নেপালে যা ঘটছে, আমাদের জানা-বোঝা জরুরি

আলী রিয়াজ

আলী রীয়াজঃ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বিষয়ে যারা আগ্রহী তাদের এখন চোখ রাখা দরকার নেপালের দিকে। নেপালে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে তার অন্তত তিনটি দিক আছে।

এর মধ্যে অবশ্যই একটি দিক হচ্ছে আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক। এই আঞ্চলিক দিকটি কেবল নেপালের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, বরঞ্চ তা এই অঞ্চলের সবগুলো দেশের জন্যেই প্রাসঙ্গিক।

নেপালে সংকটের সূচনা হয় ২০ ডিসেম্বর যখন প্রধানমন্ত্রী কে পি অলি আইনসভার নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার অনুরোধ করেন প্রেসিডেন্টের কাছে। প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারি সেই অনুরোধের প্রেক্ষিতে প্রতিনিধি সভা ভেঙে দেন।

অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট এই পদক্ষেপ নেওয়ায় তার ভূমিকা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেছে। অলির এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ হচ্ছে সংসদে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার চেষ্টা। এই প্রস্তাব কেন আসছিল?

কারণ ক্ষমতাসীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব।

তিন বছর আগে অলি’র নেতৃত্বাধীন অংশ, অন্যপক্ষ বা পুষ্প কমল দহাল প্রচণ্ডের নেতৃত্বাধীন, তার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একক কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে। কিন্তু নেতৃত্বের প্রশ্নে এক ধরনের টানাপোড়েন থেকেই যায়।

এই ঐক্য তৈরির অংশ হিসেবে সিদ্ধান্ত ছিল কে পি অলি ও পুষ্প কমল দহাল ভাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু, আড়াই বছর ক্ষমতায় থাকার পরে অলি ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান।

এতে করে দলের ভেতরে শুরু হয় টানাপোড়েন এবং অলি টের পান যে তার সময় ফুরিয়ে আসছে। সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে আদালতে একাধিক মামলাও হয়েছে।

এই পটভূমিকায় বিরাজমান সংকটের তিনটি দিক উঠে এসেছে।

প্রথম বিষয় হচ্ছে— সংসদ ভেঙে দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। ১৯৯১ সালের সংবিধানে সেই ব্যবস্থা ছিল।

ঐ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী চাইলেই সংসদ ভেঙে দিতে অনুরোধ করতে পারতেন। তিন দফা তা করাও হয়েছে; একবার আদালত তা নাকচ করে দেয়।

নতুন সংবিধান বলছে যে সংসদ ভেঙে দেওয়ার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ যথেষ্ট নয়, বিকল্প সরকার গঠনের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু, এক্ষেত্রে তা করা হয়নি।

ফলে আদালত চাইলে এখন এটা নাকচ করে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংসদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর অলি সরকারের পতন অনিবার্য। কিন্তু, আদালতের সিদ্ধান্ত যদি অলির অনুকূলে যায় তবে কী হবে?

তিনি অন্তর্বতী প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। কিন্তু, এপ্রিলের শেষে নির্বাচনের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সেই অবধি বিক্ষোভ চলবে।

ইতোমধ্যেই নেপালি কংগ্রেস ও মাধহেসি’দের দল– জনতা সমাজবাদী দল, প্রচণ্ডের সমর্থকদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তারা সংসদ ভেঙে দেওয়ার বিরুদ্ধে বললেও তারা চাইবেন যে, সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত অটুট থাকুক।

কেননা, এতে করে আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা গতবারের চেয়ে ভালো ফল করতে পারবে। কিন্তু, যেভাবেই দেখি না কেন নেপালে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার সূচনা হলো তা আগামী কয়েক মাস চলবে।

এপ্রিলে নেপালে বর্ষাকাল শুরু হয়। সেই কারণে নির্বাচন যদি পিছিয়ে যায় তবে অস্থিরতা আরও বেশি দিন চলবে।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে— কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন। ইতোমধ্যেই দুই পক্ষ পরস্পরকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করেছে। কমিউনিস্টদের ঐক্য নেপালে রাজনীতিতে যে ধরনের পরিবর্তনের আশাবাদ তৈরি করেছিল এখন তা বড় ধরনের ধাক্কা খাবে।

এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে দুই-তৃতীয়াংশ আসন আছে, কিন্তু আগামী নির্বাচনে তা থাকবে সেটার নিশ্চয়তা নেই। এই বিভক্তি নেপালি কংগ্রেসের ভাগ্য বদলের সুযোগ করে দিতে পারে। জনতা সমাজবাদী দলও আশা করে যে তারা আগামীতে ভালো ফল করবে।

