রোজিনা’র বিরুদ্ধে এজাহারের আইনি যৌক্তিকতা কতটকু?

রোজিনা ইসলাম

রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আমি দেখেছি এবং মামলার বিস্তারিত পড়েছি সেটিতে আমি অভিযোগকারীদের পক্ষে কোনো মেরিট দেখিনা। এক কথায় এটাই আমার অবস্থান।

আমার দৃষ্টিতে এই মামলা অত্যন্ত দূর্বলভাবে ড্রাফট করা হয়েছে, জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে এবং একইসাথে সরকারী কর্মচারী ও কর্মকর্তারা নানানভাবে আইন ভেঙ্গেছেন বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।

এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমার প্রথমেই চোখ চলে গেছে সময়ের দিকে। বলা হচ্ছে মিসেস রোজিনা দুপুর ২ টা ৫৫ মিনিটে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের সচিব মহোদয়ের একান্ত সচিবের দপ্তরে প্রবেশ করেন।

কিন্তু আমরা পরবর্তীতে দেখতে পাই এই প্রবেশের প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘন্টা পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং এরপর আরো কিছু ঘন্টা পরে মামলা হয়।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৫ থেকে ৬ ঘন্টা তাঁকে যে আটকে রাখা হলো, কোনো যথোপোযুক্ত অথরিটির হাতে সোপর্দ করা ছাড়া, সেটা কোন আইনের প্রেক্ষিতে বা কোন নিয়মে কিংবা কোন ক্ষমতাবলে।

ইনফ্যাক্ট প্রশ্ন উঠতে পারে সাংবাদিক রোজিনাকে আটকে রাখাকে আমরা ‘False Imprisonment’ তত্ব দিয়ে আলোচনাকরবো কিনা। এই তত্বের ক্ষেত্রে স্পস্ট বলা হচ্ছে যে-

A a person commits false imprisonment when he commits an act of restraint on another person which confines that person in a bounded area.

তিনটি উপাদান থাকতে হবে এই ক্ষেত্রে। অভিযুক্ত ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে-

(১) intending to confine the plaintiff without the plaintiff’s consent and without authority of law

(২) the defendant’s act causes the plaintiff’s confinement

(৩) the plaintiff is aware of his/her own confinement

আমরা আলোচ্য রোজিনার ক্ষেত্রে উপরের তিনটি উপাদানের দেখা পাই এখন পর্যন্ত সমস্ত পত্র-পত্রিকার যে তথ্য, ইনফ্যাক্ট খোদ এজাহারে যে তথ্য রয়েছে সেটির মাধ্যমে।

কাউকে অবৈধভাবে আটকে রাখা বাংলাদেশের দন্ডবিধি অনুযায়ী একটা অপরাধ। বাংলাদেশের দন্ডবিধির ৩৪২ ধারায় এই অপরাধ সম্পর্কে পরিষ্কার লেখা রয়েছে-

Punishment for wrongful confinement

342. Whoever wrongfully confines any person, shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to one year, or with fine which may extend to one thousand taka, or with both.

এজাহারে বলা হচ্ছে- ওইখানে দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার মোঃ মিজানুর রহমান খান নাকি দেখেছেন যে রোজিনা ইসলাম রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথির ছবি তাঁর মোবাইল-এর ক্যামেরা দিয়ে উঠাচ্ছিলেন।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার কি একান্ত সচিবের রুমে ডিউটি করেন? সেখানে কি তিনি টহল দেন? আমি এই ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে জানতে চাই।

আমি যদি ধরে নেই যে তিনি টহল দিচ্ছিলেন এবং ছবি উঠাতে দেখেছেন, আমার পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে তিনি যদি দেখেই থাকেন যে ছবি উঠাচ্ছেন, তাহলে আমি তাঁর কাছে জানতে চাইবো কয়েকটি প্রশ্ন।

(১) আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন এইসব ছবির কথা? মোবাইল ফোন চেক করার মাধ্যমে?

(২) যদি উত্তর হ্যাঁ হয়ে থাকে, তাহলে আমি জানতে চাইবো একজন ব্যাক্তির মোবাইল চেক করবার যে পদ্ধতিগুলো রয়েছে সেগুলো তিনি মেইন্টেইন করেছেন কিনা?

(৩) যদি উত্তর হ্যাঁ হয়ে থাকে, তাহলে জানতে চাইবো সেই পদ্ধতিগুলো কি কি ছিলো?

আমি এই প্রশ্ন তিনটি করেছি কয়েকটি কারনে। কারন এজাহারের মধ্যে স্পস্ট লেখা রয়েছে রোজিনা ইসলাম নাকি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নথি তাঁর শরীরে লুকিয়ে রেখেছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে শরীরের গোপন স্থানে যদি নথি লুকিয়ে রাখেন রোজিনা, তাহলে পুলিশের এই কমিশনার সেটা কিভাবে জানলেন?

