বাংলাদেশে এমন কোনো কওমি মাদ্রাসা নেই যেখানে হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হয় না।
খুলনার একটা মাদ্রাসার কথা শুনেছিলাম আজ থেকে ১৮ বছর আগে। সেখানে ভর্তী হওয়া একটি ছেলে বাড়িতে আসার পর আর ফিরে যাবে না। এরপর তার ছেলেটির প্রচন্ড জ্বর হয়, তখন জানা যায় সে আসলে নিয়মিত ধর্ষনের শিকার।
তার মলদ্বারে ইনফেকশন পর্যন্ত হয়ে গেছে। এরপরও ছেলেটির পরিবার মামলা করেনি। কারণ লোক লজ্জার, সমাজের ভয়। মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা ধর্ষনের শিকার হওয়া নাকি লজ্জার।
মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের ধর্ষন হওয়া লজ্জার এই ধারণাটাই পুরুষতান্ত্রিক। যে কোনো নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাড়ানোই বিপ্লবী কাজ। আমার ধারণা মাদ্রাসায় এই পরিস্থিতি একটুও পরিবর্তন হয়নি।
আজ মীর হুযাইফা আল মামদূহের বক্তব্য ছাপা হয়েছে দেশ রূপান্তরে। তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার হিফজ ও দাওরায়ে হাদিস বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। কোরআনের হাফেজ হুযাইফা আল মামদূহ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র।
হুযাইফা আল মামদূহ বলেন , ‘আমি যেদিন হাফেজ হয়েছিলাম, সেদিন বিকেলে হুজুর আমাকে তার ঊরু দিয়ে চেপে ধরে বেদম মেরেছিলেন, আমি জানিও না, কেন মেরেছিলেন তিনি। পুরো পিঠে দাগ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের কাছে এ মাইরগুলো ছিল নিত্যকার ঘটনা।
এগুলো আগে স্কুলেও হতো, পরে সরকার স্কুলে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের প্রহার নিষিদ্ধ করায় কমেছে। অনেকেই মনে করেন, শিক্ষার্থীদের না পেটানোর কারণে বেয়াদপ হয়ে যাচ্ছে।
মাদ্রাসায় পেটানোর কারণে অনেকে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়। কেউ কেউ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মাদ্রাসা ছেড়ে পালায়।
তিনি বলেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের শারীরিক নিপীড়নের ব্যাপারটা একটা ট্রেন্ড হয়ে আছে। ভাবা হয়, এই আঘাতগুলো শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজনীয়, এটা তার মানস গঠন করবে।
এই নির্যাতন তার আদর্শ ছাত্র হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। মাদ্রাসার শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পেটানোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন এবং এসবকে বেশ পবিত্র বলে পেশ করেন। মাদ্রাসার শিক্ষকদের বলতে শুনেছি, শিক্ষকরা যেই জায়গায় মারবেন, সে জায়গা বেহেশতে যাবে। আর এ জন্যই এত প্রবল নির্যাতনের পরেও দেখা যায়, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ওই বাচ্চার চেহারা স্বাভাবিক। কারণ সে এই ব্যাপারটাকে সহজ ভেবে নিয়েছে। বাচ্চার বাবা-মা মাফ করে দিয়েছেন ওই শিক্ষককে।
মাদ্রাসার মক্তব আর বিশেষ করে হেফজখানায় এই নির্যাতন করা হয় বেশি। এই নির্যাতন করা হয় শয়তান সরানোর জন্য ‘
হুযাইফা আল মামদূহ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী নির্যাতনের সাথে শিক্ষকদের মনোভাব যুক্ত, তা পরিবর্তন করতে না পারলে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের নির্যাতন থেকে বাঁচানো যাবে না।
তবে আমি মনে করি শুধু মাদ্রাসা শিক্ষকদের ট্রেনিং দিয়ে, আইন করে, মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। মাদ্রাসা শিক্ষাটি গড়ে উঠেছে পুরাটাই সরকারি ব্যবস্থার বাইরে।
অথচ নাগরিকের শিক্ষার দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র যদি বিনামূল্যে সকল নাগরিকের শিক্ষার দায়িত্ব নিতো তাহলে মাদ্রাসায় যাওয়ার সংখ্যা কমে যেতো।
অনেক বিত্তবান মানুষ যারা ঘুষ , দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আয়ে করেছেন, সম্পদ গড়ে তুলেছেন তারা পরকালে দোজকের শাস্তি থেকে ক্ষমা পেতে একটা সন্তানকে কোরআনের হাফেজ বানাতে চান। এখন এরকম শর্টকার্টে বেহেশতে যাবার ব্যবস্থা ইউরোপে ছিল।
