দেড় বছর বয়সেই বাবাকে হারাই, মা কোনো চাওয়াকে অপূর্ণ রাখেননি।

ডাঃ নুজহাত তাবাসসুম পরমা

আমার জীবনটা কখনোই সহজ ছিলনা। খুব ছোট থাকতে আমি আমার বাবাকে হারাই, আমার বয়স তখন মাত্র দেড় বছর।

মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে আমার মা সবকিছু হারিয়ে বসেন। আমি ছাড়া মায়ের তখন আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা এবং তবুও তিনি তার সকল সাহস ও ইচ্ছাশক্তি এক করে আমাদের সামনে যে কঠিন দিনগুলি অপেক্ষা করছিল তার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন।

মায়ের সাথে নানাবাড়ি চলে গেলাম। একটি চাকরির খোঁজ করা ছাড়া মায়ের সামনে আর কোন পথ খোলা ছিলনা এবং তখনকার পরিস্থিতিতে একটা চাকরি পাওয়া মোটেও সহজ কাজ ছিলনা।

শেষ পর্যন্ত মায়ের একটা চাকরি হয় কিন্তু পোস্টিং হয় কুষ্টিয়ায়। কান্না চেপে মা তার কর্মস্থলে চলে যান, তার ছোট্ট মেয়েটাকে নিজের মা বাবার কাছে রেখে।

এত ত্যাগ স্বীকার করার একটাই কারণ, আমি যেন যতদূর সম্ভব একটা স্বাভাবিক শৈশব পাই।

আমার নানা নানী ও মামা মামীরা শুরু থেকেই আমার জন্য অনেক করেছেন।

মামারা আমাকে নিজের মেয়ের মত করে বড় করেছেন ও আমাকে কোন কিছুর অভাব কখনোই বুঝতেই দেননি।

মাকে যদিও অনেক কষ্ট করে চলতে হতো,কিন্তু তিনি কখনোই আমার কোন চাওয়াকে অপূর্ণ রাখেননি।

আমাকে তিনি আর্ট স্কুলে পাঠিয়েছেন,টিচার রেখে গান শিখিয়েছেন এবং আমি যখন যা চাইতাম, সেটা হোক কোন জামা কিংবা খেলনা, মা কখনোই আমাকে না বলেনি।

ছোটবেলায় কখনোই বুঝিনি মা কিভাবে এত সব করতেন কিন্তু বড় হবার পর বুঝেছি আমার মুখে হাসি ধরে রাখতে তিনি কত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গিয়েছেন।

ক্লাস সিক্স পর্যন্ত আমি ভিকারুন্নেসা নূন স্কুলে পড়েছি। এরপর আমি আর মা দুইজন মিলেই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে ক্যাডেট কলেজে চলে যাওয়াটাই আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে।

পরীক্ষা দিতে বসলাম ও চান্স পেয়ে গেলাম ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজে। জীবনে দ্বিতীয় বারের মত আমি আবার নতুন এক পরিবারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।

দেখতাম যে অনেকেরই প্রথম প্রথম সেখানে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয় কিন্তু আমার বেশী সময় লাগেনি কেননা আমি যে মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে অনেক আগে থেকেই শিখে গিয়েছি।

কিন্তু ক্যাডেটের এই নতুন পরিবারের সাথে আমার চিরস্থায়ী ভালবাসা ও বিশ্বাসের একটি সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় যা যেই পরিবারকে ছেড়ে এসেছি তার তুলনাই কোন অংশেই কম ছিলনা।

ক্যাডেট কলেজের দিনগুলি আমার জন্য খুবই স্মরণীয় ছিল। প্রতি বছর ‘ইন্টার ক্যাডেট কলেজ লিটারারি এন্ড মিউজিক মিট’ নামে একটি ইভেন্ট হত যেখানে সব ক্যাডেটের ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিত।

যদিও স্কুলে থাকতেই গান ও পেইন্টিং শিখেছিলাম কিন্তু কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার সুযোগ কখনো হয়নি।

এবার একটা সুযোগ পেলাম এবং খুবই অবাক হয়ে দেখলাম যে অয়েল পেইন্টিং ও ক্লাসিক্যাল মিউজিকে আমি একটার পর একটা পুরস্কার জিতে যাচ্ছি।

পড়াশোনার ক্ষেত্রেও নিরাশ হতে হয়নি, আমাদের ব্যাচে সেরা ফলাফলের জন্য আমাকে ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ থেকে ‘বেস্ট একাডেমিক এওয়ার্ড’ দেয়া হয়।

এডমিশন টেস্টের পর আবার সময় হলো আরেকটি নতুন পরিবারে যাবার। ঢাকা মেডিকেলে আমি যে পরিবারটিকে পেয়েছি তারা আগের সবার মতই স্নেহপরায়ণ।

এখানে পাঁচটি স্মরণীয় বছর কাটিয়ে এখন ইন্টার্নশিপ করছি। কিছুদিন আগে ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষায় ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হওয়ায় লেট ডা. তন্ময় বোস মেমোরিয়াল ফান্ড থেকে ‘একাডেমিক স্কলার এ্যাওয়ার্ড ‘ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ অ্যালামনাই ট্রাস্ট হতে স্বর্ণপদকে আমাকে সম্মানিত করা হয়।

এই অর্জনে একজন চিকিৎসক হিসেবে রোগীদের প্রতি আমার দায়িত্ব বহুলাংশে বেড়ে গেছে বলে আমি মনে করি কেননা আমার চেয়ে ভাল আর কে জানে প্রিয়জনকে হারাবার কষ্ট কতখানি।

সারা জীবন ধরেই আমি নতুন নতুন পরিবার খুঁজে পেয়েছি এবং রোগীদেরও আমি আমার পরিবারের মতই মনে করি।

সবার কাছ থেকে আমি যে পরিমাণ ভালবাসা পেয়েছি তাতে আমার নিজের পরিবার হারানোর কষ্ট অনেকাংশেই লাঘব হয়েছে এবং একজন চিকিৎসক হিসেবে এটা আমার কর্তব্য যে আমি যে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে গিয়েছি, সেই যন্ত্রণা যেন আর কাউকে না পেতে হয়।

ডাঃ নুজহাত তাবাসসুম পরমা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (কে-৭০)
সেশনঃ ২০১২-২০১৩