গোপন নথি তো মিজানের দেখার কথা না। গোপন-ই থাকার কথা। কারন এজাহারে বলা নেই যে মিজান কিভাবে সেই লুকিয়ে থাকা নথি দেখতে পেলেন।

আমরা এই এজাহারের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে কয়েকজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সেই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং এর মধ্যে জেবুন্নেসা নামের এক মহিলা (উপসচিব) রোজিনার শরীর ও মোবাইল তল্লাসী করেন।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আইন অনুযায়ী জেবুন্নেসা’র কি এমন শরীর তল্লাসি করবার কোনো ধরনের জুরিসডিকশান রয়েছে কিনা? সচিবালয়ের ভেতরে কোনো ধরনের অকারেন্স হলে সেটি ডিল করবার জন্য নির্দেশনা থাকে।

বেসিক আইনী ধারায় চিন্তা করে এইটুকু পরিষ্কারভাবে বলা যেতে পারে যে একজন উপসচিব কোনোভাবেই একজন ব্যক্তির শরীরে হাত দিয়ে বা তাঁর মোবাইলে বিনা অনুমতিতে হাত দিয়ে তল্লাসী করতে পারেন না। তাঁর সেই এখতিয়ার-ই নেই।

এবার আরেকটি প্রশ্ন এখানে এসেই যাবে যে, রোজিনা ইসলাম কি অনুমতি ছাড়া সেই কক্ষে বসেছিলেন? একজন একান্ত সচিবের কক্ষে অনুমতি ছাড়া একজন সাংবাদিক, তাও প্রথম আলোর এমন একজন সাংবাদিক অনুমতি ছাড়া বসে থাকেবন, এটা কি আসলেই বিশ্বাসযোগ্য কথা?

তারপর আবার প্রশ্ন এসে যাবে, রোজিনা ইসলামকে যদি অপরাধ করেছেন এই সন্দেহে অভিযুক্ত করাই হয়, তাহলে সেটির জন্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এই ঘটনায় প্রথমেই তাঁর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানাবেন এবং আইনী ভাবে যে স্টেপ নেয়ার সেটি নেবেন।

মহিলা পুলিশের অনুপস্থিতে একজন উপ্সচিব পুলিশ অফিসারের সামনে একজন ব্যক্তির শরীরে তল্লাসী করলেন, হাত দিলেন, তাঁর মোবাইল নিয়ে সেটা চেক করলেন এগুলো প্রত্যেকটি ফৌজদারী অপরাধ।

আমি প্রাপ্ত ঘটনার যত বর্ণনা, ছবি ও ভিডিও পেয়েছি সেটার প্রেক্ষিতে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি এখানে উপস্থিত প্রত্যেকটি সরকারী কর্মচারী আইন ভেঙ্গেছেন ও বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে তাঁরা অবস্থান নিয়েছেন। আমাদের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার করে বলা রয়েছে-

নাগরিক ও সরকারী কর্মচারীদের কর্তব্য

২১৷ (১) সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিকদায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য৷

(২) সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য৷

এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, এই মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা আইন ভেঙ্গেছেন ও সংবিধানকে অমান্য করেছেন।

অনেকেই প্রশ্ন করবেন যে, সাংবাদিক রোজিনা কি তাহলে সরকারী নথি চুরি করেনি? তিনি অন্যায় করেনি? ট্রেসপাস করেনি? তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো কি সত্য নয়?

আমি উত্তরে বলবো, এখন পর্যন্ত রোজিনা আমার কাছে নির্দোষ ও নিরপরাধ। কেননা তাঁর নামে যেসব অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে এবং তাঁর এই মামলা নিষ্পত্তি হবার আগ পর্যন্ত (যদি দোষী সাব্যস্ত হন) তিনি পরিষ্কারভাবে নিরপরাধ। মানে আইনের বিখ্যাত দর্শন ‘ইনোসেন্ট আনটিল প্রুভেন গিলটি’।

ফলে তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তার কোনো প্রমাণ এখনো পাইনি এবং তিনটি যে অপরাধী সেটার পক্ষে আমি কিছুই পাইনি। আদালতে তিনি যদি দোষী প্রমাণিত হয়ে থাকেন, তাহলে তখন তাঁকে আমি অপরাধী বলতে পারি কিন্তু তার আগে অবশ্যই নয়।

সাংবাদিক রোজিনা গত বেশ কিছুদিন ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দূর্নীতি নিয়ে ক্রমাগত লিখেছেন এবং সেটির কারনেই হতে পারে তার প্রতি এই সচিবালয়ের এত রাগ আর ক্ষোভ।

– ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার
আইনজীবী