কাশ্মীরের যেই অংশ নিয়ে আজও কোনো যুদ্ধ হয়নি-২য় পর্ব: গিলগিট বাল্টিস্থান

১৯৮৪ সালের আগ পর্যন্ত এই অঞ্চলটি পাকিস্তানের মেইনল্যান্ড থেকে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো। অত্যন্ত দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল বিধায় পাকিস্তানের মেইনল্যান্ডের সাথে এর কোনো স্থায়ী সড়কপথ ছিলোনা।

একটা প্রাচীন সিল্ক রোড ছিলো যা বছরে মাত্র তিন মাস ব্যাবহার করা যেতো। সেটাও ভারী যান চলাচলের অযোগ্য ছিলো। ফলে সে সময়টাতে গিলগিট বাল্টিস্তান ছিলো আধুনিক পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক ভুমি।

১৯৮৪ সালে পাকিস্তান এবং চীনের যৌথ উদ্দোগে পাহাড়-পর্বত কেটে নির্মিত হয় গ্রেট কারাকোরাম হাইওয়ে। সড়কটি গিলগিট বাল্টিস্তানকে মেইনল্যান্ডের সাথে সংযুক্ত করার পাশাপাশি চীন এবং পাকিস্তানের ভেতর সরাসরি যাতায়তের পথ উন্মুক্ত করে৷ এই সড়কের মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে সড়কপথে বানিজ্য শুরু হয়।

বর্তমানে গিলগিট বাল্টিস্তান একটি আধা প্রদেশের মর্যাদায় রয়েছে। এখানে রয়েছে গভর্নর এবং প্রধানমন্ত্রীর সমন্বয়ে নিজস্ব প্রসাশন ব্যাবস্থা। আইন শৃঙ্খলার জন্য রয়েছে গিলগিট-বাল্টিস্তান পুলিশ এবং ট্যুরিস্ট পুলিশ। এছাড়া পাকিস্তান আর্মির “নর্দান লাইট ইনফ্যান্ট্রি” নামের একটি ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার আছে এখানে।

এই অঞ্চলটির আয়তন ৭২,৫০০ বর্গকিলোমিটার, মানে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক। এত বিশাল ভুখন্ডের জনসংখ্যা মাত্র ১৫ লাখ। ১৪ টি জেলা এবং ৩ টি বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত এই অঞ্চলটির রাজধানী গিলগিট শহর। রাজধানী গিলগিট এবং স্কার্দু এই দুই শহরে দুটি এয়ারপোর্টে রয়েছে।

গিলগিট বাল্টিস্তান কেমন?
এক কথায় পৃথিবীর বুকে এক খন্ড স্বর্গ। অনেকে কাশ্মীরকে ভুস্বর্গ বলে, কারন তারা গিলগিট বাল্টিস্তানের সৌন্দর্য এখনো দেখেনি। গোটা বৃহত্তর কাশ্মীরে যা কিছু আছে, বলা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু রয়েছে গিলগিট বাল্টিস্তানে।

পৃথিবীতে ৮ হাজার মিটার উচু পর্বত আছে মোট ১৪ টি, যার ভেতর ৫ টিই রয়েছে গিলগিট বাল্টিস্তানে। এখানে আছে পৃথিবীর ২য় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট K2, যা কিনা মাউন্ট এভারেস্টের চেয়ে অল্প একটু নিচু। এছাড়া পৃথিবীর সর্বোচ্চতম ১০০ টা পর্বতের মধ্যে ৩৮ টাই রয়েছে এখানে। বুঝতেই পারছেন এটা পর্বতের স্বর্গ।

৩ টি পর্বতমালা এসে এখানে মিলিত হয়েছে। সেগুলো হলোঃ- হিমালয় পর্বতমালা, কারাকোরাম পর্বতমালা এবং হিন্দকোষ পর্বতমালা। সারা বছরই এখানে বিদেশি পর্বতারোহীদের সমাগম লেগেই থাকে।

এখানে রয়েছে আশ্চর্য সুন্দর সব লেক, যার নীল-সবুজ রংয়ের স্বচ্ছ পানি অপার্থিব সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। যার ভেতর Attabad Lake, Upper Kachura Lake, Lower Kachura Lake, Rainbow Lake, Borith Lake, Karambar Lake, Kutwal Lake, Sheosar Lake অন্যতম। নামগুলো গুগল করে বিস্তারিত জানতে পারেন।

এছাড়াও এখানে আছে পৃথিবীর সর্বোচ্চতম শীতল মরুভূমি, যেখানে বালুর চেয়ে বরফের দেখাই বেশি মেলে। আশ্চর্যজনক এই জায়গাটিতে আকাশছোঁয়া পর্বত, মরুভূমি এবং তুষার তিনটি জিনিস একসাথে দেখা যায়। এখানে আছে পৃথিবীর ২য় উচ্চতম মালভুমি “দিওসাই প্লাটো”, যেখানে দেখা মেলে তৃণভোজী বাদামী ভাল্লুকের।

বলাযায় পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জীবন ব্যাবস্থা রযেছে এই অঞ্চলের মানুষের। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত আধুনিক পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় এরা পুরপুরি স্বনির্ভর। গম, আলু এবং বিভিন্ন ধরনের ফল এদের প্রধান খাবার।

