পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নতুন করে ভাবাচ্ছে!

আলী রিয়াজ

আলী রিয়াজ: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন যে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের সংঘটিত হত্যাকান্ডের দায় অংশত হলেও বাংলাদেশের নাগরিকদের।

তাঁর এই কথাগুলো নিঃসন্দেহে সকলের মনোযোগ দাবি করে। তিনি বলেছেন যে, “আমাদের লোকজন ওখানে বর্ডারের ভেতরে ঢুকে অনেক ভেতরে যায় এবং বন্দুক নিয়ে যায় গোলাগুলিও হয়, বোমও নিয়ে যায়। এটা আসলে একতরফা কিন্তু দোষ না, আমাদেরও কিন্তু দোষ। কারণ আমাদের কিছু দুষ্টু ব্যবসায়ীরা, এরা ওখানে ইললিগ্যালি (বেআইনিভাবে) যায় এবং তাদের কাছে অস্ত্রও থাকে, তখন ওরা বাধ্য হয় ভয়ে, ওদের গুলি করে ফেলে।’ তিনি বলেন, ‘এ জন্য ওখানে (সীমান্তে) ক্রাইম, ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটি একটু কমাতে হবে। কমেছে, কিন্তু আরও কমাতে হবে। আমাদের দিক থেকেও যথেষ্ট অ্যাকশন নিতে হবে। কারণ এই লোকগুলোকে উস্কানি দেয়। ওখানে আবার লোকাল (স্থানীয়) কিছু লোকের সঙ্গে এগুলোর সম্পর্ক আছে’” (দৈনিক আমাদের সময়, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০)। বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসেএফ’এর হত্যা নিয়ে একই সংবাদ সন্মেলনে তিনি এও বলেছেন যে, “‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার করেছেন সীমান্তে কোনও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না।’ আমরা তাদের বিশ্বাস করতে চাই। আমরা চাই না একজন লোকও সীমান্তে মারা যাক। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে এ ধরনের ঘটনা সময়ে সময়ে হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে এত সুন্দর সম্পর্ক। কিন্তু এগুলো সম্পর্কে কলঙ্ক তৈরি করে” (ইত্তেফাক, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০)।

ভারত যদিও অতীতেও এই ধরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং তা পালন করেনি, কিন্ত সেটা ভিন্ন সময়ে আলোচনা করা যাবে, কিন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে কারণ দেখিয়েছেন সেই কারণ এর আগে এমনকি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কখনোই বলেছেন বলে স্মরণ করা যায় না।

বাংলাদেশের নাগরিকরা সীমান্ত অতিক্রম ভারতের নিরাপত্তার জন্যে হুমকি হয়ে উঠেছেন বলেই কী বলা হচ্ছেনা? কিন্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে কেনো আগে বলেননি বা এখন কেন এই দিকেই আলোচনা ধাবিত হচ্ছে সেটা বিবেচনা করা দরকার। এটাও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে যে এই নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানে কোন ধরণের বদল ঘটছে কীনা। কেননা এই বছরের গোড়াতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিন্ন ধরণের কথা বলেছিলেন। ১৮ জানুয়ারি তিনি বলেন, “‘আমাদের নীতি হচ্ছে, সীমান্তে যাতে একজনও মৃত্যুর সম্মুখীন না হয়। ভারত সরকার সেটাতে রাজি হয়েছে। অর্থাৎ আমরা চাই, সেখানে একজনও মারা যাবে না। কিন্তু হচ্ছে।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি ভারতকে জানাব। সীমান্ত হত্যা বন্ধ নিয়ে আমাদের কাছে যে অঙ্গীকার তারা করেছিল, সেটা তাদের পূরণ করতে বলব’” (প্রথম আলো, ১৮ জানুয়ারি ২০২০)।

বাংলাদেশ সরকার সব সময়ই বলে এসেছে যে তাঁরা এই বিষয়ে ‘উদ্বিগ্ন’ এবং বহুবার এই বিষয়ে ভারতকে ‘অবহিত’ করেছে বলেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এটাও ঠিক যে, সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের জন্যে আন্ত র্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ভারতীয় বাহিনীকে দায়ী করলেও বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যে ভিন্ন ধরণের মনোভাব আছে তা আগেও শোনা গেছে।

এই বছরের জানুয়ারিতে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, “আমরা ভারত থেকে গরু আনতে দেব না। এ জন্য আমাদের উপজেলা ও জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি এবং বিজিবির রেজ্যুলেশন করা হয়েছে। এরপরও কেউ যদি জোর করে কাঁটাতারের বেড়া কেটে গরু আনতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা যায়, তার দায়দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার নেবে না” (ডেইলি স্টার, ২৫ জানুয়ারি ২০২০)। খাদ্যমন্ত্রী অবৈধ বানিজ্য বা চোরাচালানকে দায়ী করেছিলেন, কিন্ত তিনি বলেননি যে এর একটি নিরাপত্তার দিক আছে।

প্রথম দায়ভারের তীর বাংলাদেশীদের দিকে ফেরানোর পরে এখন মনে হচ্ছে সেটাকে সিকিউরিটাইজ করার দিকেই আলোচনাটি এগুচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসেব অনুযায়ী ২০১৯ সালে ৪১ জন মারা গেছেন, ৪০ জন আহত হয়েছেন, অপহৃত হয়েছেন ৩৪ জন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো যথাক্রমে ১১, ২৪ এবং ১৬ জন।

ভারতের এক শ্রেনীর নিরাপত্তা বিশ্লেষক অনেক দিন ধরেই সীমান্ত প্রসঙ্গকে নিরাপত্তা হুমকির সঙ্গে যুক্ত করে আসছিলেন (উদাহরণ আনন্দ কুমার, স্ট্রাটেজিক এনালাইসিস, ভল্যুম ৩৫, সংখ্যা ১০, ২০১০)।

এতদিন এগুলো বাংলাদেশ থেকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশের’ সঙ্গে যুক্ত করা হতো, অর্থাৎ ‘স্থায়ীভাবে’ যারা যাচ্ছেন তাঁদের ব্যাপারে। ক্ষমতাসীন বিজেপি এই ধরণের কথা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে। সেই প্রেক্ষাপটেই নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের এবং ‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়া’ লোকদের নাগরিকত্ব দেয়ার কথা বলার সঙ্গে তাঁদের এই সব ‘নিরাপত্তা হুমকি’র কথার মধ্যে একটা দৃশ্যত বিরোধ আছে। ভারতে এস্টাব্লিস্টমেন্টের একটি অংশ বাংলাদেশকে নিরাপত্তার প্রিজম দিয়েই দেখেন এবং সেইভাবেই নীতি নির্ধারন করেন, বিজেপি’র অবস্থান তা থেকে ভিন্ন নয়। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য এক ধরণের নতুন মাত্রা নেয়। একে নেহাত কথার কথা বলে বিবেচনা করা যায়না। ভবিষ্যতে যদি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যদি বাংলাদেশের পর রাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে ভারত এই কথা বলে যে, সীমান্তে তাঁদের বাহিনীর হত্যা তাঁদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন তা হলে বাংলাদেশ কী আপত্তি জানাতে পারবে?

লেখকঃ অধ্যাপক
সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি