চীনের তৈরী ‘কৃত্রিম সূর্য’ এর অদ্যোপান্তঃ সূর্যের থেকেও ৫গুন বেশি তাপ!

কৃত্রিম সূর্য শব্দটি রূপক। অনেকের কল্পনায় তো আবার এটি আসছে যে, তা মনে হয় আগুনের কোনো গোল্লা। আসলে চায়নার এ সূর্য মোটেও আসল তারাকে প্রতিস্থাপন করবেনা। তাহলে ভাবছেন, কেন তৈরি করা হয়েছে? আসুন তাহলে এই ব্যাপারে জেনে নেই!

পৃথিবীতে শক্তির যতগুলো উৎস আছে, তা কোনো না কোনোভাবে পরিবেশ দূষিত করে।যেমন-তাপ বিদ্যুৎ পরিবেশে কার্বন নির্গত করে।জলবিদ্যুৎ জীববৈচিত্র, নদীরগতিপথ, জলাবদ্ধতাসহ আরো নানাসমস্যা সৃষ্টি করে। আর এদের এক ধাপ উপরে রয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। যদিও এটি দ্বারা কোনো কার্বন নির্গত হয়না কিন্তু এটি দ্বারা সৃষ্ট তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পরিবেশ ও জীব উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। আমরা চেরোনোবিল ও ফুকুশিমার কথা জানি, কতটা ভয়ংকর ছিলো সেই দূর্ঘটনা!

বর্তমানে সময়ের যেসব শক্তির উৎস রয়েছে, তা একদিকে যেমন যথেষ্ট নয় অন্যদিকে পরিবেশ বান্ধবও বলা যায়না। কিন্তু ভবিষ্যতে শক্তি সংকট যে দেখা দিবে তা একপ্রকার আমরা সবাই কম বেশি জানি। তাই বিজ্ঞানীরা এর বিকল্প পথ খুজছেন এবং একইসঙ্গে তা যেন পরিবেশ বান্ধবও হয়!

পারমাণবিক বিদ্যুৎ চালিত হয় নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যেখানে কোনো ভারী নিউক্লিয়াসের নুন্যতম নির্দিষ্ট ভরকে নিউট্রন দ্বারা ভেঙ্গে ছোট নিউক্লিয়াই ও শক্তি উৎপন্ন করা হয়। আর চীনের বিজ্ঞানীদের তৈরীকৃত কৃত্রিম সোর্যের (নক্ষত্র) অভ্যন্তরে ঘটে নিউক্লিয়ার ফিউশন, যেখানে ছোট নিউক্লিয়াই যুক্ত হয়ে ভারী নিউক্লিয়াস সাথে তাপ ও শক্তি উৎপন্ন করা হয়।

কিন্তু ফিশন থেকে ফিউশনের একটা উপযোগীতা হলো তা কোনো তেজস্ক্রিয় বর্জ্য উৎপন্ন করেনা, কার্বনের কথা তো আসবেইনা।মানে গতানুগতিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেসব উপাদান পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী তার কোনোটিই এখানে উৎপন্ন হবেনা। তাই বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ সময় ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ফিউশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে। অবশেষে চীন এবং পরে কোরিয়া এ ক্ষেত্রে অনেকটাই সফলতা অর্জন করে!

এটি কিভাবে করা হয়েছে? 

Tokamak নামক রিয়েক্টরের অভ্যন্তরে এই ফিউশন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে। আর যে Tokamak-এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়েছে, তার নাম “Experimental Advanced Superconducting Tokamak (EAST)” উক্ত EAST এর অভ্যন্তরে গরম প্লাজমাকে চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে যাতে তা তার কন্টেইনার এর সংস্পর্শে না আসে। অনেকে ধারণা করেছেন আসলে কিভাবে সূর্য হতে কোনো উত্তপ্ত কিছু পৃথিবীতে সহনীয় হবে।

তার কারণ মূলত এই চৌম্বকক্ষেত্র। এর জন্য হাইড্রোজেনের ভারী ও অতিভারী আইসোটোপ (ট্রিটিয়াম ও ইউটেরিয়াম) কে রিয়েক্টরে রেখে বিদ্যুৎ চালনা করা হয়। ফলে তা প্লাজমাতে পরিণত হয়। এর পর চৌম্বক ক্ষেত্রের দ্বারা তাদের পরস্পরের নিকটে আনা হয় যাতে ফিউজ করা যায়। এর ফিউজের ফলে প্রচুর তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয়।

সূর্যের কোরের তাপমাত্রা 12 million°C যেখানে চীনের বিজ্ঞানীদের তৈরিকৃত কৃত্রিম সূর্যের উৎপন্ন তাপমাত্রা 100 million°C! উল্লেখ্য যে, তা শুধুমাত্র 10 second এর জন্য ধরে রাখতে পেরেছিল!

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, সূর্য থেকে বেশি তাপ হলে যেখানে পৃথিবী গলে যাওয়ার কথা কিংবা সূর্যের মতো উত্তপ্ত কিছুর কাছে যাওয়াও সম্ভব নয়, সেখানে উক্ত কৃত্রিম সূর্যটি কিভাবে সসহনশীল হলো? তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর কিন্তু উপরের লেখাতেই আছে। আসলে তাদের চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল যাতে তা কন্টেইনারের সংস্পর্শে না আসে।

কৃত্রিম সূর্যটির মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের মূল লক্ষ্যই হলো, মানুষের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদার পরিবেশবান্ধব উৎস তৈরি করা। সমুদ্রের এক লিটার পানি থেকে যে পরিমাণ ডিউটেরিয়াম গ্যাস পাওয়া যাবে, তা থেকে নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে পাওয়া শক্তি ৩০০ লিটার গ্যাসোলিন পুড়িয়ে পাওয়া শক্তির প্রায় সমান। এবার ভেবে দেখুন, সমুদ্রে কত পানি আছে আর তা থেকে কী পরিমাণ ডিউটেরিয়াম আহরণ সম্ভব।

এখন নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে কাজে লাগানোর মতো শক্তি উৎপন্নের টেকসই পদ্ধতি উদ্ভাবন সম্ভব হলেই লাখ লাখ বছরের জ্বালানি চাহিদা নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া সম্ভব বলেই মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ!