তিমিরাচ্ছন্ন গ্রাম থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল!

“আমি সবসময় চেয়েছি ডাক্তার হতে। কিন্তু আমি যেখানের থেকে এসেছি, আমার জন্য এই স্বপ্ন নিয়ে স্বপ্ন দেখাও ছিল বোকামি।

“আমি খুব দরিদ্র পরিবাবের সন্তান। আমার বাবা পেশায় একজন কৃষক, তবুও তিনি সবসময়ই চেয়েছেন আমি ডাক্তার হবো। আমাদের গ্রামের অবস্থা খুবই করুণ। সেখানে অধিকাংশ লোকজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাই শিক্ষা দীক্ষার ব্যাপারে তারা উদাসীন এবং শিক্ষিত লোকজন আমাদের গ্রামে নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ লোকজনই পেশায় কৃষক বা শ্রমিক। আমার বয়সের ছেলেরা ছোটবেলায়ই পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়ে শেষ পর্যন্ত নেশাগ্রস্ত হয়ে বিপথে চলে যায়। অনেকটা চোরাবালির মত আমাদের গ্রাম। সবাই আটকিয়ে যায় এবং কেউ বের হতে পারে না।”

“আমার পড়ালেখার প্রতি আগ্রহের কারণে বড় হয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে, অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু তা আমাকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি। আমাদের উপজেলা আমিই প্রথম পঞ্চম শ্রেণীতে পেয়ে বৃত্তি পেয়েছিলাম। আমি অষ্টম শ্রেণীতেও বৃত্তি পাই। ক্লাস নাইনে যখন উঠি, আত্মীয় স্বজন সবাই আমাকে সায়েন্স নিতে নিষেধ করে। আমাদের এলাকায় হাতে গোনা কয়েকজন সায়েন্স নিয়ে পড়ালেখা করেছে এবং সবাই মনে করে আমার বাবার মত একজন কৃষকের ছেলে সায়েন্স পড়ে কিছু করতে পারবে না। আমি সবার কথা অগ্রাহ্য করে স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। আমার বাবা মা আমাকে নিয়ে গর্বিত ছিলেন। যখনই আমার বাবাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হত, তিনি সবসময় বলতেন ‘আমার ছেলে নবীর ডাক্তারি পড়ছে’, বিজ্ঞান বলতে তিনি এটাই বুঝতেন,মানুষ তার কথা শুনে হাসাহাসি করতো এবং সবাই তাকে নিয়ে উপহাস করতো। যখনই এটা আমি দেখতাম, এটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আমি জিদ ধরি আমাকে ডাক্তার হয়ে ওনার স্বপ্নটাকে পূরণ করতে হবে।”

“নবিনগর পাইলট হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর আমাদের পরিবার অনেক খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল এবং আমাকে বলা হয়েছিল, আমি আর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবো না। আমার বাবা আমাকে একটি শর্ত দিয়েছিলেন যে,আমাকে নটরডেম কলেজে ভর্তি হতে হবে এবং আমি লিখিত পরীক্ষায় পাস করেও মৌখিকে উত্তীর্ণ হতে পারি নি। খুব হতাশায় পড়ে গিয়েছিলাম তখন। আমার খুব কাছের একজন বড় ভাই ছিলেন, মফিজুর ইসলাম। তিনি আমাকে ভাইভা পরীক্ষার কয়েকদিন পরে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে ঢাকা সিটি কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমি প্রথম বর্ষ পর্যন্ত ওনার সাথে ছিলাম এবং দ্বিতীয় বর্ষে মেসে উঠি। ওনার সাহায্য ছাড়া আমি এতদূর আসতে পারতাম না।আমি আমার পুরো উচ্চমাধ্যমিকে এ কখনো কোন প্রাইভেট পড়িনি।”

“এইচএসসি পাস করার পর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিলাম এবং আর্মডফোর্সেস মেডিকেলে সুযোগ পেলাম,আমি আমার বাবাকে বললাম এবং তিনি অনেক খুশি হলেন।কিন্তু আমি জানতাম না আর্মডফোর্সেস মেডিকেলে ভর্তি হতে অনেক টাকা লাগে এবং আমরা এই টাকা জোগাড় করতে পারলাম না। তাই আমার বাসায় ফিরে যেতে হয় এবং ফিরে গিয়ে আমার দ্বিতীয় বার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।”

