বুয়েটছাত্র ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনায় বান্ধবী বুশরা গ্রেফতার

আমাতুল্লাহ বুশরা

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার ঘটনায় তার বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার (১০ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর রামপুরার নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

এর আগে, বুধবার (৯ নভেম্বর) দিনগত রাতে ডিএমপির রামপুরা থানায় ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বাদী হয়ে ছেলে হত্যার অভিযোগ এনে বান্ধবী বুশরাসহ অজ্ঞাতপরিচয় বেশ কয়েকজনের নামে একটি মামলা (নং-৯) দায়ের করেন।

এর আগে, ৪ নভেম্বর রাতে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বান্ধবী বুশরাকে বাসায় যাওয়ার জন্য এগিয়ে দেন ফারদিন।

এরপর থেকেই নিখোঁজ হন ফারদিন। ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরা পড়েন ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। রামপুরা বনশ্রীতে তার বাসা। বছর পাঁচেক আগে এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ফারদিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় বলে ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানার ভাষ্য।

বৃহস্পতিবার সকালে রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, বুশরাকে তারা ওই মামলায় গ্রেপ্তার করেছেন। পরে ওই তরুণীকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডের আবেদন করা হয়।

কেন ছেলের বান্ধবীকে সন্দেহ করছেন জানতে চাইলে নূরউদ্দিন রানা বলেন, “তাদের সম্পর্ক প্রায় পাঁচ বছরের, বিতর্ক করতে গিয়ে পরিচয়। কিন্তু আমার ছেলের মৃত্যুতে সে ভেঙে পড়ে নাই।”

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত চার বছর ধরে ওই তরুণীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে ফারদিনের। ওই তরুণী ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। ৪ নভেম্বর ঘোরাফেরার পর রাত সোয়া ১০টায় বাসায় ফিরে যান বলে পুলিশকে জানান ওই তরুণী।

ইন্ধন?

মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ৪ নভেম্বর দুপুর ৩টায় বুয়েটে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয় ফারদিন। পরদিন ৫ নভেম্বর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরে দুপুরের খাবার খাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু পরে জানা যায়, ফারদিন পরীক্ষা দেননি। তার শিক্ষক ও বন্ধুরা বারবার তার মোবাইলে ফোন করে বন্ধ পান।

ফারদিনের পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকার খবর পেয়ে ৫ নভেম্বর বিকেল থেকে পরিবারের সদস্যরাও ফারদিনকে ফোন করে মোবাইল বন্ধ পান। তখন পুলিশের সাথে কথা বলে তারা রামপুরা থানায় জিডি করেন।

এজাহারে বলা হয়, “সাধারণ ডায়েরির প্রেক্ষিতে রামপুরা থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলামের জেরায় আমাতুল্লাহ বুশরা জানায়, গত ৪ নভেম্বর ফারদিন বাসা থেকে বের হওয়ার পর ওইদিন বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার (বুশরা) সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। প্রথমে তারা দুজন ধানমণ্ডি সিটি কলেজ এলাকায় মিলিত হয়েছে। এরপর সেখান থেকে তারা দুইজন নীলক্ষেত ও ধানমণ্ডি এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে।

“পরশ ও বুশরা ওই দিন বিকেল আনুমানিক পাঁচটার দিকে সাত মসজিদ রোডে ‘ইয়াম চা ডিস্ট্রিক্ট’ রেস্তোরাঁ খাবার খেয়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে। এরপর তারা দুজনে রাত ১০টার দিকে রিকশায় করে রামপুরা টেলিভিশন ভবন এলাকায় আসে।“

এর তিনদিন পর গত ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফারদিনের লাশ উদ্ধারের কথা জানিয়ে এজাহারে বলা হয়, “পরশকে ৪ নভেম্বর রাত আনুমানিক ১০টার পর হতে ৭ নভেম্বর বিকাল সাড়ে ৪টার মধ্যে যে কোনো সময় রামপুরা থানাধীন উক্ত স্থানে বা অন্য কোথাও হত্যাকারীরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। আমার পুত্র ফারদিন নূর পরশের নিখোঁজ ও মৃত্যুতে আমাতুল্লাহ বুশরার ইন্ধন রয়েছে।”

যেভাবে উদ্ধার হয় লাশ

ফারদিনের কোন খবর না পেয়ে তার বাবা জিডি করলে তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, বুয়েটের ওই শিক্ষার্থী সেদিন রামপুরা থেকে সদরঘাটের দিকে গিয়েছিলেন। সে সময় পুলিশ কিছু সিসিটিভি ভিডিও সংগ্রহ করে এবং কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করে।

পুলিশ বলছে, ফারদিন ও তার বান্ধবী শুক্রবার বিকেলে ধানমণ্ডির রেস্তোঁরায় খেয়ে নীলক্ষেতে যান। সেখানে বই কিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আইসক্রিম খান। এরপর রাত ১০টার দিকে তারা রিকশায় করে রামপুরা এলাকায় যান। রামপুরা পুলিশ বক্সের সামনে ফারদিন রিকশা থেকে নেমে যান।

এরপর ফারদিনের মোবাইল ফোনের গতিপথ সদরঘাটের দিকে যাওয়ার তথ্য পেয়েছে পুলিশ; কিন্তু তিনি কেন লালবাগে বুয়েট হলের দিকে না এগিয়ে সদরঘাটের দিকে গেলেন, সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।

রামপুরা থানার ওসি রফিকুল বলেছিলেন, তারা ফারদিনের মোবাইল ফোনের সর্বশেষ অবস্থান পেয়েছিলেন শুক্রবার রাতে কেরানীগঞ্জ এলাকায়। তারপর থেকে আর কোনো অবস্থান পাননি। সে কারণে তাদের ধারণা, হয়ত ফোন বন্ধ ছিল।

ফারদিনের মা ফারহানা ইয়াসমিনও জানিয়েছিলেন, শুক্রবার রাত ১১টার পর থেকে ফারদিনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাচ্ছিলেন তারা।

সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারেই কেরানীগঞ্জ। পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, ফারদিন হয়ত নদীতে কোনো নৌযানে উঠেছিলেন বলে মোবাইলটির অবস্থান রাতে কেরানীগঞ্জে ধরা পড়ে।

রোববার ফারদিনের বিষয়ে আর কোনো তথ্য কেউ পায়নি। পরদিন সোমবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার গোদনাইল এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীতে পাওয়া যায় ফারদিনের লাশ।

মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ফারদিনের ময়নাতদন্ত হয়। পরে চিকিৎসক শেখ ফরহাদ বলেন, নিখোঁজ হওয়ার দিনই ফারদিনকে হত্যা করা হয় বলে তাদের ধারণা।