আমরা কতিপয় নিলজ্জ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

২০২০ সালের পুরো বছরের একরকম বন্দি জীবনের সাথে সাথে ৫ মাসের মধ্যে আমার বাবা, শ্বশুর, ছোট ভাইয়ের শ্বশুর, চাচা, ভাবি, বোন, স্কুল বন্ধু , সহকর্মীর সন্তান, সহকর্মী, প্রিয় মানুষ সহ বেশ কয়েকজন নিকটজনকে চিরতরে হারিয়ে যে মানসিক কষ্টের মধ্যে দিন কাটছিল সেই কষ্ট ২০২১ সালের জানুয়ারির ১৮ তারিখে বহুগুণ বেড়ে গেল যখন জানলাম ছাত্রদের ন্যায্য অধিকারের দাবির সাথে সহমত প্রকাশের অপরাধে দুইটি বিশেষ সিন্ডিকেট সভা করে আমার তিনজন সহকর্মীর একজনকে বরখাস্ত এবং দুইজনকে অপসারিত করা হয়েছে চাকুরী থেকে।

করোনার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ ভাগ স্বাভাবিক কাজ নাহলেও খোঁড়া অজুহাতে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে চাকুরীচ্যুত করার প্রক্রিয়াটি ১০০ভাগ নিশ্চিত করা হয়েছে।

পুরো প্রক্রিয়াটির নৈতিক/ অনৈতিক দিক নিয়ে কিছুদিন ধরে বিভিন্ন গনমাধ্যমে বিস্তারিত খবর আসছে আর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে উঠে আসছে এই মহান কাজটি করার জন্য, যা অন্য কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখনো করতে পারেনি।

দুই দশকের অধিক শিক্ষকতা কালে সবসময় আমার ছাত্রদের নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ হওয়ার তাগিদ দিলেও ২০২১ সালের জানুয়ারির ১৮ তারিখের পর শিক্ষক হিসেবে আমার নৈতিকতাই আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

বৈধ বেতন-ভাতাদি পাবার পরও সামান্য আর্থিক সুবিধা এবং পদ-পদবির লোভ-লালসার বসবতি হয়ে, ন্যায়-অন্যায়, বিবেক ভুলে গিয়ে ভিসি ও তাঁর দোসরদের অবৈধ নিয়োগ- বাণিজ্য, ঠিকাদারি সহ নানাবিধ অনৈতিক কাজ এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা- প্রতিশোধ চরিতার্থ করার জন্য আমরা শিক্ষকরা নিলজ্জ ভাবে যতদূর নিচে নামছি তা অবৈধ জমি- বালু ব্যবসার অশিক্ষিত দালাল- মাস্তান্ দেরও হার মানাচ্ছে ।

ভাল মানুষের মুখোশের আড়ালে কখনো কখনো আমরা বিষধর গোখরা সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছোবল দিয়ে পুরো বিষ ঢেলে দেই আরেকজন সহকর্মীকে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক বাসায় ১১ বছরের বেশী সময় ধরে থাকছি, পুরো ক্যাম্পাসই দুই প্রজাতির বিষধর গোখরা সাপের বাসস্থান; প্রায়শই ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের সাপ রাত-বিরাতে চলাফেরার পথে দেখা যায় বা খালি বাসায় ঢুকে পড়ে।

জানামতে ভয়ে –আতংকে ৩০ এর অধিক বিষধর গোখরা বিগত ১০ বছরে মারা হলেও (যার কয়েকটি আমাদের ল্যাবে সংরক্ষিত আছে) আজ অবদি সাপ এই ক্যাম্পাসে কারো কামড় দিয়েছে বলে কেউ বলতে পারবেনা।

২০২০ এর ফেব্রুয়ারী মাসের শেষদিকে খুবির ভিসির বাংলোর ভিতর থেকে ৫ফুট ৮” লম্বা এবং এক কেজি ৬৫০গ্রাম ওজনের একটি বাদামী রঙের বিষধর খৈইয়া গোখরা সাপ মারা হয় যার পেটে কোন খাবার ছিলনা (যা ল্যাবে সংরক্ষিত আছে), মনেহয় শীতনিদ্রা শেষে সাপটি খাবারের জন্য বের হয়ে মারা পড়ে।

২০২০ এর এপ্রিল- মে মাসে করোনার আধা লগ-ডাউনের সময় খুবি ক্যাম্পাসের ৩০ এর অধিক কুকুর খাবারের অভাবে খুবই ক্ষুধারত ছিল কিন্তু এক কুকুর আর এক কুকুরের মাংস খায়নি।

আবার কাক ও কাকের মাংস খায়না অথচ আমরা শিক্ষকরা আরেকজন শিক্ষকের চাকুরি খাই !!

