নেতার প্রধান গুণ বুদ্ধিদীপ্ত এবং কৌশলী নেতৃত্ব

একজন নেতা যেমন তার বুদ্ধিদীপ্ত এবং কৌশলী নেতৃত্বে দেশকে শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির শিখরে নিতে পারে, তেমনি অযোগ্য কেউ নেতা হবার সুযোগ পেয়ে পুরো জাতিকেই কালের গহীন অন্ধকারে ডুবিয়ে পিছিয়ে দিতে পারে কয়েক’শ বছর।

উপমহাদেশের কালচারে অভিনেতা-অভিনেত্রী, সঙ্গীতশিল্পী বা কোনো সেলিব্রিটি খেলোয়াড় তাদের বিপুল জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে ‘রাজনৈতিক নেতা’ বনে যাওয়া এখন ডালভাত ব্যাপার। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ভুরাজনীতি, সমরনীতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকলেও বা দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার না থাকলেও অনায়াসেই নেতা হয়ে দাপিয়ে বেড়াতে পারে।

যোগ্য হলে সমস্যা নেই। কিন্তু অপরিপক্ক কারো হাতে দেশের নির্বাহী ক্ষমতা চলে গেলে তখন উপায়?

“এয়ারফোর্স ওয়ান” চলচ্চিত্রে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় অভিনেতা হ্যারিসন ফোর্ড যদি ছবির পুরো টিমসহ “এয়ারফোর্স ওয়ান” নামেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে বিপুল ভোটে জিতে সত্যিই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যেতেন? কিংবা কমেডিয়ান মিঃ বিন খ্যাত রোয়ান অ্যাটকিনসন, বা জিম ক্যারি?

প্রচণ্ড আবেগি এবং ব্যাপক দুর্নীতি থেকে বাঁচতে চাওয়া ইউক্রেনিয়ানদের কাছে আইনের ডিগ্রীধারী কৌতুক অভিনেতা মিঃ জেলেনস্কি ঠিক এভাবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। “সারভেন্ট অফ দ্যা পিপল” বা “জনগণের চাকর” নামে জনপ্রিয় কমেডি সিরিয়ালের কেন্দ্রিয় চরিত্রের অভিনয়ে তিনি একজন স্কুলশিক্ষক থেকে দুর্নীতিবিরোধী ভাষণ ভাইরাল হবার মাধ্যমে একসময় প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বনে যান।

এরপর মিঃ জেলেনস্কি বাস্তব জীবনেও ঐ সিরিয়ালের নামেই রাজনৈতিক দল গঠন করেন তার পুরো টিম এবং প্রযোজনা সংস্থা মিলে!! একদিন বিপুল ভোটে জিতে অভিনেতা প্রেসিডেন্ট থেকে ইউক্রেনের সত্যিকারের প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হয়ে যান তিনি।

স্ক্রিপ্ট-ওয়াইজ প্রেসিডেন্টের অভিনয় করা আর বাস্তবে রাষ্ট্রনায়ক হওয়া যে এক জিনিস না, এইটা হয়তো মিঃ জেলেনস্কি কিছুতেই বুঝতে চাইবেন না।

“হাউ টু ডিল উইথ আ ডেমন নেইবার ১০১” কোর্সটিও হয়তো ঐ টিভি সিরিজের স্ক্রিপ্টে ছিল না, ছিল না যুদ্ধের কোনো স্ক্রিপ্ট! ফলে বাস্তব জীবনে যুদ্ধ শুরুর উপক্রম হলে অসম যুদ্ধটি যেকোনো মূল্যে ঠেকাতে কি কি করতে হবে, তাও তিনি বোঝেননি।

শুধুমাত্র রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবে নিজের ইগো আর গোঁয়ার্তুমিকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি পুরো জাতিকে পেট্রোল বোমা হাতে যুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছেন।
অপরাধীদেরকে জেল থেকে মুক্ত করে হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে তিনি নিশ্চয়ই পৃথিবীর সেকেন্ড মোস্ট পাওয়ারফুল এবং ব্রুটাল আর্মির মোকাবেলা করার সাহস দেখানোর মতো বলদামি করতে পারেন না!!

যখন রাশিয়ান ট্যাঙ্কগুলো কিয়েভের দিকে সাইলেন্ট কিলার হয়ে ছুটে আসছে, তিনি তখন পিছনে তাকিয়ে ডাকাডাকি শুরু করলেন, পৃথিবীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন!!! কিন্তু কেউই এলো না উনার স্বপ্ন পূরণ করতে। অর্থাৎ, কারা এগিয়ে আসবে কারা আসবেনা, এই বিষয়ে উনি পুরোপুরিই অজ্ঞ ছিলেন।

নিজের দেশের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা নাজুক জেনেও উন্মত্ত প্রতিবেশির সাথে শাপে-নেউলে সম্পর্ক বজায় রাখলে সেটা যে কতোটা সুইসাইডাল হতে পারে, তা ভাবার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তার ছিল না। মনে হচ্ছে এখনও যেন তিনি কোনো ডিরেক্টরের তৈরি স্ক্রিপ্টে অভিনয়ই করে যাচ্ছেন!!!

