ভাস্কর্য নিয়ে কী বলছে “দেশবরেণ্য শীর্ষ আলেমরা”?

বেফাকের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহমুদুল হাসান

ভাস্কর্য নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে বেশ কিছু ইসলামী চিন্তাবিদ ভাস্কর্য নিয়ে তাদের নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন।

যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের আয়োজনে শনিবার এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ‘দেশবরেণ্য শীর্ষ আলেমরা’ অংশ নিয়েছেন বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসায় বৈঠকের পর আলেমদের দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “মানবমূর্তি ও ভাস্কর্য যে কোন উদ্দেশ্যে তৈরি করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।”

তারা বলেছেন, “এমনকি কোন মহৎ ব্যক্তি ও নেতাকে মূর্তি বা ভাস্কর্য স্থাপন করে শ্রদ্ধা জানানো শরিয়তসম্মত নয়।”

বিবৃতিতে দেয়া তাদের প্রস্তাবে আলেমরা বলেছেন, কোন ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য “কুরআন-সুন্নাহ সমর্থিত কোন উত্তম বিকল্প সন্ধান করাই যুক্তিযুক্ত”।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি নির্মাণের পরিবর্তে আল্লাহর নাম খচিত ‘মুজিব মিনার’ নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন আলেমরা।

ভাস্কর্য নিয়ে দেশের চলমান অস্থিরতা ও জাতীয় সঙ্কট বিষয়ে আলেমদের করণীয় শীর্ষক বৈঠক বসে শনিবার (৫ ডিসেম্বর) সকালে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় সকাল ৯টায় দেশের খ্যাতনামা আলেমরা বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ভাস্কর্য ইস্যুতে ৫টি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আলেমরা।

এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে তার সাক্ষাৎ চান আলেমরা।

বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ড বেফাকের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও আল হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান।

বৈঠক শেষে বেফাকের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সারাদেশের খ্যাতনামা আলেমরা এ বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।

সবার মতামতের ভিত্তিতে ৫টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সেগুলো স্মারকলিপি আকারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরণ করা হবে। একইসঙ্গে একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, মানব মূর্তি বা ভাস্কর্য যে কোনও উদ্দেশে তৈরি করা ইসলামের দৃষ্টিতে কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। ৯২ ভাগ মুসলমানদের দেশে মানুষের বিশ্বাস ও চেতনার আলোকে কোরআন সুন্নাহ সমর্থিত উত্তম কোনও বিকল্প সন্ধান করাই উত্তম।

বিকল্প চিন্তা কী প্রশ্নের জবাবে মাহফুজুল হক বলেন, আমরাদের প্রস্তাব আল্লাহর ৯৯ নাম খচিত মুজিব মিনার নির্মাণ করা হোক।

সভায় স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন,
১. বেফাকের সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেব,
২. বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রধান মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী,
৩. জমিয়ত একাংশের চেয়ারম্যান মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস,
৪. বেফাকের খাস কমিটির সদস্য আল্লামা নুরুল ইসলাম জিহাদী,
৫. বি.বাড়িয়ার আল্লামা সাজিদুর রহমান,
৬. সিলেটের আল্লামা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ি,
৭. জামিয়া রাহমানিয়ার প্রধান মুফতি মনসুরুল হক,
৮. ফরিদাবাদ মাদরাসার মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস,
৯. জামিয়া ইউনুসিয়ার প্রধান মুফতি মুবারকুল্লাহ,
১০. গহরডাঙ্গা মাদরাসার মাওলানা রুহুল আমীন,
১১. ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমীর সৈয়দ ফয়জুল করিম,
১২. বরুণার পীর মুফতি রশিদুর রহমান ফারুক,
১৩. ঢালকানগরের পীর সাহেব মুফতি জাফর আহমদ,
১৪. বেফাকের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক,
১৫. বসুন্ধরা মাদরাসার মুহতামিম মুফতি আরশাদ রাহমানী,
১৬. খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক,
১৭. আরজাবাদ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া,
১৯. শাইখ যাকারিয়ার পরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ,
১৮. বারিধারা মাদরাসার মাওলানা নাজমুল হাসান,
২০. আফতাবনগর মাদরাসার মুহতামিম মুফতি মুহাম্মদ আলী,
২১. খুলনার মুফতি আব্দুল্লাহ ইয়াহইয়া।

আরও ছিলেন, মুফতি গোলাম রহমান, মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, মাওলানা আবু তাহের নদভি, মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভি, মাওলানা নুরুল হুদা ফয়েজি, মাওলানা নেয়ামত উল্লাহ ফরিদী, মাওলানা ড. মুশতাক আহমদ, মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, মুফতি আবুল খায়ের বিক্রমপুরী, মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু, মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান, মাওলানা মনজুরুল ইসলাম আফেন্দী, মাওলানা তাফাজ্জল হুসাইন নিয়াজী, মুফতি শামসুদ্দোহা আশরাফী, মুফতি নোমান কাসেমী, মাওলানা হোদায়াত উল্লাহ আজাদী, উত্তরার মাওলানা কেফায়েতুল্লাহ আযহারি, মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ্ আইয়ুবী, মাওলানা হাসান জামিলসহ অনেক ওলামায়ে কেরাম।

ঢাকার ধোলাইরপাড় চত্বরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ইসলামপন্থী বেশ কয়েকটি দল সেই পরিকল্পনার বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছে।

শুক্রবার কয়েকটি ইসলামপন্থী সংগঠনের ডাকা ভাস্কর্য বিরোধী বিক্ষোভ মিছিলটি ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে বের হবার পর পুলিশ সেটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

গত মাসে বাংলাদেশ হেফাজতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী এক সম্মেলনে ভাস্কর্য বিরোধী কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করার পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

হেফাজতের শীর্ষ ওই নেতার মন্তব্যের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা ভাস্কর্য তৈরির পক্ষে তাদের শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করেন এবং এই বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়ার ইঙ্গিতও দেন।

আন্দোলনকারী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক শুক্রবার বলেন, তারা ভাস্কর্য তৈরির বিপক্ষে কথা বলেই যাবেন।

“শান্তিপূর্ণভাবে আমরা আন্দোলন করবো। যেটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সেই জায়গা থেকে আমরা আমাদের ঈমানি দাবিটা জানিয়েই যাব, কথা বলেই যাব। সেটা সরকার রাখবে কি রাখবে না সেটা সরকারের বিষয়,” তিনি বলেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ভাস্কর্য তৈরির পক্ষে কঠোর বক্তব্য দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অনভিপ্রেত ও উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য দিচ্ছে” এবং তিনি আরও বলেন তারা “ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মপ্রিয় মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ তৈরির চেষ্টা করছে”।

আলেমরা আজ তাদের বৈঠকে আরও যেসব বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে তারা তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে “ইসলামের নবীর প্রতি অবমাননাকর আচরণের ওপর কঠোর নজরদারি ও দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের” দাবি জানিয়েছেন।

এছাড়াও তাদের আন্দোলনে অংশ নিয়ে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের নিঃশর্ত মুক্তিদান, তাদের বিরুদ্ধে হয়রানি বন্ধ ও দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানিয়েছেন।

সম্প্রতি ওয়াজ মাহফিল নিয়ে “শব্দ-দূষণের অজুহাতে লাউড স্পিকার ব্যবহারের ব্যাপারে নির্দেশনা জারি”কে তারা “অনভিপ্রেত” বলে উল্লেখ করেছেন।