এরা পানির পরিবর্তে অধিক পরিমানে ফলের জুস পান করে। এখানে আপেল, আঙ্গুর, জাম, এপ্রিটক সহ বিভিন্ন ফলের চাষ করা হয়। এরা পাহাড়ি ছাগল, ইয়াক এবং ভেড়া পালন করে।

এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উচু ভুখন্ডগুলোর একটি, যার গড় উচ্চতা প্রায় ১০ হাজার ফুট। মানে সাজেকের সর্বোচ্চ চুড়া থেকেও অন্তত ৪-৫ গুন উচ্চতায় এদের বসবাস। ফলে ভুগর্ভস্থ পানির কোনো উৎস নেই এখানে। তারা পাহাড়ি ঝর্না, ঝিরি এবং লেকের পানি ব্যাবহার করে।

গিলগিট বালটিস্তানের বিভিন্ন জাতির বসবাস
গিলগিট বালটিস্তানের বিভিন্ন জাতির বসবাস

গিলগিট বাল্টিস্তানে অনেকগুলো জাতি বসবাস করে। এদের সাথে কাশ্মীরিদের তেমন কোনো মিল নেই, তবে তিব্বতিয়ান দের সঙ্গে অনেক মিল আছে। ঐতিহাসিকগন এদেরকে চেঙ্গিস খানের বংশধর বলেও দাবি করে থাকে।

এখানকার উল্লেখযোগ্য জাতিগোষ্ঠী গুলোর ভেতর ওয়াহি সম্প্রদায় অন্যতম। এরা হুনজা উপত্যকার বসবাস করে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক জীবনধারার জন্য এদের গড় আয়ু ১০০ বছরের চেয়েও বেশি।

এখাসকার জনগন সহজে বৃদ্ধ হয়না। ৫০-৬০ বছর বয়সেও এদেরকে তরুণ মনে হয়। ৬৫ বছর বয়সেও একানকার নারীরা সন্তান ধারন করতে পারে। রোগব্যাধি এখানে দূর্লভ বিষয়। বিশেষ করে হুনজার জনগন বাধ্যক্য ছাড়া আর কোনো কারনে মারা যায়না।

গিলগিট বাল্টিস্তানে শিশু বিবাহের প্রচলন আছে। তবে বর-কনে তরুন হবার পর আবার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কনে দান করা হয়।

গিলগিট বাল্টিস্তানে শিক্ষার হার অনেক বেশি। হুনজা জেলায় শিক্ষার হার ৯০%। এখানকার পরিবেশ একদম পরিস্কার, কোথাও কোনো ময়লা-আবর্জনা দেখবেন না।

এখানে কারাকোরাম ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাল্টিস্তান ইউনিভার্সিটি সহ আরো কয়েকটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য অনেকেই পাকিস্তানের অন্যান্য বড় শহরে চলে যায়।

প্রতিবেশী চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের চীনা এবং গিলগিটিরা প্রতিবছর যৌথভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

এই অঞ্চলে এখনো অর্নারারি রাজবংশ রয়েছে। এছাড়া মধ্যযুগের কয়েটি রাজপ্রাসাদ এবং দুর্গও এখনো রয়েছে। যার ভেতর আল্তিত ফোর্ট, বাল্টিত ফোর্ট, খাপলু ফোর্ট অন্যতম।

৮০র দশকে পাকিস্তান সমৃদ্ধ ট্যুরিজম সেক্টর থাকলেও গত কয়েকদশক ধরে চলা আফগান যুদ্ধ আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরিন অস্থিতিশীলতার কারনে ট্যুরিজম সেক্টরে ধ্বস নামে।

তবে গত কয়েক বছর ধরে গিলগিট বাল্টিস্তানে ট্যুরিজম খুব দ্রুত প্রসারিত হয়েছে। ইউরোপ আমেরিকার সহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা এখানে ভ্রমন করছে। বর্তমানে ট্যুরিজম এখানকার জনগনের অন্যতম আয়ের উৎসে পরিনত হয়েছে।

মজার বিষয় হলো গত ১০ বছর যাবত গিলগিট বাল্টিস্তানের ক্রাইম রেট একেবারে শুন্য। মানে এখানে কোনো অপরাধ ঘটেনা। এখানকার ঘর-বাড়িতে তালা ব্যাবহারের প্রযোজন হয়না। নিঃসন্দেহে এটি পাকিস্তানের সবচেয়ে নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ন অঞ্চল।

ভারত-পাকিস্তান-চীনের ভেতর প্রতিটি বর্ডারেই যুদ্ধ লেগে থাকে। অথচ আজ পর্যন্ত গিলগিট বাল্টিস্তান বর্ডারে ভারত-পাকিস্তানের ভেতর কোনো যুদ্ধ সংগঠিত হয়নি।

ভারতীয় উপমহাদেশ নানা সমস্যার জর্জরিত। পৃথিবীর স্বর্গ খ্যাত কাশ্মীরকে ভারতীয় বাহিনী নরকে পরিনত করেছে। পাক-ভারত যুদ্ধ আজাদ কাশ্মীরকেও ঝুঁকির ভিতর রাখে, লাদাখে চীন-ভারত যুদ্ধ নিয়মিত বিষয়ে পরিনত হয়েছে। এতসব সংকটের ভেতরেও গিলগিট বাল্টিস্তান আজও পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গতুল্য শান্তির ভুমি!

১ম পর্বঃ কাশ্মীরের যেই অংশ নিয়ে আজও কোনো যুদ্ধ হয়নি (১ম পর্ব)