাৎ, মাঝখানে যে নানা মধ্যবর্তী গোষ্ঠী আছে, চলচ্চিত্রের জন্য বুকিং এজেন্ট, প্রেক্ষাগৃহের পদক্ষেপ বা সেন্সর বোর্ড, তাদের ওপর দিয়ে এখানে চলচ্চিত্র ও দর্শকের সরাসরি যোগাযোগ।

দর্শক টাকা দিয়ে অনলাইনে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সাবস্ক্রাইব করবে এবং সে অনেক ধরনের চলচ্চিত্র ও ওয়েব সিরিজ উপভোগ করবে।

নেটফ্লিক্স এই ধারার প্রথম ও প্রধান প্ল্যাটফর্ম। এ ছাড়া আছে আমাজন প্রাইম ভিডিও। ভারতে রয়েছে এরোস নাও, জি৫ কিংবা বাংলা ভাষার হইচই।

বাংলাদেশে বঙ্গবিডি, বায়োস্কোপ ইত্যাদি দিয়ে শুরু, আসছে নানা নতুন প্ল্যাটফর্ম। ‘নবাব এলএলবি’ মুক্তি পেয়েছে ১৬ ডিসেম্বরে “আই থিয়েটার” নামের একটি প্ল্যাটফর্মে।

এই ওটিটি প্ল্যাটফর্ম একটি নতুন মাধ্যম এবং একে নিয়ে সব মহলের রয়েছে নানা বিভ্রান্তি। যেমন কয়েক মাস আগে খুব শোনা গেল ‘ওয়েব সিরিজের নামে চলছে অশ্লীলতা’। কারণ বিনজ নামের একটি প্ল্যাটফর্মের তিনটি ওয়েব সিরিজে খোলামেলা দৃশ্য ছিল ও সংলাপ ছিল।

বিনজ হয়তো যৌনতা বিক্রিই করতে চেয়েছিল, কিন্তু ওই বিতর্কে পুরো ওটিটি মাধ্যমকেই যেন অভিযুক্ত করা হলো। এর পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছে টেলিভিশন, বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্র কারখানার লোকজন, যারা ওটিটি মডেলের অভিনবত্বে ভীত হয়ে পড়েছে।

কারণ টেলিভিশন নাটক কারখানাকে নিয়ন্ত্রণ করে মধ্যবর্তী বিজ্ঞাপন এজেন্সিগুলো। চলচ্চিত্র নিয়ন্ত্রণ করে বুকিং এজেন্ট ও প্রদর্শকরা। এদের দৌরাত্ম্যে পরিচালক যেমন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না, তেমনি প্রযোজকও বঞ্চিত হন, মুনাফার বড় অংশ নিয়ে যান মধ্যস্বত্বভোগীরা।

ওটিটিতে এ রকম কোনো মধ্যস্বত্বভোগী নেই, প্রযোজক ও পরিচালকরা সরাসরি ওটিটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার মেধাস্বত্ব নিয়ে দেনদরবার করতে পারেন। সনাতনী টিভি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্র দুই ধরনের কনটেন্টই পরিবেশিত হয় ওটিটির মাধ্যমে।

কিন্তু মাধ্যম হিসেবে এটি আগের দুই মাধ্যম থেকেই আলাদা, পরিবেশনের জায়গায়। এটি টেলিভিশনের মতো পারিবারিক মাধ্যম নয়, চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহের মতো সামাজিক মাধ্যমও নয়।

এটির পরিবেশন ও প্রদর্শন প্রায় ব্যক্তিগত। বড় স্মার্ট টিভি থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনের ছোট স্ক্রিন সব ধরনের পর্দাতেই এর কনটেন্ট দেখা যায়। দেখা যায় ভেঙে ভেঙে, দেখা যায় বাসভ্রমণের সময়ও।

তাই টেলিভিশন বা চলচ্চিত্রের মন দিয়ে ওটিটিকে দেখলে চলবে না, না সরকারের, না পুলিশের, না দর্শকের, না সংস্কৃতিমহলের সঙ্গে জড়িতদের।

তবে এটা ঠিক নেটফ্লিক্স থেকে শুরু করে অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে যৌনতা, সহিংসতা ও অপরাধমূলক কনটেন্ট একটু বেশিই দেখা যায়।

