‘প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ কথাটাতে প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে

ফিরোজ আহমেদ, প্রাবন্ধিক, রাজনীতিক

বাংলাদেশের নামের সাথে গণপ্রজাতন্ত্রী কথাটা একসময়ে সহজে মেনে নিতে পারলেও এখন অস্বস্তি বাড়ছে দিনে দিনে। আগে নিজেকে মানিয়ে নিতাম প্রজা শব্দটার সাথে, ভাবতাম তন্ত্রটা যদি প্রজাদের হয়, তেমন একটা প্রজাদের তন্ত্রে তো রাজা থাকেই না।

কিন্তু একাত্তর পরবর্তী নানান কিছু পড়তে গিয়ে প্রায়ই যেটা খেয়াল করি, বাংলাদেশের তাৎপর্যকে কোন শব্দগুলো দিয় প্রকাশ করা হবে, এটা কি একটা বিপ্লব নাকি শুধু রাষ্ট্রের বদল, এর নাম কী হবে– এগুলোর মাঝে একটা গভীর মানসিক ও বোঝাপড়ার লড়াই ছিল। এখানে তিনটা পক্ষ ছিল।

বৃটিশদের তৈরি করা যে আমলাতন্ত্র সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানকে শাসন করেছে গোটা কাল জুড়ে, মুক্তিযুদ্ধে তাদের একাধিপত্য খানিকটা টোল খেলেও তারা দ্রুত গুছিয়ে নিচ্ছিল। যে “দ্রুত বড়লোক হওয়ার” মানসিকতা সম্পন্ন সামাজিক শ্রেণিটির প্রতিনিধিত্ব করতো আওয়ামী লিগ, তাদের সাথে আমলাতন্ত্রের একটা ক্ষমতার টানাটানি থাকলেও যে শক্তিটা মুক্তিযুদ্ধে জেগে উঠেছিল, তার বিরুদ্ধে তাদের উভয়ের স্বার্থ ছিল এক।

ফলে এই দুই পক্ষের দিক থেকে বারংবার চেষ্টা ছিল মুক্তিযুদ্ধটাকে বিপ্লব হিসেবে না দেখাবার, বা এই প্রশ্নটাতে নীরব থাকবার চেষ্টা করা। ফলে এই প্রথম দুই অংশের মাঝে দ্বন্দ্ব থাকলেও (একটা অংশ রাজনৈতিক অন্য অংশটা আমলাতান্ত্রিক) তৃতীয় অংশের মুখোমুখি দাড়িয়ে তারা ছিলেন একাট্টা।

১৯৬৯ সালে যে প্রবল শ্রমিক ও কৃষকের পরিচয় আমরা পাই ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে, তাকে আবারও ঘুম পাড়িয়ে রাখবার আকুতি মিলবে আইয়ুব খানের দিনলিপিতে, তিনি প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যাতে তারা বোঝে যে এই রাজনৈতিক আলোড়নকে এগিয়ে নিলে সেটা পরিণত হবে যাদের আছে আর যাদের নাই, তাদের মাঝেকার লড়াইয়ে, সেটা থামানো দুই পক্ষের জন্যই মঙ্গল। প্রজাতন্ত্র শব্দটা তাই একটা আপোষ, যাতে আরও বিপদজনক কিছুকে এড়ানো যায়।

তো এই তিন শ্রেণির প্রভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নামটা কী হবে, সেখানে কোন শব্দ ব্যবহার করা হবে, সেটার তাৎপর্য ছিল। প্রজা শব্দটা মালিকের পছন্দ, আর প্রজা হতে চায় নাগরিক। নাগরিকদের মাঝে আবার যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা চেয়েছির তাদের গরিষ্ঠতার স্বীকৃতি।

সংখ্যাল্পদের স্বার্থ ছিল তাদের আবারও রাজনৈতিকভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখা, এই বহুমুখী বিচিত্র দ্বন্দ্ব।

স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে চার মাস পর ১৯৭২ সালের ৩০ এপ্রিল মওলানা ভাসানী শিবপুরে বিশাল এক কৃষক সমাবেশে দাবি করেন বাংলাদেশের নাম হতে হবে “বাংলাদেশ কৃষক-মজুর রাজ”। খেয়াল করুন, মওলানা প্রজা শব্দটিকে ব্যবহার করেননি, বরং কৃষক শ্রমিকের রাজত্বে গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন।

উপনবেশের অবসান ঘটানো বিপ্লব আর পুরনো আমলাতান্ত্রিক শ্রেণিগুলোর রাজত্ব অটুট রেখে ধারাবাহিকতা চালানোর মাঝে পার্থক্য এইখানে। যখন একটা দেশে কৃষক কিংবা মজুরের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে রাষ্ট্রকে গড়ে তোলা হয়, তার স্বাস্থ্য-শিক্ষা-চিকিৎসা-সংস্কৃতি সব কিছুর মান উন্নত হতে থাকে অধিকাংশের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে, সেখানে স্থানীয পর্যায়ে গণতন্ত্র তৈরি হতে থাকে।

অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রকে ভয় পাওয়া যে সংখ্যালঘু অংশটি ক্ষমতা করায়ত্ত করে রেখেছিল এতদিন, নতুন স্বাধীন দেশেও তাদের রাজত্ব অটুট থাকলে তারা এমনকি উপনিবেশ আমলের চাইতেও বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠতে থাকে।

কায়েমী স্বার্থ হাতছাড়া হবার ভয়ে তারা রাজনৈতিক অংশকে কিছুটা ছাড় দিলেও সব মিলে তাদের লাভটা ঘটে বারো আনা। তাদের দুর্নীতির সুযোগ ও বাস্তবতা উপনিবেশ আমলের চাইতে বহুগুন বৃদ্ধি পায়। তাদের নিয়ন্ত্রণে ও প্রশ্রয়ে যে ধনীক শ্রেণি বিকশিত হয়, তারাও হয় লুণ্ঠনজীবী।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বঞ্চিত হয়। সম্পদ পাচার হয়। যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত গড়ে ওঠে, তার ওপর কোন ভরসা ক্ষমতাবানরাও রাখতে পারেন না সঙ্গতকারণেই। বাংলাদেশের সমসময়ে স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর তুলনায় বহু ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে পড়বার কারণ এটাই, একটা বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষার ডানা ছেঁটে সফলভাবে পরিণত করা হয়েছে একটা প্রজাতন্ত্রে।

এইসব চিন্তা ও কথাকে আজ অলীক ও দূরের শোনা গল্প বলে মনে হলেও ১৯৭১ তেমন একটা সময়, যখন মানুষের সক্রিয়তা জেগে উঠেছিল। প্রজা হতে নয়, নাগরিক হতে, সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে মানুষ লড়াই্ করেছিল।

বাঙালী জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করেছিল সেই অংশটা, যারা জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধি সাজা দল ও ব্যক্তিদের মাধ্যমে জনগণকে দাবায়ে রাখতে চাইছিল, জাতীয় বিকাশের উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করতে চেয়েছিল সেই অংশটা যারা সকলের মুক্তি চাইছিল।

একদল তাই জনগণকে প্রজা বানাতে চান, আরেকদল প্রজাতন্ত্র থেকে মুক্তি চান।

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানাই, মানুষের মুক্তির লড়াই অব্যাহত থাকুক।

লেখকঃ প্রাবন্ধিক