কাশ্মীরের যেই অংশ নিয়ে আজও কোনো যুদ্ধ হয়নি (১ম পর্ব)

বৃহত্তর কাশ্মীর বলতে যা বুঝা হয় বর্তমানে সেটা ৩ টি দেশের অধিনে ৫ টি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে গেছে। সেগুলো হলো,

ভারতের অধিনেঃ
১. জম্বু কাশ্মীর
২. লাদাখ

পাকিস্তানের অধিনেঃ
৩. আজাদ কাশ্মীর
৪. গিলগিট বাল্টিস্তান

চীনের অধিনেঃ
৫. আকশাই চীন

১৯৪৮ সালে ভারত জম্বু কাশ্মীর এবং লাদাখ দখল করে নেয়, যা নিয়ে আজ পর্যন্ত যুদ্ধ চলছে। একই বছর যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান আজাদ কাশ্মীর জয় করে। আর ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতকে হারিয়ে লাদাখের বড় একটি অংশ দখল করে নেয় চীন, যাকে পরে আকশাই চীন নামকরণ করা হয়।

তবে গিলগিট বাল্টিস্তান অংশটি একমাত্র অঞ্চল যাকে নিয়ে ভারত -পাকিস্তান-চীনের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোনো যুদ্ধ হয়নি। কোনো যুদ্ধ ছাড়াই এই অঞ্চলটি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। চলুন জেনে আসি এই গিলগিট বাল্টিস্তানের ইতিহাস।

প্রাচীন ইতিহাসঃ
গিলগিট বাল্টিস্তানের হুনজা, স্কার্দু সহ বিভিন্ন জেলায় খ্রিষ্ঠপূর্ব ২০০০ সালের পাথরে খোদাইকৃত বোদ্ধ মুর্তি/চিত্রকর্ম দেখা যায়, যা প্রায় ৪ হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে মানুষের উপস্থিতির প্রমান দেয়। অর্থাৎ এরা বাঙালীর চেয়ে অনেক প্রাচীন জাতি।

তিব্বত মালভূমিতে মানব বসতি স্থাপনের পরের কয়েক শতাব্দীর মধ্যে এই অঞ্চলটি তিব্বতিদের দ্বারা অধ্যুষিত হয়ে ওঠে। এ কারনেই গিলগিট-বাল্টিস্তানের জনগণের সাথে কাশ্মীরের জনগণের শারীরিক ও সাংস্কৃতিক মিল নেই, বরং তাদের সাথে তিব্বতিদের অনেক মিল পাওয়া যায়।

৬০০ সালের আগ পর্যন্ত এই অঞ্চলটি “তাং” নামক একটি চীনা বৌদ্ধ রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছিল। সে যুগে চীনা বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীরা এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভারতে তীর্থযাত্রা করতো। এরপর তিব্বত সম্রাজ্য শক্তিশালী হয়ে উঠলে তারা চীনাদের কাছ থেকে এই অঞ্চলটি দখল করে নেয়।

পরবর্তিতে উমাইয়া খিলাফত এবং আব্বাসী খিলাফতের আমলে একে একে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল ইসলামী শাসনের অধিনে আসতে শুরু করলে তিব্বতিরা ইসলামী খেলাফতের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে।

৮০০ সাল নাগাদ এই অঞ্চল তিব্বতিদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। এরপর তিব্বতিয়রা চলে গেলে এখানে স্বাধীন রাজতন্ত্র গড়ে উঠে। প্রতিরক্ষার জন্য রাজারা উঁচু পাহাড়ের উপর পাথরের তৈরি দুর্গ নির্মান করতো। এখনো কয়েকটি দুর্গ অক্ষত অবস্থায় আছে। তাদের ছিলো সৈন্যবাহিনী, কামান সহ বিভিন্ন অস্ত্র।

১৪০০ সালের দিকে এই অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটতে শুরু করে। সেসময় এখানে একাধিক রাজতন্ত্র ছিলো। মুঘলরা কাশ্মীর জয় করতে পারলেও তারা গিলগিট-বাল্টিস্তান জয় করতে পারেনি।

ব্রিটিশ যুগের ইতিহাসঃ
১৮৩৯ সালের নভেম্বরে শিখ রাজা গুলাব সিং, গিলগিট-বাল্টিস্তানে আক্রমন করেন। যুদ্ধে বাল্টিরা পরাজিত হয় এবং গিলগিট বাল্টিস্তানের বড় একটা অংশ শিখদের দখলে চলে যায়। কিন্তু পরের বছরই সেখানে বিদ্রহ ঘটে এবং বাল্টিদের পাল্টা আক্রমনে রাজা গুলাব সিং তার বাহিনী নিয়ে পিছু হটে। ১৮৪২ সালে শিখরা ২য় বারের মত গিলগিট-বাল্টিস্তানে আক্রমন করে তা জয় করে নেয় এবং ১৮৬০ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলটি শিখদের অধিনে ছিলো।

