ইসরাইলি পণ্য ক্রয় নিয়ে বিশ্লেষণ

সানজিদা হক: আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ আর্মি বা প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তর ক্রয় করেছে কি না খতিয়ে দেখতে এবং সম্পূর্ণ বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে চাইলাম। এই অভিযোগটি খতিয়ে দেখা আমার নাগরিক দায়িত্ব মনে করে করার চেষ্টা করলাম। কারণ বাংলাদেশ আর্ম তৈরি হয়েছে আমার নিরাপত্তার জন্য। আমার ভাইরা সেখানে সততা ও সম্মানের সাথে দায়িত্ব পালন করে।

প্রথমেই আমি প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তরের প্রকাশিত টেন্ডার সংক্রান্ত নেটিশ থেকে অভিযোগকৃত টেন্ডার বিষয়ে নিশ্চিত হতে চাইলাম। প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তরের ওয়েবসাইট ঘেটে ডকুমেন্টে উল্লেখ করা ২৬ জুন ২০১৮ তারিখের কোনো ডকুমেন্ট খুজে পাইনি। আমি ওই তারিখ হতে পরবর্তী কয়েকমাস চেক করেছি। তাহলে কী আগে হল? তাও নাই।

তাহলে কী আল জাজিরা ভুয়া ডকুমেন্ট দেখালো? আমি পূর্ববর্তী কয়েক মাস চেক করে ২০-১-২০১৮ এর একটি দরপত্র খোলার তারিখ পেছানোর নোটিশ দেখলাম । যা প্রকাশিত হয়েছে ২২-১০২০১৮। যেটা ডকুমেন্টে বর্ণিত পণ্যের সাথে হুবহু মেলে। তার মানে এরকম টেন্ডার অবশ্যই হয়েছিল। জিনিসটি আলজাজিরার কল্পিত নয়।

কিন্তু নোটিশে উল্লিখিত তারিখের ২১৫.০৬৪.১৭ তারিখ ২৫-১-২০১৮ কোনো ডকুমেন্ট খুজে পেলাম না। টেন্ডার সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও রাখার বাধ্যবাধ্যকতা রয়েছে। সকল সরকারি দপ্তরের ওয়েব সাইটে গেলেই খুজে পাবেন। কেন এই ডকুমেন্ট নির্ধারিত তারিখের আগে পরে খুজে পেলাম না? হয় আমার অজ্ঞতা বা খেয়ালের অভাবে।

নয়তো টেন্ডার নোটিশ, ইভালুয়েশন নোটিশ, কার্যাদেশ কেন ওয়েব সাইটে নাই তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাচ্ছি। যেটা পেলাম তার ছবি দিলাম। এতে ফাইলের নাম্বারও আছে। সবাইকে সংগ্রহে রাখার আমন্ত্রণ রইল। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে হুবহু শিরোনামে ২৫-১-২০১৮ তারিখে টেন্ডার হয়েছিল।

আরও নিশ্চিত হওয়া যায় মালামাল ক্রয়ের শিরোনামটি আল জাজিরা উদ্ভাবিত নয়। টেন্ডার যদি বাতিলও হয় তবু পরবর্তী এবং পূর্ববর্তী নোটিশ থাকবে। কিন্তু টেন্ডার বাতিলের নোটিশও নাই। হয়তো ক্রয় মহাপরিদপ্তরে গেলে পাওয়া যাবে। (https://dgdp.gov.bd/dgdp/AP_TEN/notice/399.pdf)

বাংলাদেশ আর্মি যা বলেছে: প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানী থেকে ক্রয়কৃত সিগন্যাল সরঞ্জামাদিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘ইসরায়েল থেকে আমদানিকৃত মোবাইল মনিটরিং প্রযুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। (https://www.facebook.com/bdarmy.army.mil.bd/বাংলাদেশ আর্মি নিশ্চিত করছে যে হাঙ্গেরি থেকে কিছু একটা কেনা হয়েছে। )

জাতিসংঘ: আল জাজিরার প্রতিবেদনে যেসব ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তার প্রয়োজনীয়তার কথা জাতিসংঘের কোন চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়নি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের বাংলাদেশ সৈন্যদলে এ ধরনের সরঞ্জামও রাখা হয়নি। (https://www.bbc.com/bengali/news-55963023)

আল জাজিরায় দেখানো টেন্ডারে স্পষ্ট উল্লেখ আছে cell phone passive monitoring, interception and analysis. যা আক্ষরিক অর্থে সাধারণ মিলিটারি যোগাযোগের সামগ্রি নয়। এটা দিয়ে সেল ফোন নেটওয়ার্ক গোপনে (পেসিভ) মনিটার করা যাবে, ধরা যাবে এবং বিশ্লেষণ করা যাবে। সোজা বাংলায় আপনার আর টাওয়ারের মধ্যে ঢুকে মোবাইলে কী করছেন ধরতে পারবে এবং বুঝতে পারবে। এই যন্ত্রের সাথে জাতিসংঘের সিগনালের সম্পর্ক কী?

যেহেতু জাতিসংঘ স্পষ্ট অস্বিকার করেছে এবং টেন্ডারের তথ্য থেকেও দেখা যায় এটা স্পাই সামগ্রি অর্থাৎ সিগনাল সামগ্রি নয়। আর্মি তাহলে স্পষ্ট মিথ্যা বলেছে।

pic-six.com: স্পষ্ট করে বলছে ইসরাইলের গোয়ান্দাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তাদের ওয়েব সাইটে তাদের মূল প্রডাক্টগুলি কী কী তার সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। (https://www.pic-six.com/products/p6-fi5)
এই টেন্ডারে উল্লিখিত প্রডাক্টটি একমাত্র পিকসিক্স কম্পানি বানায়। সেখানে দেখানো হয়েছে কম্পানিটি হাঙ্গেরির। হাঙ্গারিতে কী এই নামে নিবন্ধিত কোনো কম্পানি আছে?