“সে সময়টা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের এবং ধৈর্যের, কিন্তু আমি কখনো হার মানি নি। এবং আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। আমি আমার বাবাকে ফোন করলাম এবং তিনি বিশ্বাস করলেন না, তিনি বললেন “তুমি আগের বারও চান্স পেয়েছিলে তখন তো কিছুই হয়নি”। কিন্তু এইবার আমি ভর্তি হবই। বাবার একটা জমি বন্দক দিয়ে আমি টাকা নিয়ে ভর্তি হয়ে আসলাম। আমি ভর্তির কাগজ গুলো দেখালাম বাবাকে এবং তারপরেই তিনি বিশ্বাস করলেন।“

“আমরা ৫ ভাই ৩ বোন। ৫ ভাইয়ের মধ্যে আমি ৩য়, আমার বাবা একা আমাদের পুরো পরিবারের খরচ বহন করেন। আমরা ভাইয়েরা মিলে তাকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করি, কিন্তু তাকে দৈনিক ১৬ ঘণ্টা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হয়। আমি আমার বাবাকে কখনো নতুন কাপড়চোপড় পরতে,কিংবা আমাদের আগে খেতে দেখি নাই, কিন্তু আমি দেখেছি বাবাকে সারারাত বিলে মাছ ধরতে আমাদের জন্য। এখনো,আমি যখন বাড়িতে যাই,আমি তাকে হালচাষ করতে ও মাছ ধরতে সাহায্য করি।আমি ছোটবেলা থেকে এসব করেই বড় হয়েছি এবং এটাই আমার পরিচয়।আমরা সবসময় আর্থিকভাবে চাপের মুখোমুখি ছিলাম,কিন্তু আমার বাবা কখনো ভেঙে পড়েন নি,অনেক বড় বাধার সম্মুখীন হয়েও।“

“এখন আমি মেডিকেলে পড়াশোনা করছি সাথে আমার পরিবারের দেখভাল করতে হয়।মেডিকেলে ভর্তি হবার পর থেকে আমি আমার পরিবারের কাছ থেকে এক টাকাও নেই নাই। আমি দুইজন ছাত্রকে বাসায় গিয়ে পড়াই,যা পাই তা দিয়ে নিজের খরচ চালাই ও বাকি টাকা বাসায় পাঠাই।আমি শুধু এটাই চাই যে আমার ছোট ভাইয়েরা যেন তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে এবং ভালো মানুষ হতে পারে। এখন এই দায়িত্বগুলো আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে,আমাকে আমার বাবার জায়গাটা নিতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে আমাকে টাকা জমানোর জন্য না খেয়ে থাকতে হয়,আমার বাবা যখন ফোন দেয়,আমি তার কাছে মিথ্যা বলি যে আমি গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছি। আগে কখনো মিথ্যা বলি নাই বাবাকে”

“চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ আমার ২য় পরিবারের মত। আমি এখানে অনেক আপন বন্ধুবান্ধব পেয়েছি, কিন্তু পাশ করে বের হওয়ার পর আমি আমার বাড়িতেই ফিরে যেতে চাই। আমার মা বাবা আমাকে বলেছেন,যে আমার আগে তাদের একজন পুত্রসন্তান হয়েছিল,যে তার জন্মের কয়েক মাস পরেই মারা যায়। তার খুবই সাধারন একটা রোগ হয়েছিল, কিন্তু আমাদের গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল এবং তখন আরো দুরবস্থা ছিল। আমার খুবই খারাপ লাগে যে আমার একটা বড় ভাই ছিল যে কিনা শিশু অবস্থায়ই মারা যায়, তাই আমার ইচ্ছা যে আমি একজন শিশু বিশেষজ্ঞ হব।আমি একজন শিশু বিশেষজ্ঞ হয়ে অসহায় মানুষকে সাহায্য করার স্বপ্ন দেখি।”

“কখনো কখনো নিজের খেয়াল রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু তাই বলে কখনো আশা হারানো যাবে না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদের সবার ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমাদের পথ ঠিক করে রেখেছেন। আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সামনে সব অন্ধকার থাকলেও আমরা আশা হারাতে পারবো না। ইনশাল্লাহ আমি যখন ডাক্তার হব,আমি আমার বাবার নামে একটি হাসপাতাল বানাবো। আমি আমার বাবার কাছে চিরঋণী।”

নবীর হোসেন
৫৭তম এম বি বি এস
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
©Humans of CMC