কেউ কেউ আবার নিজেকে ভাল মানুষ বুজাবার জন্য খোলস বদল করি, বড় দাঁড়ি রাখি, টুপি মাথায় দেই, হজ্জ করি কিন্ত পদ-পদবি, লোভ-লালসার জন্য পশুর চেয়ে অধম কাজটি বিনা দ্বিধায় করছি, এতে আসল মুমিন লোকদের মানুষ খারাপ জানছে।

শিক্ষকরা নিয়মিত চাঁদা দিয়ে সমিতি বানায় তাঁদের ভাল-মন্দ দেখার জন্য, কিন্তু সমিতির নেতারা নির্বাচিত হওয়ার পর ভিসিদের ইচ্ছা- অনিচ্ছাতে চলেন, শিক্ষকদের চাকুরিচ্যুত করা ভিসিদের পদলেহনে সদা ব্যস্ত থাকেন, ভিসিদের বডিগার্ড হন; যদি বিনাভোটে নির্বাচিত হন তবে তাঁদের এসকল অনৈতিক কাজের মাত্রা থাকে কয়েকগুন বেশি।

শিক্ষকদের চাকুরিচ্যুত করার সাফল্যে গত ২৬ জানুয়ারি ২০২১ তারিখ রাতে খুলনার পাওয়ার হাউস মোড়ের কাইফেং চাইনিজ হোটেলের ডিনার পার্টিতে রাত ১২টা অবদি আনন্দ করেন এই কলঙ্কিত ঘটনার মহানায়ক ভিসি সহ একাজে ভিসিকে সহযোগিতাকারি বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও তাঁদের পরিবার।

তাঁদের এই আনন্দ পার্টি কাইফেং চাইনিজ হোটেল থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বের ৫ নং ঘাট এলাকার খুলনার সেই ক্যুখ্যাত খুনি এরশাদ সিকদারের কাহিনিকেও হার মানায়। অশিক্ষিত এরশাদ সিকদার মানুষকে খুন করে দুধ দিয়ে গোসল করে আনন্দ-ফুর্তি করতেন।

তিন জনকে চাকুরিচ্যুত করার পর ভিসি এবং তাঁর সহযোগীরা দুধ দিয়ে গোসল করেছেন কিনা আমরা জানিনা তবে আনন্দ-ফুর্তি ঠিকই করেছেন।

এরশাদ সিকদারের ভয়ে তখন কেউ মুখ খুলতনা আর এখানেও ভিসি এবং তাঁর দলের ভয়ে তিন জনকে চাকুরিচ্যুতি নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না, এমনকি শিক্ষক সমিতিও না।

যা আমাদের বিকৃত মানসিকতা আর হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ; অথচ চাকুরিচ্যুত একজন নারী শিক্ষকদের বেতনের টাকায় চলছিল তাঁর বাবার চিকিৎসা খরচ, ছোট ভাই বোনদের পড়ার খরচ, খাবার, মায়ের ইন্সুলিন কেনা ইত্যাদি।

প্রতিহিংসা- প্রতিশোধ চরিতার্থ করার জন্য আমরা শিক্ষক হয়ে অন্য আর তিনজন সহকর্মীর পেটে যখন লাথি মারি তখন আমাদের আপনারা কি নামে ডাকবেন ??

খুবি সহ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং তাঁর বাহিনীর কাজকাম দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা নানাপাটেকার অভিনীত বলিউডের বিখ্যাত মুভি “শক্তিতে” দেখানো গোষ্ঠীগত প্রতিহিংসা- প্রতিশোধ চরিতার্থ করছেন আর এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন সাধারন শিক্ষক, ছাত্র ছাত্রী, দেশ জাতি। আমরা এথেকে মুক্তি চাই!”

ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী, অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়