গল্পটা আত্মবিশ্বাসের: Sanjana Chowdhury Ratri

Sanjana Chowdhury Ratri

 

তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তত জানতাম না, বুঝতামও না।আমার বড় ভাই, উচ্চমাধ্যমিকের পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করছিলো।

একদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনি ভাইয়া ঢাবিতে চান্স পেয়েছে(খ-৩১৯তম)। আর এই কথাটা শুনা মাত্রই কেঁদে ফেলেছিলাম।

আমার স্বপ্নের শুরু তখন থেকেই, ঢাবি ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবতে পারতাম না। আর সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে আমি হাঁটছি, টিএসসিতে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছি, ক্যাম্পাসে হাসিমুখে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছি, লাল-সাদা শাড়ি পড়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছি এসব ভাবতে ভাবতেই প্রতিদিন কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম টেরই পেতাম না।

সবসময় মনে হতো আমি নিশ্চয়ই পারবো আমার স্বপ্নকে ছুঁতে। ২০১৭-তে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিই,রেজাল্ট ৪.৬৪!

তারপর অনিবার্যভাবে গ্রুপ চেঞ্জ মানবিকে ভর্তি হতে হয়। কলেজ লাইফের ২টা বছর ছিল আমার নিজেকে প্রস্তুত করার,করেছিও তাই।

একটু একটু করে নিজেকে তৈরী করেছিলাম ঢাবিয়ান হওয়ার জন্য।বন্ধু-বান্ধবরাও একসময় ধরে নেয় যে ঢাবিতে আমি চান্স পাবোই।

টানা ২বছর কলেজের ফার্স্ট গার্ল ছিলাম,বাট ভাগ্য এবারও আমার সহায় হলো না।

এইচএসসি তেও ৪.৮৩ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।আর এই সময়টাতেই আমাকে সম্মুখীন হতে হয় কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার,মুখোমুখি হই বাস্তবতার।

প্রতিনিয়ত চারপাশের মানুষের কাছ থেকে খোঁটা শুনতে হয়েছে এ+ পাইনি বলে।

এ+ পাইনি,কোচিং করে আর কী-ই বা করবো।এসব শুনতে শুনতে একসময় খুব ডিপ্রেশড হয়ে পড়ি,সেই সময়টাতে হয়তো আর কখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম না যদি না আমার ভাই আমাকে পুরোটা সময় ভরসা না দিত,সাপোর্ট না করতো।

খুব ভাগ্য করে আমি এমন একটা ভাই পেয়েছি,আজ আমি যা,যতটুকু সফল তার পুরোটা কৃতিত্বের দাবিদার আমার ভাই।

এসএসসি/এইচএসসি কোনোটাতেই জিপিএ-৫ আসেনি,সেই ঘাটতিটুকু পূরণ করার জন্য কী পরিশ্রমই না করতে হয়েছিল,ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে।

প্রতিটা মূহুর্তে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতাম আর বলতাম, ঢাবি যাতে আমার হয়। একটু একটু করে পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসছিল আর আমারও কনফিডেন্স লেভেল বাড়ছিল।

২০সেপ্টেম্বর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই,যে ঢাবির স্বপ্ন দেখে রাতে ঘুমাতাম, যে ঢাবি নিয়ে এতো আশা, এতো আকাঙ্ক্ষা, সেই ঢাবিকে সেদিন প্রথমবার স্বচক্ষে দেখতে পাওয়ার যে অনুভূতি তা কখনও প্রকাশ করার নয়।

সারারাত মনের মধ্যে একটু ভয়,চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল।

আমার তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন,কাটানো এতগুলো নির্ঘুম রাত, ১২বছরের সাধনা সব প্রমাণ করার,বাস্তবে পরিণত করার সেই মহেন্দ্রক্ষণ কাল।

এসব ভাবতে ভাবতেই কোনোরকমে রাত টা পার করি। পরেরদিন সকালে ঢাবির ‘বি’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিই, আমার সীট পড়ে IBA তে, পরীক্ষাও আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর রহমতে ভালোই হয়।

পরীক্ষা শেষে হল থেকে বের হওয়ার আগে বেঞ্চের কোণায় ছোট্ট করে নিজের নামটা লিখে আসি।

কনফিডেন্স ছিল আমার সীট টা আমারই থাকবে।

পরীক্ষা দেওয়ার আগেই ন্যাশনালে আবেদন করার ডেট শেষ হয়। জবি, জাবির ফর্ম তোলারও সময় শেষ হয়ে যায়,ইচ্ছে করেই তুলিনি।

আমাদের সময় থেকে লিখিত পরীক্ষা যোগ হওয়ার কারণে রেজাল্ট দিতে প্রায় ২১দিন সময় লাগছিল।একে একে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন করার সময় শেষ।

আর এদিকে আমি শুধু ঢাবির বি ইউনিটের ফর্ম তুলে সেই ইউনিটেই এক্সাম দিয়ে বসে আছি।আর কোনো অপশন নেই আমার হাতে, ন্যাশনালও না।একমাত্র ঢাবির ‘বি’ ইউনিটই আমার সম্বল।

আত্মীয়স্বজন সহ শিক্ষকরাও বলেছে আমি অন্য কোথাও ফর্ম না নিয়ে ভুল করছি, যদি ঢাবিতে না আসে তখন কী হবে! ইভেন ‘ডি’ ইউনিটের ফর্মও তুলিনি।আমার সৃষ্টিকর্তা আর নিজের উপর ভরসা ছিল,আমি হারবো না।

আমার এতো কষ্ট,এতো স্যাক্রিফাইস,আমার পরিবারের আমার প্রতি এতো ভরসা, সাপোর্ট কখনও বিফলে যেতে পারে না।

আমার সৃষ্টিকর্তা কখনও আমায় খালি হাতে ফিরিয়ে দিবেন না।আমার স্বপ্ন পূরণ হতেই হবে।
তবুও যতই রেজাল্ট প্রকাশের দিন ঘনিয়ে আসছিল ততই ভয় বাড়ছিলো।

শেষ পর্যন্ত ঢাবি আমার হবে তো? চাপা উত্তেজনায় কেটেছিল ভয়ঙ্কর সেই ২১টা দিন।

অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটলো, ১৩অক্টোবর আমাদের রেজাল্ট প্রকাশ হলো।

আমার পজিশন ৬৯৫তম।তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নকে ছুঁতে পারার স্বাদ কেমন হয় সেদিন বুঝতে পারি।

শুধুমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইউনিটের ফর্ম তুলে সেই ইউনিটেই চান্স পেয়ে নিজের স্বপ্নকে সত্যি করেছি,আমার কাছে সেটা আকাশ ছোঁয়ার চেয়ে কম কিসে!

আজ আমি ঢাবিয়ান,আমার স্বপ্ন আজ আমার বাস্তবতা,আমার সফলতা।আর আমার সফলতার মূলমন্ত্র আমার আত্মবিশ্বাস।

আমার ভাইয়া আমাকে একদিন বলেছিল,”বড় কিছু অর্জন করতে হলে ছোট ছোট জিনিসগুলোর মায়া ত্যাগ করতে হয়”।আমিও প্রতিটা মুহুর্তে ওর এই কথাটা স্মরণ রেখেছিলাম।

কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ২বার ভাবতাম। আর তার সুফলও পেয়েছি হাতে-নাতে।

সত্যিই আত্মবিশ্বাস,ডেডিকেশন আর ইচ্ছাশক্তি থাকলে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নকেও সত্যি করা সম্ভব।

Sanjana Chowdhury Ratri
Department of sociology
University of Dhaka