প্রথম অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধে শিখদের পরাজয়ের পর, এই অঞ্চলটি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের একটি অংশ হয়ে ওঠে। তবে গিলগিট-বাল্টিস্তানের জনগন নিজেদেরকে কাশ্মীরিদের থেকে জাতিগতভাবে আলাদা মনে করত এবং কাশ্মীর রাজ্য দ্বারা শাসিত হওয়া অপছন্দ করত। ১৯৪৭ সালের ১লা নভেম্বর পর্যন্ত এই অঞ্চলটি কাশ্মীরি এবং ব্রিটিশ শাষনের অধিনে ছিলো।

অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীর এবং গিলগিট-বাল্টিস্তান অঞ্চল দুটো মাত্র ৯০ বছর এক সাথে ছিলো৷ বাকি পুরো সময়টাই ছিলো ভিন্ন শাষনের অন্তর্ভুক্ত ভিন্ন দুই রাজত্ব।

ব্রিটিশ বিরোধী অভ্যুথ্যানঃ
প্রথম থেকেই গিলগিট-বাল্টিস্তানের জনগন ভারত বা কাশ্মীর রাজ্যে যোগদানের পক্ষে ছিল না। সীমান্ত ইলাকাসের (গিলগিট এবং পার্শ্ববর্তী পার্বত্য রাজ্য) মুসলমানরা পাকিস্তানে যোগ দিতে চেয়েছিল।

এদিকে ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর কাশ্মীরের রাজা হরি সিং কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করলে গিলগিট-বাল্টিস্তানে অসন্তোষ আরো তিব্র আকার ধারন করে।

জনগনের অসন্তোষের মুখে ১৯৪৭ সালের ১ নভেম্বর গিলগিটে অবস্থিত ব্রিটিশ স্কাউটসের মহারাজার কমান্ডার মেজর উইলিয়াম ব্রাউন বিদ্রোহ শুরু করেন। তিনি ব্রিটিশ গভর্নর ঘানসারা সিংকে উৎখাত করেন এবং রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গিলগিট-বাল্টিস্তানের ক্ষমতা গ্রহন করেন। এই অভ্যুথ্যানে তার সাথে মির্জা হাসান খানের অধীনে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য বাহিনীর একটি বিদ্রোহী অংশও যোগ দিয়েছিল।

এরপর কমান্ডার মেজর উইলিয়াম ব্রাউনের নেতৃত্বে গিলগিট বাল্টিস্তানে একটি অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরেই ভারতের সম্ভাব্য হামলা থেকে অঞ্চলটিকে রক্ষার জন্য গিলগিট বাল্টিস্তানের অস্থায়ী সরকার অঞ্চলটিকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৭ সালের ১৬ই নভেম্বর পাকিস্তানের রাজনৈতিক এজেন্ট মোহাম্মদ আলম খান গিলগিট প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

গিলগিট বাল্টিস্তানের অস্থায়ী সরকার ১৬ দিন স্থায়ী হয়েছিল। ইতিহাসবিদ আহমেদ হাসান দানি বলেন যে, যদিও ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহে জনসাধারণের অংশগ্রহণের অভাব ছিল, তবে বেসামরিক জনগণের মধ্যে পাকিস্তানপন্থী অনুভূতি তীব্র ছিল এবং তাদের কাশ্মীরি-বিরোধী মনোভাবও স্পষ্ট ছিল। বিভিন্ন পণ্ডিতদের মতে, গিলগিটের পাশাপাশি চিলাস, কোহ গিজর, ইশকোমান, ইয়াসিন, পুনিয়াল, হুনজা এবং নগরের লোকেরা কাশ্মীরের পরিবর্তে পাকিস্তানে যোগ দেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো।

স্কার্দু বিজয়ঃ
গিলগিট বাল্টিস্তানের বেশিরভাগ অঞ্চল বিজিত হলেও স্কার্দু, লাদাখ সহ আরো কিছু অঞ্চল তখন ভারতীয় বাহিনীর অধিনে ছিলো। গিলগিট বিজয়ের পর গিলগিটি স্কাউট এবং কাশ্মীরী যোদ্ধারা স্কার্দু চলে যায় এবং ১৯৪৮ সালের মে মাস নাগাদ তারা ভারতীয় বাহিনীকে হটিয়ে স্কার্দু জয় করে নেয়। তখন স্কার্দুকে গিলগিট বাল্টিস্তান প্রশাসনের সাথে যুক্ত করা হয়।

আজাদ কাশ্মীর বিজয়ঃ
ভারতীয় সামরিক বাহিনী কাশ্মীর দখলে নিলে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের পাঠান যোদ্ধারা কাশ্মীরিদের সাথে মিলিত হয়ে ভারতীয় আর্মির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে তারা এই প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। তাদের প্রতিরোধের মুখে ভারতীয় সেনারা কাশ্মীর উপত্যকার একটি অংশ দখল করতে ব্যার্থ হয়।