সে সময় চার্চের ফাদাররা টাকার বিনিময়ে ভূ-স্বামী, সামন্ত প্রভুদের বেহেশতের টিকিট দিত। সারা বছর কৃষকদের পেদিয়ে, শোষণ করে সামন্ত রাজারা ফাদারদের কাছ থেকে টিকিট কিনতো বেহেশতের। বাংলাদেশে এটা অন্য ফর্মে আছে।
সেটা হলো একটি ছেলেকে কোরআনের হাফেজ বানালে ওই ছেলের সাথে তার বাবা মা বেহেশতে যাবেন এমন কথা শোনেনি এমন বাঙালী মুসলমান কমই হয়তো আছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে। বামফ্রন্ট কংগ্রেস ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) মিলে সংযুক্ত মোর্চা গঠন করেছে। এরপর থেকে তৃণমূল ও বিজেপির (বিজেমূল) খুব তারস্বরে চিৎকার করছে যে বামপন্থিরা আইএসএফের মত মৌলবাদী দলের সাথে জোট গঠন করেছে।
অথচ আইএসএফ দলিত হিন্দু, আদিবাসী নেতা রয়েছে। মূলত দলিত হিন্দু, আদিবাসী ও মুসলমানদের নিয়ে এটা একটা ফ্রন্ট সংগঠন। তৃণমূলের মমতা বন্দোপাধ্যয় গিতা পড়লে হিন্দু হয় না কিন্তু আইএসএফের নেতা আব্বাস সিদ্দিকী ভাইজান গরিব মানুষের চাকরি চাইলে তিনি মুসলমান মৌলবাদী হন।
এটার নাম ইসলাম ফোবিক। এটার পাল্টা আছে বাংলাদেশে, সেটা হলো নাস্তিক ফোবিক। কোন কিছু মাদ্রাসা নিয়ে বলবেনতো আপনি নাস্তিক। ইসলাম নিয়ে আপনার জানার ঘাটতি আছে।
এখন মাদ্রাসা শিক্ষায় নির্যাতন-ধর্ষনের বিষয়ে কথা বলতে হলে ইসলাম বিষয়ে জানার কি দরকার? ইসলামের শেষ নবী, তাঁর চার খলিফারাতো কেউ মাদ্রাসায় পড়েনি। মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইসলাম সমার্থক এটি আসলে কোথা থেকে কখন এলো তা গবেষণার বিষয়।
আব্বাস ভাইজানের অনেকগুলো ভিডিও দেখলাম। সর্বশেষ গতকালের রাতে দেখা ভিডিওতে উনি বলছেন, আমাদের গরিব আদিবাসী যাদের মা বোনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে (জঙ্গল মহলের কথা বলছেন), ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না কি অত্যাচার হচ্ছে। কেউ কিছু বললে তাকে মাওবাদী বলে মামলা দেয়া হচ্ছে।
দলিত হিন্দুদের জীবনে দারিদ্র ছাড়া কিছু নেই। মুসলমানদেরও একই পরিস্থিতি। আমরা যদি সরকার গড়তে পারি তাহলে এই গরিব হিন্দু মুসলমান আদিবাসীর ছেলে মেয়েরা লেখা পড়া শিখে আইপিএস (ইন্ডিয়ান পাবলিক সার্ভিস) অফিসার হবে, তারা ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে। তাদের পড়ালেখা শিখতে হবে।
ভাইজানের যত ভিডিও শুনছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। যে বক্তব্যর কারণে ওনাকে নারী বিদ্বেসী বলা হচ্ছে সেটা ছিল তৃণমূল এমপি নুসরাতের বিষয়।
ওই বক্তৃতা তিনি বলেছেন, ভারতের পার্লামেন্টে যখন কৃষক বিরোধী আইন পাস হচ্ছে তখন তৃণমূলের এমপি নুসরাত সংসদে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি ফিলিমে শ্যুটিং করছিলেন। এরকম সংসদদের গাছে বেধে পেটানো উচিত।
এর মধ্যে পুরুষতন্ত্র, মৌলবাদ, নারী বিদ্বেষ কোনটা পেলেন? একজন সংসদ সদস্য জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন তার সিনেমার শ্যুটিং করার জন্য না। ভারতের কৃষকদের যখন সর্বনাশ করার আইন তৈরি করা হচ্ছে, তখন নুসরাত যদি শ্যুটিং করার কারণে সংসদে অনুপস্থিত থাকে তবে শুধু গাছে বেধে পেটানোর হুমকি কম হয়েছে। আমি ভাইজানে জায়গা হলে নুসরাতকে শ্রেণি শত্রুর তালিকায় নাম তুলতাম।
তো এরকম প্রাগমেটিক মানুষ নেতা হোক। তিনি ফুরফুরা পীরের গদি থেকে আসবে নাকি চরমোনাই পীর হবেন সেটা তখন বিবেচ্য বিষয় হয়না। কিন্তু বাংলাদেশে এরকম নেই। বাংলাদেশে মুসলমান নেতারা সব কিছু ইহুদি নাসারার যড়যন্ত্র দেখেন, তারা কুয়েত থেকে মিসরে যেতে হিমালয় দেখেন।
তারা নারীকে শত্রু মনে করেন। তারা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বলাৎকারের বিষয়ে কথাতো বলেনই না, কেউ বললে উল্টো তাকে নাস্তিক কাফের বানিয়ে দেন।
আব্বাস সিদ্দিকী ভাইজানের মত একজন নেতা আসুক মুসলমানদের মধ্যে। তাকে মওলানা ভাসানির মত হতে হবে না, যিনি ইসলামি সমাজতন্ত্রের কথা বলবেন না। যিনি সহজ কথা সহজভাবে বলবেন। যিনি সংবিধানে দেওয়া মানুষের গণতন্ত্র, মত প্রকাশ, রুটি রুজির কথা বলবেন।
তিনি এসবকে হারাম বলবে না বরং এগুলোকে অধিকার বলবেন। তার আগ পর্যন্ত মাদ্রাসায় হওয়া ধর্ষন নির্যাতন নিয়ে যারা কথা বলবে তাদেরকে মাওলানা সাহেবরা নাস্তিক বলতেই থাকবেন।
লেখক – সাংবাদিক