মূর্তি উপাসনার জন্য, ভাস্কর্য শিল্পের অংশঃ হাক্কানি আলেম সমাজ

হাক্কানি আলেম

ইসলামে ভাস্কর্য স্থাপনে কোনো বিধি নিষেধ নেই বলে মন্তব্য করেছেন হাক্কানী আলেম সমাজ নামে একটি সংগঠনের নেতারা।

তারা বলেন, ভাস্কর্য এবং মূর্তি দুটো আলাদা জিনিস। এ নিয়ে হেফাজতে ইসলাম জনগণকে বিভ্রান্ত করছে।

ইসলামের হেফাজতকারী হয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে হেফাজতে ইসলাম। তাদের হাতে ইসলামকে ছেড়ে দেয়া যাবে না।

এ সময় হেফাজতের সাবেক আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে সংগঠনটি হেফাজত করার বদলে লাঞ্ছনা করে কবরে পৌঁছে দিয়েছে বলেও অভিযোগ তোলা হয়।

রবিবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এ কথা বলেন।

তারা বলেন, এ জাতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার অংশ হিসেবেই তার ভাস্কর্য স্থাপন করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন কয়েকজন ধর্মীয় আলোচক।

আজিজিয়া বাসেতিয়া সুন্নিয়া আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মো. আব্দুল হাকিম চৌধুরী কাশিমপুরী বলেছেন, ‘ভাস্কর্য মানুষের পুরোনো শিল্পচর্চার মাধ্যম।

ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দেওয়া ঠিক নয়। মূর্তি উপাসনার জন্য। আর ভাস্কর্য হলো- শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির অংশ।’

পড়ুনঃ ভাস্কর্য নিয়ে কী বলছে ভাস্কর্য বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা? 

রোববার (১৩ ডিসেম্বর) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘হাক্কানি আলেম সমাজ’-এর ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

হাক্কানি আলেম সমাজের সংবাদ সম্মেলন
হাক্কানি আলেম সমাজের সংবাদ সম্মেলন

মো. আব্দুল হাকিম চৌধুরী বলেন, ‘ধর্মের পাশাপাশি প্রত্যেকটা জাতির কিছু নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে। আরবদেরও নিজস্ব সংস্কৃতি আছে রয়েছে।

আঙ্কারায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। তিন বছর আগে আঙ্কারা সফরের সময় ছবিটা তুলেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তার প্রোফাইল থেকে নেয়া।

বাঙালি হিসেবে আমাদেরও কিছু সংস্কৃতি আছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো সব মুসলিম দেশে ভাস্কর্য আছে। সৌদি আরবে বিভিন্ন প্রাণী, মানুষের অবয়ব ও দেহ কাঠামোর ভাস্কর্য আছে। এমনকি ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনিরও ভাস্কর্য আছে।

ভাস্কর্য
বিভিন্ন দেশের ভাস্কর্য

ইসলামী প্রজতন্ত্র পাকিস্তানে মোহম্মদ আলী জিন্নাহ এবং কবি ইকবালসহ বহু জনের ভাস্কর্য রয়েছে।’

পড়ুনঃ ভাস্কর্য নিয়ে কী বলছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন? 

সংবাদ সম্মেলনে মো. ইলিয়াস ইব্রাহিম বিক্রমপুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই ভাস্কর্য আছে।

প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্য আছে। কিন্তু এই ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার কথা কেউ কখনো বলেনি, বাধাও দেয়নি।

হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে কেউ কেউ সমাজে ফেতনা-ফ্যাসাদ তৈরি করতে চাচ্ছে।

ভাস্কর্য বিরোধী ফতোয়া দেয়া ব্যক্তিরাই মুক্তিযোদ্ধাদের বিধর্মী ও কাফের বলেছিল। ভাস্কর্যের মতো ছবি ও ইংরেজি শিক্ষাও হারাম বলা হয়েছিল। এমনকি পবিত্র হজে যাওয়ার সময় ছবি তোলা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছিলো।’

মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে গুটিকয়েক আলেম হুংকার দিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, জাতির জনককে অপমানজনক কথা বলা আমরা মানতে পারি না।

বঙ্গবন্ধু মুসলমান ছিলেন, আমরাও মুসলমান। ইসলাম অনুযায়ী বললে শালীনভাবে বলতে হবে।’

ভাস্কর্যের কয়েকটি দিক আছে। ভাস্কর্যের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দিক আছে। ধর্মীয় দিক থেকে বলতে গেলে, আমরা আমাদের ছোট শিশুদের পুতুল কিনে দিই।

