বাংলাদেশের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং এর পথিকৃৎ ড. আব্দুর রশীদ আর নেই

বুয়েট মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক প্রফেসর ইঞ্জিনিয়ার ড. আব্দুর রশীদ সরকার, চেয়ারম্যান, ঢাকা ওয়াসা এবং চেয়ারম্যান, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, গতকাল ১০ই সেপ্টেম্বর, সকালে দীর্ঘদিন করোনায় জনিত সমস্যায় ভোগে ইন্তেকাল করেছেন।

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

সদা হাস্যোজ্জ্বল ও বিনয়ী স্বভাবের মানুষটি ছিলেন তার অসংখ্য ছাত্রের অনুপ্রেরণার উৎস।অসম্ভব মেধাবী এই লোকটি ছিলেন ঠিক বইয়ের ভাষায় পিতৃতুল্য শিক্ষকের মতো।

ছাত্রছাত্রীদেরকে তাদের রেজাল্ট দ্বারা বিবেচনা না করে তাদের ভিতরে সমূহ সম্ভাবনা গুলো স্যার খুব সহজেই অনুমান করতে পারতেন।

স্যার ছিলেন নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং এর একজন পথিকৃৎ। বুয়েট সহ বাংলাদেশ সরকারে নিউক্লিয়ার ব্যবস্থাপনায় স্যার জড়িত ছিলেন।

স্যারের মৃত্যুতে দেশ বিদেশে থাকা অসংখ্য ছাত্রছাত্রী শোক প্রকাশ করে স্যারের সাথে তাদের স্মৃতিচারণ করেন।

সেন্টার ফর এনার্জি স্টাডিজ, বুয়েট এর পরিচালক ফারসিম মান্নান মোহাম্মদী লিখেন-

রশীদ স্যার মারা গেলেন। দীর্ঘদিন তিনি করোনার সাথে যুদ্ধ করছিলেন। স্যার বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক ছিলেন, বুয়েটের নিউক্লিয়ার এঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন, এবং বুয়েটের শক্তি ও জ্বালানি কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন। তিনি ওয়াসার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।

স্যারের সাথে আমার ঠিক কীভাবে পরিচয় হয়েছিল সেটা আমার মনে নাই। তবে বুয়েটে ক্যারিয়ার উইক করতে গিয়ে ছাত্রকল্যাণ পরিচালক প্রফেসর আমিনুল হক স্যারের নেতৃত্বে যে টিম হয়েছিল, সেখানে স্যারের নির্দেশে কাজ করতে গিয়ে স্যারকে চিনেছিলাম। স্যার আমাকে বেশ স্নেহই করতেন।

বলতেন, কি ফারসীম কি বই লিখলা? তোমার কয়টা বই? স্যারকে আমার কোনো বইই আর দেওয়া হল না। দরাজ গলায়ই বলতেন।

নিউক্লিয়ার পাওয়ার নিয়ে স্যারের আগ্রহ ছিল। আমারও ছিল। এক সময়ে দেখা গেল পরমাণু শক্তি কমিশন আয়োজিত আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সির সহায়তায় পরিচালিত একটি কর্মশালায় বুয়েটের পক্ষ থেকে আমি আর রশীদ স্যার অংশ নিচ্ছি, ২০১৬/১৭ সালে।

সেই থেকে স্যারের সাথে পরমাণু বিদ্যুৎ বিষয়ে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সেই ওয়ার্কশপের একটা কথা খুব মনে পড়ে। দিনশেষে পরমাণু শক্তি বিষয়ে উত্তেজিত আমি নিউ মার্কেটে গেলাম, লামার্শের নিউক্লিয়ার এঞ্জিনিয়ারিং বইটা খুঁজতে।

গিয়ে দেখি, স্যারও লামার্শ খুঁজতেছেন। স্যার ছিলেন আমাদের কাছ-থেকে-দেখা লামার্শ। উনার মত কেউ আর দরাজ গলায় জিজ্ঞেস করবেন না আর, কি ফারসীম, কী বই লিখলা!

প্রথম আলো’র যুব প্রোগ্রামের পরিচালক মুনির হাসান লিখেন-

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গ্রাম থেকে আসা ছেলেটি আহসানউল্লাহ হল থেকে বের হয়ে সিভিল বিল্ডিং খুঁজে নিয়েছে। বেশি কষ্ট হয় নাই কারণ ঘন্টাখানেক আগে একজন শিক্ষক রুম গুলো কোথায় তা ভবনের নিচ থেকে দেখিয়ে দিয়েছেন।

সেই মোতাবেক সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ইতিউতি তাকানো। এই সময় পেছনে কে জানি বললো – ইলেকট্রিক্যাল?
ঘুরে দেখি একজন। বই আর রেজিস্টার খাতা দেখে দেখে বুজলাম স্যার। মাথা নাড়লাম।

-কী নাম? আমার সঙ্গে এসো।

নাম বলে স্যারের সঙ্গে সিই২০০৬ নম্বর রুমে ঢুকে পড়লাম। শুরু হয়ে গেল বুয়েটে আমার শিক্ষা জীবন।