এরকম নামে কোনো কম্পানির নাম হাঙ্গেরিতে নাই। হাঙ্গেরি নয় বিশ্বে অন্য কোনো কম্পানি p6 intercept নামের কোনো প্রডাক্ট বানায় না। তাহলে এই নামের হাঙ্গারির কম্পানি কীভাবে টেন্ডারে ডকুমেন্টে দেওয়া হল এবং সাথে একই নামে প্রডাক্ট এবং মডেলের জিনিস কীভাবে আসলো?

দেখা যাক কী আছে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালায়:

  • ৪. (৫) কারিগরি বিনির্দেশসম‚ এমনভাবে প্রস্তুত করিতে হইবে যেন উহা অ-সীমাবদ্ধকর এবং পক্ষপাতহীন ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিতকরণে সহায়ক হয় এবং দরপত্র দলিলে অন্তর্ভুক্ত নকশার সহিত সংগতিপূর্ণ হয়।
  • ২৯. (৩) কারিগরী বিনির্দেশে কোন পণ্যের ট্রেডমার্ক বা পণ্যের ব্যবসায়িক নাম (trade name), পেটেন্ট, নকশা বা ধরন, নির্দিষ্ট উৎস দেশের নাম (country of origin), উৎপাদনকারী বা সেবা সরবরাহকারীর নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যাইবে না।
  • ২৯. (৪) উপ-বিধি (৩) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, যদি বিনির্দেশের সাধারণরূপ প্রস্তুতক্রমে উহা দরপত্রদাতাগণের নিকট সহজে বোধগম্য করিয়া উপস্থাপন করিবার জন্য ক্রয়কারীর পর্যাপ্ত কারিগরী দক্ষতা না থাকে, তাহা হইলে ক্রয়কারী কারিগরী বিনির্দেশে কোন সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্যের বিবরণ উল্লেখ করিতে পারিবে, তবে এই ক্ষেত্রে উহাতে “বা একইরূপ বা সমতুল্য” শব্দগুচ্ছ যোগ করিতে হইবে।
    (https://cptu.gov.bd/procurement-policy-and-procedure-documents/procurement-rules.html)

আইন থেকে আমরা কী বুঝলাম?

এই আইনের দ্বারা স্পষ্ট আপনি কোনো নির্দিষ্ট দেশকে কান্ট্রি অফ অরিজিনের কথা বলতে পারবেন না।
আপনি নির্দিষ্ট ব্রান্ড উল্লেখ করতে পারবেন না। যদি করতে হয় আপনাকে বলতে হবে সমমান বা একইরূপ। যাতে একই সুবিধা সম্পন্ন পন্য প্রতিযোগিতামূলকভাবে সরবরাহ করা যায়।

আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে অ-সীমাবদ্ধকর এবং পক্ষপাতহীন ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা । এই টেন্ডারের থেকে স্পষ্ট এটা শুধুমাত্র হাঙ্গারি থেকে সাপলাই করতে হবে। সেক্ষেত্রে লিমিটেড টেন্ডারিং করতে হবে। লিমিটেড টেন্ডারিং করতে হয় যখন সেই দেশের কাছ থেকে ঋণ বা এরকম কোনো আর্থিক চুক্তির সরবরাহ থাকে। খুবই স্পষ্টভাবে মালামালটি ক্রয় করা হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের বাজেট থেকে।

আপনি ক্রয় মহাপরিদপ্তরের আরও অন্য নতুন মালামাল ক্রয়ের নোটিশ দেখুন। এই বিধির প্রয়োগ সুস্পষ্টভাবে দেখবেন। তারমানে কান্ট্রি অফ অরিজিন উল্লেখ, সরাসরি মডেল উল্লেখ, এবং মিথ্যা কম্পানির নাম উল্লেখ হল অসৎ উদ্দ্যেশ্য নিয়ে। যা পিপিআর বিধিমালার সরাসরি লঙ্ঘন।

সুতরাং:
এখানে পিপিআর আইনের লংঘন হয়েছে। সুতরাং এর হোপ অর্থাৎ ক্রয় কর্মকর্তা, টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন তৈরিকারী কমিটি, মূল্যায়ণ কমিটি সবাই সুস্পষ্টভাবে অপরাধ করেছেন।

এই অপরাধের সাথে যুক্ত হবে ইসরাইলের পন্য ক্রয়ের অপরাধ। যে দেশের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক নাই তাদের পন্য বেনামে ক্রয় অবশ্যই রাষ্ট্রদোহীতা। এক্ষেত্রে সরল বিশ্বাসের কোনো সুযোগ নাই। হোপ থেকে শুরু করে কমিটি, ডেস্ক অফিসার সকলে এই বিষয়ে অবগত। ইন্টারনেটে কম্পানির তথ্য রয়েছে। এই ক্রয়ের সাথে সকলে এই অপরাধে অপরাধী হবেন।

সংবিধানে রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য সর্বচ্চ শাস্তি প্রদানের কথা বলা হয়েছে।
এই মাল কী কাজে ব্যবহার হবে? এটা কী নাগরিকদের উপর ব্যবহার হবে? আমাদের সংবিধান এবং আইন কী আমাদেরকে সার্ভেইলেন্সএর হাত থেকে কোনো সুরক্ষা দেয়? এই বিষয়ে আপনাদের ইনভেস্টিগেশনের অপেক্ষায় থাকলাম।