যে সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না তা হচ্ছে ‘কিং মেকার’ হিসেবে নেপালি কংগ্রেসের উত্থান।

তৃতীয় বিষয় হচ্ছে— এই সংকটের আঞ্চলিক গুরুত্ব। নেপালে কমিউনিস্টদের ভাঙন ঠেকাতে চীন প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে।

চীনের রাষ্ট্রদূত হোউ ইয়ানকি (Hou Yanqi) ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তা গুয়ো ইয়েঝু (Guo Yezhou) দুই পক্ষের মধ্যে বিভক্তি মোচনে কাজ করছেন। চীনা রাষ্ট্রদূত ইতোমধ্যেই নেপালের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছেন।

চীন এতটা প্রত্যক্ষভাবে আগে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেনি।

নেপালে ২০১৫ সালের পর থেকে চীনের প্রভাব যে কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং চীন যে সেই বিষয়ে রাখঢাক করতে রাজি নয় এখনকার ঘটনাগুলো তার প্রমাণ।

২০১৫ সালে নেপালের ওপর দ্বিতীয়বারের মতো ভারত যখন অবরোধ আরোপ করে তা নেপালে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত করে দেয়।

ভারত তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে তাতে করেই চীনের পক্ষে এই ধরনের প্রভাব বিস্তার সম্ভব হয়েছে সেটা ভারতের নীতিনির্ধারকরা বুঝতে না চাইলেও বাস্তবতা হচ্ছে তাই। এর জন্যে চীনের আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি একমাত্র কারণ নয়।

নেপালের এই ঘটনাপ্রবাহ ব্যতিক্রম নয়। শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন চীনের প্রভাব পুনরুদ্ধার করেছে। সম্প্রতি, শ্রীলঙ্কা দুটি অবকাঠামো প্রকল্পের বিষয়ে জাপানের সঙ্গে যুক্তি বাতিল করে দিয়েছে।

অনুমান করা হচ্ছে এই সব প্রকল্পে পরে চীনের অর্থায়ন ঘটবে। তাছাড়া শ্রীলঙ্কায় চীন ৩০০ মিলিয়ন ডলারের একটি টায়ার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে সম্প্রতি।

শ্রীলঙ্কায় চীনের এই প্রভাবের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যে উদ্বেগ আছে সেটি সম্প্রতি কংগ্রেসে পাশ হওয়া করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিল যাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯০০ বিলিয়ন ডলার তাতেই বলা হয়েছে। এই বিলে বিভিন্ন দেশকে দেওয়া মার্কিন সাহায্যের বিষয় আছে।

এতে বলা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নির্ভর করছে যে সব বিষয়ের ওপর তার মধ্যে আছে, চীনের প্রভাব থেকে তার সার্বভৌমত্ব জোরদারভাবে প্রয়োগ করা।

মালদ্বীপে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতের অনুকূলে এবং ৫০০ মিলিয়ন ডলারের সেতু প্রকল্প চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর প্রভাব কমানোর চেষ্টা। কিন্তু, চীনের বিনিয়োগ সেখানে কমেনি।

গত কয়েকদিন যাবৎ বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার এবং ভারতের সঙ্গে কিছুটা টানাপোড়েনের কথা শোনা যাচ্ছে।

ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের চটজলদি সফর, বাংলাদেশে চীনা কোভিড-১৯ টিকার পরীক্ষা শেষ মুহূর্তে বাতিল, চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল উই ফেঙ্গের ঢাকা সফর শেষ মুহূর্তে বাতিলের ঘটনা এখনো ভারতের শক্তিশালী প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়।

ভারত সম্ভবত এই আশা করছে যে, নেপালে কমিউনিস্টদের বিভক্তি নেপালি কংগ্রেসকে আগামী নির্বাচনে সুবিধা দেবে এবং দলটি ক্ষমতার ক্ষেত্রে ‘কিং মেকার’ হয়ে উঠলে ভারত আবার আগের জায়গায় যেতে পারবে।

কিন্তু, সেই পর্যন্ত ভারতের সীমিত প্রভাবকে তাদের মেনে নিতে হচ্ছে। তবে সেটা আগামীর বিষয়। এখন যা দৃশ্যমান তা হচ্ছে নেপালে অব্যাহতভাবে চীনের প্রভাব বাড়ছে। সে কারণেই নেপালের রাজনৈতিক সংকটে কেবল নেপালিদের নয়, ভারত ও চীনের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ জড়িত।

আর যারা দক্ষিণ এশিয়ায় আছেন এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেন তাদের দরকার গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে নেপালের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করা।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।