১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান সরকার সেখানে সেনাবাহিনী পাঠায়। পাঠান যোদ্ধারা ওই অঞ্চলটিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে ওই অঞ্চলটিকে আজাদ কাশ্মীর নামকরণ করা হয় এবং এটি পাকিস্তানের একটি সায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তিঃ
পাকিস্তান সরকার সবসময় গিলগিট বাল্টিস্তানকে আজাদ কাশ্মীরের সাথে একিভূত ভাবে রাখার চেষ্টা করেছে। কেননা গিলগিট বাল্টিস্তানের জনগণ সবসময় পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে ছিলো, ফলে বৃহত্তর কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারনে কখনো গনভোটের আয়োজন হলে গিলগিটিদের ভোট কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে বড় ভুমিকা পালন করবে।

পাক সরকারে এই লক্ষের ফলস্রুতিতে ১৯৪৮ সালে গিলগিট বাল্টিস্তানকে আজাদ কাশ্মীরের সায়ত্তশাসিত সরকারের অন্তর্ভুক্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু গিলগিটিদের ভেতর কাশ্মীর বিরোধী মনোভাবের কারনে এই উদ্যোগ ব্যার্থ্য হয় এবং ১৯৪৯ সালে আজাদ কাশ্মীর সরকার গিলগিট বাল্টিস্তানকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হস্তান্তর করে।

শুরু থেকেই গিলগিট-বাল্টিস্তানের জনগণ কাশ্মীরের সাথে যোগদানের বিরোধী ছিলো৷ উভয় অঞ্চলের জনগণের ভেতর জাতিগত, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক মিল না থাকা এর প্রধান কারন। বরং পাকিস্তানি নাগরিকত্ব এবং সাংবিধানিক মর্যাদা লাভের লক্ষে তারা এই অঞ্চলকে প্রদেশ হিসাবে পাকিস্তানে একীভূত করার দাবি করে আসছিলো।

তবে গিলগিট বাল্টিস্তান পাকিস্তানের প্রদেশে পরিনত হলে বৃহত্তর কাশ্মীরের গনভোটে গিলগিটিদের অনুপস্থিতিতে পাকিস্তানের পক্ষে কম ভোট পরবে। সেই সাথে এটি সমগ্র কাশ্মীর সমস্যা জাতিসংঘের রেজল্যুশন অনুযায়ী সমাধানের প্রক্রিয়াকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। একারনে পাকিস্তান সরকার গিলগিট বাল্টিস্তানকে পাকিস্তানের প্রদেশ বানানোর জন্য গিলগিটিদের করা দাবি প্রত্যাখ্যান করে।

এছাড়া গিলগিট বাল্টিস্তানকে পাকিস্তানের সাথে একীভূত করার ইস্যুতে আজাদ কাশ্মীরের নেতারা সবসময় বিরোধিতা করতো। কেননা তাদের লক্ষ ছিলো জম্মু কাশ্মির, আজাদ কাশ্মীর, লাদাখ, আকশাই চীন, গিলগিট বাল্টিস্তানকে মিলিয়ে বৃহত্তর কাশ্মীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

১৯৯৩ সালে আজাদ কাশ্মীর সরকার গিলগিট বাল্টিস্তানকে পুনরায় আজাদ কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু গিলগিট বাল্টিস্তানের জনগণ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করলে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট এই পরিকল্পনাকে বাতিল ঘোষণা করে।

২০০৯ সালে গিলগিট বাল্টিস্তানকে পাকিস্তানের ৫ম প্রদেশ গঠনের উদ্দোগ নেয়া হয়। কিন্তু আজাদ কাশ্মীরের নেতারা এই পদক্ষেপের বিরোধী করে। ফলে উদ্দোগটিও আটকে যায়।

এভাবে গিলগিট বাল্টিস্তান এবং আজাদ কাশ্মীরের নেতাদের দ্বিমুখী দাবিতে গিলগিট বাল্টিস্তানের ভবিষ্যতে আটকে থাকে। তারা কাশ্মীরের অংশও হতে চায়না, আবার পাকিস্তানের অংশও হতে পারেনা।

তবে ২০১৯ সালে ভারত সরকার জম্বু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে জম্বু কাশ্মীরকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অধিনস্ত ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর স্বাধীন কাশ্মীর প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যায়।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সরকার গিলগিট-বালতিস্তানের মর্যাদা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রদেশে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। যার ফলে গিলগিট বাল্টিস্তানের জনগনের দির্ঘ্যদিনের দাবি পুরণের আশা সৃষ্টি হয়েছে।

ফলে কথিত বৃহত্তর কাশ্মীরের ভেতর কেবলমাত্র আজাদ কাশ্মীর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে বাকি থাকবে। বাকি অঞ্চলগুলো চীন, ভারত, পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়েছে বা হবে।

চলবে……