আমরা বিদেশে থেকেও দেশ নিয়ে ভাবি, আপনারা দেশে বসে কাজ করেন না কেন?

আমিনুল ইসলাম

আমরা তো এরপরও দেশ নিয়ে ভাবছি। কথা বলছি, লিখছি। আপনাদের সন্তানরা তো বিদেশে যায়, আরাম-আয়েশে থাকে। ভুলেও দেশের দিকে ফিরে তাকায় না। এরপর সময় মতো আবার দেশে ফিরে মন্ত্রী-এমপি বনে যায় বাপ-মায়ের পরিচয়ে! আপনারাই দেশপ্রেমিক!

আমিনুল ইসলাম:

এক আলোচনা অনুষ্ঠানে কথা বলছি। সাথে আছেন একজন বর্তমান এবং সাবেক সাংসদ।

আলোচনার বিষয়- আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।

দিন দুয়েক আগের কথা। দুই সাংসদ তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলছিলেন। আমার যখন কথা বলার সুযোগ হলো, নানান সব সমালোচনা করেছি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে।

আমি তো আর রাজনীতি করি না। তাই রাজনীতিবিদ’দের সমালোচনা করে বলেছি- অন্তত শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি কইরেন না আপনারা।

তো, এই দুই সাংসদের সেটা পছন্দ হবে কেন! এদের মাঝে এক সাংসদ সরাসরি আলোচনা অনুষ্ঠানে আমাকে বলে বসেছে

– আপনি অত্যন্ত মেধাবী একজন মানুষ। এমন মেধাবী মানুষ তো চাইলেই দেশে পাওয়া যায় না। এই দেশ আপনাকে তৈরি করেছে। আপনি এই দেশের প্রোডাক্ট। এই যে রাজনীতিবিদদের এতো সমালোচনা করছেন; আপনি নিজে দেশে আসছেন না কেন?

প্রথম বিষয় হচ্ছে আমি মেধাবী নই। আমি নিজেকে মোটেই মেধাবী মনে করি না। আশপাশে প্রায় সবাইকে-ই আমার চাইতে বেশি মেধাবী মনে হয় অন্তত আমার নিজের কাছে। এখন তারা কেন ভালো কিছু করতে পারছে না; সেটা অন্য আলোচনা। এই লেখায় অন্তত সেই আলোচনা করতে চাইছি না।

ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডিতে অনিয়ম, তদন্ত কমিটি গঠন

তো, গতকাল পত্রিকায় পড়লাম- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টে লেকচারার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সেখানে বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে পিএইচডি করা পাঁচজন আবেদন করেছিল।

সেই সাথে প্রথম শ্রেণী’তে প্রথম হওয়া একজনও আবেদন করেছিল। এদের কাউকে না নিয়ে এরা নিয়েছে পিএইচডি ছাড়া একজনকে। যে কিনা দশম স্থান অধিকার করেছে!

তো, শিক্ষকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে

– আপনারা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা কাউকে না নিয়ে, প্রথম শ্রেণী’তে প্রথম হওয়া’কে না নিয়ে দশম হওয়াকে নিয়েছেন কেন?

উত্তরে এক শিক্ষক বলেছে

– পিএইচডি করা একজন এর মাঝেই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছে। তাকে নেয়ার তো কোন মানে হয় না।

কেউ কি আমাকে বলবেন- এর মানে’টা আসলে কি?

কেউ কি চাইলে সহকারী অধ্যাপক পদে থেকে প্রভাষক হিসেবে আবেদন করতে পারবে না?

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন আইনে সেটা আছে?

তাছাড়া অন্য চারজন কি দোষ করলো! তাদেরকে কেন নেয়া হলো না?

আরেক শিক্ষক বলেছে

– ভালো রেজাল্ট থাকলেই যে প্রার্থী’কে নিতে হবে এমন তো কোন নিয়ম নেই!

কেউ কি আমাকে বলবেন- তাহলে ঠিক কিসের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে?

৫ বছর সুইডেনে থেকে পড়াশুনা শেষ করে আমি যখন ১২ বছর আগে একবার দেশে গিয়েছিলাম, তখন আবেদন করেছিলাম বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই জায়গা থেকেই আমাকে কি বলা হয়েছিলো জানেন?

– আপনি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়েননি! আপনি এখানে আবেদন করেছেন কেন? আপনি গিয়ে সিলেটে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করুন!

ঠিক বুঝতে পারছি না- উনারা কেন এইসব বিষয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি’তে লিখে দেয় না। তাহলেই তো আর আমরা আবেদন করবো না।

যদিও আমি মোটেই মেধাবী নই। এরপরও তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম আমি মেধাবী। এখন যেই সাংসদ আমাকে বলেছেন

-আপনি দেশে আসছেন না কেন? আপনার মতো মেধাবীর তো উচিত দেশে এসে দেশের জন্য কাজ করা। মেধাবীরা সবাই চলে গেলে আমরা এগুবো কিভাবে?

কেউ কি আমাকে বলবেন- বাংলাদেশে আসলে মেধাবী কারা?

যেই ছেলেটা দশম হয়ে শিক্ষক হলো; তাকেই তো সবাই মেধাবী হিসেবে জানবে এরপর থেকে।

দশম হয়ে শিক্ষক হয়ে যাওয়াকেও আমি আসলে খারাপ হিসেবে দেখছি না।

সমস্যাটা কোথায় জানেন?

এই ছেলেটা যদি নিজ যোগ্যতায় দশম হয়েও শিক্ষক হতো; কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু সে কি আদৌ নিজ যোগ্যতায় শিক্ষক হয়েছে?

যেহেতু সে নিজ যোগ্যতায় শিক্ষক হয়নি; এরপর তার কাজ হবে হুজুর হুজুর করা।

যেই সাংসদ আমাকে “মেধাবী” বলছিল; সেই সাংসদ’কে কিন্তু আমার সমালোচনা শুনতে হয়েছে। যাকে বলে- ক্রমাগত সমালোচনা।

কিন্তু যেই ছেলেটা এভাবে শিক্ষক হয়ে যাচ্ছে- সে কি আদৌ পারবে কোন কিছুর সমালোচনা করতে? তার মেরুদন্ড তো শুরুতেই ভেঙে গিয়েছে কিংবা ভেঙে দেয়া হয়েছে।

তো মেরুদণ্ডহীন মানুষটা যাদের শিক্ষা দেবে; তারা কি আদৌ মেরুদন্ড সোজা রেখে কথা বলতে পারবে?

ফলাফল- একটা মেরুদন্ডহীন, মেধাহীন জাতি।

লেখকঃ শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

এস্তেনিয়া প্রবাসী