বান্দরের হাতে কালাশনিকভ থাকলে আপনি সাবধান হবেন, নাকি বান্দরকে উল্টো খোঁচাবেন? কালাশনিকভ হাতে নিয়ে বান্দর নিশ্চয়ই কান চুলকাবে না!! পুতিন যে আগেও ঘোষণা দিয়ে অনেককে গিলে খেয়েছে তা কি জেলেনস্কি জানতেন না? পরাশক্তি প্রতিবেশীর সাথে সমঝোতার কোনো চেষ্টাও কি তিনি করেছিলেন?

তার বাড়ির উঠোনে এখন লাশের স্তুপ। এই দায় তিনি কিভাবে এড়াবেন?

নিরীহ জনগণকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে উনি উনার স্বপ্নের ন্যাটোতে যোগ দিয়ে ন্যাটোকেই কতোটুকু শক্তিশালী করবেন, আর নিজের দেশকেই বা কতোটুকু নিরাপদে রেখে ঘুমাতে পারবেন?!!

তার কথিত বন্ধুরা যে ইউক্রেনের নাক কেটে রাশিয়ার যাত্রা ভঙ্গ করতে চাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট হয়েও এটা যে বুঝতে পারেনি, সে আর যাই হউক মহানায়ক বা হিরো হতে পারে না!!! প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছেড়ে তার আবার কমেডি শো’তেই ফিরে যাওয়া উচিত।

একটা স্বাধীন দেশে ঘোষণা দিয়ে হামলা চালিয়ে রাশিয়ার পুতিন অবশ্যই মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে এইটা যেমন সত্যি, সুইসাইডাল এই যুদ্ধও অবশ্যই এড়ানো যেত, সেটাও সত্যি!


ন্যাটোও পারতো আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে জেলেনস্কিকে থামাতে, ইইউও পারতো, আর জেলেনস্কি নিজেই তো পারতো নিজের মাতৃভূমি বাঁচাতে।

কেউই আন্তরিকভাবে চায়নি, দুই-পয়সার পুতিনের কথার পাত্তা দিতে চায়নি, তাই যুদ্ধও এড়ানো যায়নি। এখন এই লাখ লাখ যুদ্ধ শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ কি? জেলেনস্কি, পুতিন, বাইডেন এদেরকে খাওয়াবে-পরাবে?

পৃথিবীতে অনেক নেতার সুযোগ্য নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা এসেছে, আবার অনেক রাসট্রনায়কের গোঁয়ার্তুমি আর অযোগ্য নেতৃত্বে গোটা স্বাধীন দেশ দখল হয়ে মাটির সাথে মিশেও গেছে। ইতিহাস তাই বলে।

জেলেনস্কি

লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে হলেও ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ পেতে চেয়েছিল, ইতিহাসে এটি কেমন শোনাবে?

আমি রাজনীতিবিদ বা সমরবিশারদ নই, তবে একটা স্বাধীন দেশকে নিজের চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেখেও যেই নেতা ফেসবুক লাইভে এসে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে একটা অসম যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেই থাকে, লাশ দেখতেই থাকে, তাকে কখনোই মহানায়ক ভাবতে পারি না। বরং তাকে রং-হেডেড, পাপেট বা শ্রেফ একটা কমেডিয়ানই ভাবতে চাই।

নতুন প্রজন্মের যারা ছাত্রনেতা থেকে ভবিষ্যৎ নেতা হতে চায়, তাদের সবার জন্য শিক্ষনীয় এই জেলেনস্কি। আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখতে পরাশক্তি প্রতিবেশী দেশের সাথে কেমন সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত, প্রতিবেশী বদ্ধউন্মাদ হলে আপনার আচরণ কেমন হওয়া উচিত, বন্ধু আর শত্রু চেনার উপায়, নিরপেক্ষতা কেন দরকার, সবই শিক্ষণীয়।

দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম করে নেতৃত্ব পেয়েও অনেকে ভুল করে, সেখানে একজন আনাড়ি মানুষ কৌতুক অভিনেতা থেকে নেতা হবার সুযোগ পেয়ে পুরো দেশকে পুরো বিশ্বকে বিপদের মধ্যে ফেলে নির্বিকার থাকবেন, সেটিই তো স্বাভাবিক!!

আফসোস শুধু একটাই!! রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়!!

০৬/০৩/২০২২, জার্মানি।