ফ্রান্স বিরোধী ফেসবুক পোস্ট দেয়ায় ১৫ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাচ্ছে সিঙ্গাপুর, একজন গ্রেফতার

নির্মাণ শ্রমিক

দেশটিতে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় এ বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নিরাপত্তা অভিযান জোরদার করা হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ এ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৩৭ জনের সন্দেহভাজন কর্মকাণ্ড নিয়ে তদন্ত চালায়।

সন্দেহভাজন এসব ব্যক্তির মধ্যে বিদেশি ২৩ জন এবং স্থানীয় ১৪ জন। তদন্ত শেষে ১৬ বিদেশীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে সিঙ্গাপুর। যাদের মধ্যে ১৫ জনই বাংলাদেশি। বাকি একজন মালয়েশিয়ান।

ইসলাম ধর্মের নবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এর ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফ্রান্স বিরোধী পোস্টের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে এই ১৫ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাচ্ছে সিঙ্গাপুর।

জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের খবরে বলা হয়েছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে সিঙ্গাপুরের নিরাপত্তা বাহিনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নজরদারি শুরু করে।

ওই সময় ফ্রান্সবিরোধী মনোভাব প্রকাশ ও ধর্মীয় অস্থিরতা উস্কে দিতে উগ্র মন্তব্য করার বিষয়টি দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর নজরে আসে।

পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংঘটিত ওইসব ঘটনার তদন্ত শুরু করে সিঙ্গাপুরের নিরাপত্তা বাহিনী। তদন্তের পরে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ১৬ জন বিদেশীকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় সিঙ্গাপুর।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ফ্রান্সে জিহাদীদের হামলার আশঙ্কায় সবোর্চ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছিল।

গত ১৭ অক্টোবর ফরাসি ইতিহাস শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি ক্লাসে শার্লি এবদোতে প্রকাশিত একটি কার্টুন দেখানোর পরই স্কুলের বাইরে চেচেন বংশোদ্ভূত এক তরুণের হাতে খুন হন।

এই ঘটনায় দেশটিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।

ওই সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ মৌলবাদী ইসলামের বিপরীতে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা নিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে কথা বলেছিলেন।

তিনি ওই শিক্ষককে “বীর” হিসেবে আখ্যা দিয়ে উগ্র ইসলামপন্থীদের দেশের জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করেন। পরে রাষ্ট্রীয়ভাবে ওই কার্টুন প্রদর্শনও করা হয় ফ্রান্সে।

এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে ফ্রান্স বিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এসব বিক্ষোভে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন।

সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকেই তারা খুবই সতর্ক ছিল এবং এ বিষয়ে তাদের তদন্তের ফলসরূপ ১৫ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

এসব বাংলাদেশিদের বেশিরভাগই নির্মাণ শ্রমিক এবং তাদের বিরুদ্ধে “সহিংসতার উস্কানি বা সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা” তৈরির চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের গোয়েন্দাদের ভাষ্য, সন্দেহভাজন এসব লোকজন ফ্রান্সে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহিংসতা কিংবা ধর্মীয় অস্থিতিশীলতা উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

যদিও, এসব বাংলাদেশিরা ফেসবুকে ঠিক কি পোস্ট করেছিলেন, সে বিষয়ে কিছু জানায়নি সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র দপ্তর।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের বেশিরভাগ নাগরিক জাতিগতভাবে চীনা বংশোদ্ভুত।

দেশটিতে মুসলিমরা সংখ্যালঘু। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে অন্তত ৩ লাখ মানুষ সিঙ্গাপুরে শ্রমিক হিসেবে রয়েছেন।

আহমেদ ফয়সল
আহমেদ ফয়সল

এছাড়া সিঙ্গাপুরের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্রেইট টাইমস জানিয়েছে, সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে আহমেদ ফয়সাল নামে এক বাংলাদেশি যুবককে গ্রেফতার করেছে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ।

চলতি মাসের শুরুতে দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনে (আইএসএ) তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ইসলাম নিয়ে বিভিন্ন ভিডিও অনলাইনে প্রকাশ করেছিলেন বলে অভিযোগে বলা হয়।

২৬ বছর বয়সের বাংলাদেশি ওই যুবক ২০১৭ সাল থেকে দেশটিতে থাকছেন।

আজ মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সিঙ্গাপুরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনের আওতায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে সিঙ্গাপুরে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার সাতজন বিদেশির মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের আহমেদ ফয়সল। তাঁকে ২ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। সিঙ্গাপুরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তারা প্রাথমিক তদন্তে জেনেছেন, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের অনলাইন কর্মকাণ্ডে আকৃষ্ট হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন।

সিরিয়ায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ে শামিল হতে সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর। তাঁর বিশ্বাস, সিরিয়ায় যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ দিলে শহীদের মর্যাদা পাবেন।

গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, আহমেদ ফয়সল নজরদারি এড়াতে ছদ্মনামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে তিনি সশস্ত্র লড়াই আর সংঘাতের বিভিন্ন রকম পোস্ট দিয়েছেন।

২০১৯ সালের মাঝামাঝি থেকে সিরিয়ায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল জঙ্গি সংগঠন হায়াত তাহরির আল শামের (এইচটিএস) প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এইচটিএসের তহবিলে চাঁদাও দিয়েছেন ফয়সল।

এ ছাড়া তিনি আল–কায়েদা ও সোমালিয়ার আল–শাবাবের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীর সমর্থনে বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন।

আহমেদ ফয়সল সিঙ্গাপুরের গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তিনি দেশে ফিরে জঙ্গি হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের ছুরি কিনেছেন। তবে তিনি যে সিঙ্গাপুরে কোনো ধরনের সহিংস হামলার পরিকল্পনা করেননি, সে ব্যাপারে নিশ্চিত সেখানকার গোয়েন্দারা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম আজ সন্ধ্যায় জানান, সিঙ্গাপুর থেকে ১৫ বাংলাদেশি নাগরিক ফেরত পাঠানোর বিষয়টি সম্পর্কে তাঁরা জানেন না।
তবে গ্রেপ্তার ফয়সাল সম্পর্কে তাঁরা খোঁজখবর নেবেন। এই নামে একজন জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, সে সম্পর্কে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন আগেই। তখন থেকেই খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছিল।

এদিকে সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী কে শানমুগাম দেশটিতে এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, আহমেদ ফয়সলের বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের তদন্ত চলছে। সিঙ্গাপুরের স্ট্রেইট টাইমস পত্রিকা জানিয়েছে, ধর্মীয় পুনর্বাসন গোষ্ঠীর (আরআরজি) ষোড়শ বার্ষিক সেমিনারে কে শানমুগাম এ তথ্য জানান।