কিন্তু যে স্বাধীনতা নির্মাতারা পাচ্ছেন, তাতে বেরিয়ে আসছে নেটফ্লিক্সের ‘রোমা’র মতো জীবনঘনিষ্ঠ অস্কারবিজয়ী চলচ্চিত্র কিংবা অপরাধ কেন্দ্রীয় বিষয় হলেও হইচইয়ের ‘তাকদির’-এর মতো বাস্তবানুগ নির্মিতির ওয়েব সিরিজ।

যেসব চলচ্চিত্রে বা সিরিজে যৌনতা বা সহিংসতা থাকছে, সেসব কনটেন্টের ক্ষেত্রে তো স্ক্রিনের কোনায় লেখাই থাকছে, যা চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশনের বা গ্রেডিংয়ের মূল কথা।

বাংলাদেশের দর্শক নেটফ্লিক্সের সবকিছু দেখবে আর দেশীয় বিষয় নিয়ে সেন্সরশিপের বাহানা শুরু হবে, এটা তো স্ববিরোধিতা। সেন্সরশিপ আছে কী নেই, তার ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু একেকটি দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি পরিমাপ করা হয়।

তাকদির-এ মন্টু চরিত্রের মুখে আমরা বেশ কয়েকবার গালি শুনেছি, আমাদের অনভ্যস্ত কানে তা একটু বাধতে পারে। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে বা ওই চরিত্রের মুখে এমন গালি যতটা মানানসই, প্রমিত-সুশীল বাক্য ততটা মানানসই নয়।

একই কথা প্রযোজ্য ‘নবাব এলএলবি’র ওই সিকোয়েন্সের ক্ষেত্রে। বাস্তবে রেপ ভিকটিম ও পুলিশের সংলাপ এ রকমই হয় বা এর চেয়ে খারাপও হতে পারে। এখানে পুলিশের ভাবমূর্তি কীভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে, তা আমি অন্তত বুঝতে পারিনি।

বরং যে কায়দায় চলচ্চিত্র পরিচালক বা অভিনেতাকে জেলে পাঠানো হয়েছে, তাতে পুলিশের নিপীড়ক চরিত্র আমার কাছে আরও খানিকটা উন্মোচিত হয়েছে। আমার ধারণা, বেশির ভাগ মানুষের কাছেই তা হয়েছে।

আজ সময় এসেছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সবার কথা বলার। নতুন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের প্রকৃতিকে সবাই দ্রুত বুঝতে পারবে, এটা একটা জরুরি প্রত্যাশা। বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটক এবং চলচ্চিত্র উভয়েই সংকটে নিপতিত।

চলচ্চিত্র-টেলিভিশনের দুর্বল কনটেন্ট, বিমুখ দর্শক, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদি নানা সংকটের বিপরীতে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মধ্যস্বত্বভোগীদের স্থান নেই, এর মাধ্যমে দর্শকের কাছেও সহজে পৌঁছানো যাচ্ছে; কেবল দরকার ভালো গল্পের ভালো নির্মিতি।

যদি নির্মাণের স্বাধীনতা না-ই পাওয়া যায়, তবে ভালো গল্পের ভালো নির্মাণ হবে কী করে? বাংলাদেশের অনেক তরুণ ও কিছু অভিজ্ঞ মেধাবী নির্মাতা আছেন, অপেক্ষা করে আছেন ওটিটিতে নিজেদের প্রমাণ করে দেখানোর জন্য। চলচ্চিত্র মাধ্যমকে ভালোবেসে সারা জীবন এর পেছনে ব্যয় করতে চান অনেকে।

স্বাপ্নিক সেই মেধাবীদের জন্য মাধ্যমটিকে বিকশিত হতে দিতে হবে, যাতে তারা একে পেশা হিসেবে নিতে পারেন। নিশ্চয়ই তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সমাজকে ভুলে গিয়ে চলচ্চিত্র ও সিরিজ নির্মাণ করবেন না।

দায়িত্বশীলতার দিকটির প্রমাণও তাদের দিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশ-সরকার থেকে দর্শক এবং মধ্যবর্তী সবাই, আসুন আমরা ওটিটি প্ল্যাটফর্মটাকে বুঝি ও নির্মাতাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিই।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক