বই এর একটা ম্যাথ ও বাদ দিতাম না, প্রতিপাদন যেটা কখনোও আসত না ওটাও বুঝতে ইচ্ছা করতো

মায়মুনা ভূইয়া মুন

ছোটবেলা থেকেই বুঝে গিয়েছিলাম আমার জন্ম এমন একটি পরিবারে যেখানে কোন ছেলেমেয়ে ভেদাভেদ নেই, তাই আমরা ২ জন মেয়ে সত্ত্বেও আব্বু আম্মুর মুখে চিন্তার ভাজ দেখি নি।

তবে ৪ জনের ছোট্ট এই পরিবারের বাইরেও তো একটা সমাজ আছে, সেখানে কিছু অতি শিক্ষিত মানুষ খোটা দিতে ভুলত না, “ভাই মেয়েই ২ টা!! ছেলে নাই? বুড়া হলে দেখবে কে? মেয়ে তো একদিন…..” বাকি ডায়ালগ আমাদের সবার ই জানা।

তবে আব্বু আম্মু যে কথা গুলো গায়ে লাগাতো না বুঝতাম, বলত মেয়েকে ইনশাল্লাহ ডাক্তারি
পড়াবো “সরকারি তে চান্স না পেলে অতো সুবিধা করতে পারবেন না আর সরকারি তে পাওয়াও এত সোজা না”

এসব কথা শুনে শুনেই যখন এস এস সি দিব তখন থেকেই ইচ্ছা ডক্টর ই হব, সরকারি ভাবেই।

তবে এই সিদ্ধান্তে উপহাসের পাত্রী হয়েছি, প্রায়ই মনে পড়ে একজন স্যার বলেছিলেন,” এলাকার চারপাশে একটু তাকাও।

একটা ছাত্রী এনে দাও তো যে সরকারী ভাবে মেডিকেল এ পড়ছে,আচ্ছা তুমি কি জানো যারা তোমার সাথেই চান্স পাবে তারা অনেক আগে থেকেই অনেক কিছু জানে কারণ তাদের আশেপাশে চান্স পাওয়া ছাত্র ছাত্রী অনেক।

স্বপ্ন টা ভালো তবে এই মফস্বল থেকে এর আগে পায় নাই, ঢাকার এত্ত বড় বড় স্কুল কলেজ থাকতে এই এলাকা থেকে পাবা চান্স?”
চিন্তার শুরুতেই ভেঙে দেয়া।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা যেই মফস্বল এ সেখানে আসলেই ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে খুজলেও সরকারি মেডিকেল এর কাউকে পাব কিনা সন্দেহ
থাকলেও কখনো শুনি নি, খুজেছি অনেক।

বাবা মা চোখের আড়াল করতেন না তাই কলেজ স্কুল কাছের টা তেই পড়তাম, বড় স্কুল কলেজের জন্য দূরে দেন নি কখনো।

আত্মবিশ্বাস হারাতাম যখন আশেপাশে কাউকে উদাহরণ হিসেবে পেতাম না। এমন কি কলেজ এ ফার্স্ট ইয়ার থেকেই অনেক খুজতাম বড় ভাই বোন যাদের থেকে কিছু হলেও সাজেশন নেয়া যায়। এমন কি প্রাইভেট মেডিকেল শুনলেও অস্থির হয়ে যেতাম কখন একটু কথা বলব

প্রায় প্রতিদিন ই একা আমার প্রিয় জায়গাটায় (কলেজের বারান্দা) দাঁড়িয়ে ভাবতাম কেন পারব না? আমার কলেজ কোনটা, আশে পাশে কে চান্স পেল সেটা কখনোই কোন ফ্যাক্ট হতে পারে না, ফ্যাক্ট এইটাই যে আমি কত টা জানি
তাই শুধু জানার চেষ্টা করতাম এমন কোন ধৈয্যশীল টিচার নেই যে একদিন এর জন্যও আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বিরক্ত হন নি
হ্যা আমার এলাকার অনেকেই চেষ্টা করেছে পারে নাই, আমি তো করতেই পারি।

একটা সময় চিন্তা টা এমন হয়ে গিয়েছিল যে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং আর ভার্সিটির কথা ভেবে না সব জানতে হবে ব্যস।

বই এর একটা ম্যাথ ও বাদ দিতাম না, প্রতিপাদন যেটা কখনোও আসত না ওটাও বুঝতে ইচ্ছা করতো, আর যাকেই পেতাম মেডিকেল কোচিং করত তার থেকে বইয়ের লিস্ট নিতাম, বাসায় গিয়ে গিয়ে বিরক্ত করতাম, প্রশ্ন দেখতাম।

চেষ্টা করেছিলাম সত্যি এলাকার কথা ভেবে এলাকাকে কিংবা দূরে দেয়ার ভয়ে ঢাকার সেরা কলেজে কেন ভর্তি করায় নি তা নিয়ে বাবা মাকে দোষ দেয়ার সময় ছিল না

বাবা মা যথেষ্ট অনুপ্রেরণা দিতেন, আত্মবিশ্বাস তারাই বাড়াতেন এবং কখনো কম নাম্বার এর জন্য বকেন নাই একদিন ও না

অবশেষে সেই দিন টা এসেই গেল যেই দিন আল্লাহ নিজ হাতে আমায় বেছে নিলেন আর ডক্টর হওয়ার একটা সুযোগ দিয়েই দিলেন।

আজ সেই অতি শিক্ষিত মানুষ রা নিজেরাই বাবাকে বলে ছেলে দিয়ে আর কি হবে রশিদ ভাই
সন্তান পড়াশোনা করে বড় হলে ছেলে আর মেয়ে নাই আর সেই টিচার এখন সামনে পেলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে আসলে পড়াশোনা টা নিজের স্কুল কলেজ কি আর কোনো বিষয়?

আমি মায়মুনা ভূইয়া মুন ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা টংগীর ছোট্ট একটি এলাকায়।
আব্বু আম্মু এখন স্বপ্ন দেখে অনেক বড় ডক্টর হব বিশ্বজুড়ে নাম হবে।

যা হোক স্বপ্ন দেখতে তো আর ক্ষতি নেই, যেই অবস্থাতেই থাকি হোচট খেতেই পারি, আটকে যেতে হবে?

উঠে দাড়াব, হতাশ হওয়ার অভ্যাস অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি।
আল্লাহর উপর ভরসা করে চেষ্টা করে যাব
শুধু দোয়া চাই, আর দোয়া করি সবার ভালো স্বপ্ন গুলো পূরণ হোক।

মায়মুনা ভূইয়া মুন
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ (Sh-13)