নটরডেম এর স্যার বলেছিলেন আর্টস এ চলে যেতে, সাইন্সে পড়ার যোগ্যতা নেই

অাজরফ নাজমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (কে-৭৫) সেশনঃ ২০১৭-২০১৮

ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়াটা আমার জন্য ছিল স্বপ্নের চাইতেও বেশি কিছু।

আমি বরাবরই খুবই সাধারণ মানের ছাত্র ছিলাম। স্কুল জীবনটা শুধু খেলাধুলা করেই পার করেছি।

তাই হয়তো ফলাফলটা সন্তোষজনকের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করত,মাঝে মাঝে তারও একটু নীচে।

তবে ধাক্কা খাই আমি নটরডেম কলেজে ভর্তি হবার পর। কলেজেও যথারীতি যেমনভাবে এতদিন চলে এসেছি সেভাবেই চলতে লাগতাম।

সারাদিন খেলতাম, ক্লাস করেছি কমই। ফলাফলটাও হাতেনাতে পাই। ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষায় ফিজিক্সে পাই ৪০ এ ৯, কেমিস্ট্রিতে ৩০ এ ২।

আমার এই অবস্থা দেখে প্র‍্যাক্টিকাল ক্লাসে এক শিক্ষক বলে বসেন যে আর্টসে চলে যেতে, আমার সায়েন্সে থাকার যোগ্যতা নেই।

কলেজে থাকার সময় এমন কোন শাস্তি নেই যা খাইনি। অ্যাটেন্ডেন্স কম থাকার কারণে কলেজ মাঠে ঘাসও কাটতে হয়েছে।

আমার বোধোদয় হয় টেস্ট পরীক্ষার পর। আমার মাও ডাক্তার, আমি যখন পেটে তখন মা ডিএমসিতেই পোস্টেড ছিলেন।

ছোট থেকেই আমাকে বলতেন ডাক্তার হবার জন্য। মায়ের ইচ্ছাটাকে কখনোই তেমন গুরুত্বের সাথে দেখা হয়নি, কিন্তু এবার ভাবলাম যে চেষ্টা করে দেখি।

টেস্ট পেপার কিনে নিয়ে আসি কিন্তু দেখলাম যে আমি তেমন কিছুই জানিনা বা পারিনা। তখন বুঝলাম যে আমার পড়াশোনায় কতখানি কমতি আছে, কত ফাঁকি দিয়েছি এই কয় বছর।

আমি সবকিছু বাদ দিয়ে দিলাম। আমার তখনকার যে অবস্থা, তাতে ভাবলাম কোন কোচিং করে বা মডেল টেস্ট দিয়ে তেমন লাভ হবেনা।

আমার নিজেকে নিজেরই তৈরি করতে হবে। প্রত্যেকটি বিষয় আমার নতুন করে পড়া শুরু করলাম। কোন কিছু না বুঝলে ইউটিউবে ভিডিও দেখে শিখতাম।

ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য নিজের লাইফস্টাইল সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে ফেলি। খেলাধুলা সম্পূর্ণ বাদ দেই, সব ধরণের সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেই। এই আট-নয় মাস অমানুষিক পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।

ভর্তি পরীক্ষার দিন ছিল শুক্রবার, জুম্মার নামাজে মোনাজাতের সময় আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। জীবনে আমি কোন কিছুর জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করিনি, কোন কিছু এভাবে চাইনি।

স্রষ্টার কাছে এটাই চেয়েছিলাম যাতে উনি আমার পরিশ্রমের যথার্থ ফলাফল দেন। পরীক্ষার পরের তিন দিন আমি রোজা রাখি।

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় আমি ৭০তম হই। আমার নিজের চাইতেও মায়ের জন্য বেশি খুশি হয়েছিলাম।

আমি কখনোই মায়ের জন্য কিছু করতে পারিনি,এই প্রথম কিছু একটা করলাম যার জন্য উনি আমাকে নিয়ে গর্ব করতে পারেন।

আমি জীবনে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা পেয়েছি তা হলো যে পরিশ্রম করলে আর ইচ্ছা শক্তি থাকলে যেকোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব।

আমি কখনোই আমার ক্লাসমেটদের মত মেধাবী ছিলাম না। তাই আমার ব্যবধানটা কমিয়ে আনতে হয়েছে পরিশ্রমের মাধ্যমে। যে চেষ্টা করে, সে কখনোই হারেনা।

কলেজে একবার পরীক্ষার খারাপ করার কারণে স্যার ক্লাসে আমাকে দাঁড়া করিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ রেসাল্ট খারাপ করার জন্য দাঁড়ালে,নিজেকে এমনভাবে তৈরি করো যেন একদিন রেসাল্ট ভাল করার জন্য দাঁড়াতে পারো।’

স্যারের কথাটি আমাকে সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছে। সাফল্য কোন দুর্ঘটনা নয়, এটি কখনোই হঠাৎ করে বা কপালজোড়ে আসেনা।

সাফল্যের জন্য দরকার একাগ্রতা,ত্যাগ, লেগে থাকা এবং সর্বোপরি তুমি যা করছো সেই কাজটার জন্য ভালবাসা।

আমরা যদি নিজের অপার ইচ্ছাশক্তির উপর আস্থা রাখতে পারি, তাহলেই দেখবো যে সাফল্যের পথে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি।

অাজরফ নাজমি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (কে-৭৫)
সেশনঃ ২০১৭-২০১৮

©Humans of DMC