স্যার নিজের নাম বললেন – আবদুর রশীদ সরকার। নিজে কোথায় পড়াশোনা করছেন সেটা বললেন। তারপর আমাদেরকে উনি বোর্ড ওয়াইজ দাঁড় করালেন। সে অভিজ্ঞতা পড়ো পড়ো পড়ো বইতে লিখেছি। তাই আর লিখতে চাই না।

কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো সেই ১৯৮৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রশীদ স্যার আর কখনো আমাকে নাম জিঙ্গেষ করেন নাই। কোনদিন ভুলও করেন নাই।

শুধু ২০০৯-১০ সালে এটি টিভিতে অনুষ্ঠান করতাম দেখে স্যার মাঝে মধ্যে আউলায় ফেলে আমাকে আপনি বলতেন। কিন্তু যখনই বলতাম আমি আপনার ছাত্র তখনই আমার তুমিতে চলে যেতেন।

বুয়েটের আমার স্যার/ম্যাডামরা সব সময় কোমল-কঠোরে মেশানো। কিন্তু রশীদ স্যারই সম্ভবত একমাত্র স্যার যাকে আমি কখনো রাগতে দেখি নাই।

সদা হাস্যময় রশীদ স্যার আজ সকালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

আল্লাহ আপনাকে বেহেস্ত নসীব করুন।

এটমিক কার্টুনস ইনকর্পোরেটেড এর প্রোডাকশন ম্যানেজার ওয়াহিদ ইবনে রেজা লিখেন-

বুয়েটে আমি ছিলাম দুষ্টু গরু। এবং প্রতি পদে পদে বুয়েটের শিক্ষকরা আমাকে মনে করিয়ে দিতেন যে আমার চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল। অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।

আমি পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলাম না। ক্লাসে উপস্থিত থাকতাম না নিয়মিত। আর থাকলেও ছেড়া পাঞ্জাবি পরে উদাস উদাস ভাবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম।

আমাকে নিয়ে খুশিতে গদগদ হবার তাদের কোন কারণ ছিল না।

তারপরও কোন এক অজ্ঞাত কারণে খুব অল্প সংখক শিক্ষক আমাকে খুব মায়া করতেন। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর রশীদ স্যার তাদের মধ্যে একজন।

আমার এখনো মনে আছে বুয়েটে জীবনের প্রথম মঞ্চ নাটক করে পরের সপ্তাহে ক্লাস করতে যাচ্ছি, স্যার মেকানিক্যাল বিল্ডিং এর সামনে আমাকে আটকিয়ে বললেন, কি মিয়া, তুমি তো অভিনয় ভাল করো! বলতো, ওই ডায়লগটা আবার বলতো।

স্যার এর রুমের সামনে দিয়ে হেটে গেছি, আর স্যার ডেকে কথা বলেননি, এমনটা কোনো দিন হয়নি।

বুয়েটে যেখানে অনেক স্যার এর সামনে আমরা ভয়ে থরথর করে কাঁপতাম, সেখানে রশীদ স্যার আমাদের সাথে ব্যবহার করতেন বন্ধুর মত।

আমার ভার্সিটি লাইফে এই অভিজ্ঞতা ছিল নিঃসন্দেহে বিরল। একবার বুয়েটে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম, স্যার দূর থেকে দেখেছেন।

পরে ক্লাস নিতে এসে বললেন, কি মিয়া তোমারে দেখলাম বৃষ্টিতে ভিজতাস, ছাতা ছিল না?

রশীদ স্যার এর কালচারাল প্রোগ্রামের প্রতি আগ্রহ ছিল খুব। আমাদের মেকানিক্যাল ফেস্টিভ্যাল হলেই একদম সামনের সারিতে বসে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো অনুষ্ঠান দেখতেন।

কতবার মঞ্চ থেকে ওনার সাথে আমার চোখাচোখি হয়েছে। আমি জোকস বলছি আর দেখছি উনি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছেন।

যখন পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে কাজ করলাম না, আমাকে উনি বললেন, তোমারে নিয়ে টেনশন নাই, যা করবা ভালোই করবা। দোয়া থাকবে সবসময়।

রশীদ স্যার এর মত সহজ, সরল ও বিনয়ী মানুষ আমি আমার জীবনে খুব দেখেছি। উনি ছিলেন একদম বইয়ের ভাষায়, পিতৃতুল্য শিক্ষক।

এবং আমার মনটা অসম্ভব অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল শুনে, যে দীর্ঘদিন কোরোনার সাথে যুদ্ধ করে উনি ইন্তেকাল করেছেন আজকে।

আল্লাহ তায়ালা ওনাকে বেহেস্ত নসীব করুক, এবং ওনার পরিবার কে এই শোক সামলানোর শক্তি দিন।

যেই পরম মমতা উনি উনার ছাত্রছাত্রীদের প্রতি দেখাতেন, সেই মমতার শতগুন বর্ষিত হোক তার মৃত্যুর পরের জীবনে।

আমিন।