সেটা কিন্তু ভাস্কর্যের অংশ বিশেষ। আমাদের প্রিয়জনদের ছবি আমরা ঘরে টানিয়ে রাখি, সেটাও ভাস্কর্যের অংশ।

হেফাজত ভাস্কর্য নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছে, তার মধ্যে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে।

তিনি আরও বলেন, ভাস্কর্য জায়েজ- এই কথা আমি বলছি না। কিন্তু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা তো ইসলাম সমর্থন করে না।

মামুনুল হকের পিতা আল্লামা শায়খুল হাদিসকে নিয়ে আমরা কওমি স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমরা তাকে কওমি জননী বললাম।

জননীর সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক হবে মধুর। আমাকে কিছু বললেও সংবাদ সম্মেলন করে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে মায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারি না।

কিন্তু আজকে হেফাজতে ইসলাম ইসলামের হেফাজতকারী হয়ে এরকম করছে। ’’

‘ইসলামের জায়গা থেকে আমরা বলব, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উদার অসাম্প্রদায়িক নীতিতে আমরা ধর্মকে পালন করব। ধর্ম দিয়ে আমরা জাতিসত্ত্বাকে বাধাগ্রস্থ করব না।

ধর্ম দিয়ে আমরা ফেতনা-ফাসাদ তৈরি করব না। ধর্মের দোহায় দিয়ে রাষ্ট্রে কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি করব না।’

সংবাদ সম্মেলনে তারা আরও বলেন, ভাস্কর্য অনেক সময় চেতনাকে বাড়িয়ে দেয়। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

পদ্মা সেতু যেটা আগে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি, সেটাও এখন বাস্তব। ভাস্কর্যকে উপাসনা করলে সেটা শিরক হবে।

আমরা তো মূর্তি পূজা করি না। মূর্তিকে ইবাদত করা হয়, ভাস্কর্যকে না।

এর আগে একইরকম বক্তব্য দিয়েছিলো সম্মিলিত ইসলামি জোট। তারা বলেছিলেন

মূর্তি বা ভাস্কর্য মানেই শিরকের উপকরণ নয়।

বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোট।

ঢাকার ধোলাইরপাড় চত্বরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ইসলামপন্থী বেশ কয়েকটি দল সেই পরিকল্পনার বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছে।

মামুনুল হক
মামুনুল হক

গত মাসে বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী এক সম্মেলনে ভাস্কর্য বিরোধী কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করার পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

হেফাজতের শীর্ষ ওই নেতার মন্তব্যের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা ভাস্কর্য তৈরির পক্ষে তাদের শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করেন এবং এই বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়ার ইঙ্গিতও দেন।

আন্দোলনকারী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেছিলেন, তারা ভাস্কর্য তৈরির বিপক্ষে কথা বলেই যাবেন।

“শান্তিপূর্ণভাবে আমরা আন্দোলন করবো। যেটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সেই জায়গা থেকে আমরা আমাদের ঈমানি দাবিটা জানিয়েই যাব, কথা বলেই যাব। সেটা সরকার রাখবে কি রাখবে না সেটা সরকারের বিষয়,” তিনি বলেন।

ভাস্কর্য নিয়ে আলোচনার মধ্যেই হাটহাজারিতে আয়োজিত মাহফিলে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হয়েছিল মামুনুল হককে। সেদিন

মামুনুল হককে চট্টগ্রামে প্রতিহতের ঘোষণা 

দিয়েছিলো ছাত্রলীগ ও যুবলীগ।

মিরসরাইয়ে ভাস্কর্য বিরোধীদের প্রতিহতের ঘোষণা ছাত্রলীগের
মিরসরাইয়ে ভাস্কর্য বিরোধীদের প্রতিহতের ঘোষণা ছাত্রলীগের

এছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ভাস্কর্য তৈরির পক্ষে কঠোর বক্তব্য দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অনভিপ্রেত ও উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য দিচ্ছে” এবং তিনি আরও বলেন তারা “ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রিয় মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ তৈরির চেষ্টা করছে”।

ভাস্কর্য ইস্যুতে শীর্ষ উলামাদের ব্যানারে ফতোয়া প্রদান
ভাস্কর্য ইস্যুতে শীর্ষ উলামাদের ব্যানারে ফতোয়া প্রদান

আরো পড়ুনঃ  ভাস্কর্য নিয়ে কী বলছে “দেশবরেণ্য শীর্ষ আলেমরা”?

ভাস্কর্য ইস্যুতে শীর্ষ উলামাদের ব্যানারে ফতোয়া

আরো পুড়ুনঃ হাক্কানি আলেম কারা?