গ্রাম থেকে শহরে আসা এক কিশোরের গল্প

মাধ্যমিক “লেভেল” গ্রামে শেষ করার পর উচ্চমাধ্যমিক এর জন্যে ঢাকায় পাড়ি জমালাম। শুনেছি ঢাকায় জীবনমান,পড়াশুনা,পরিবেশও বেশ উন্নত,ঐ শহরে নাকি রাস্তা দিয়ে হাটলেও নতুন কিছু শেখা যায়।ঐ শহরে নাকি শিক্ষিতদের বসবাস

“৬৪ জেলার” মানুষ উন্নত জীবনের খোঁজে ঐ শহরে “ক্যারিয়ার গড়ার” স্বপ্ন নিয়ে আসে।আমাকেও বাবা,মা পাঠাচ্ছিলেন খুব স্বপ্ন নিয়ে তখন আমি “কিশোর” চোখে-মুখে সব সময় নতুন কিছু দেখার নতুন কিছু জানার কৌতুহল আর প্রশ্নের আবেগ।

আমার চঞ্চল, নরম কাদামাটির ‘যে মন’ এ শহরে এসে নিমিষেই চুপসে যাবে তা আমি কখনো ভাবিনি।


Buriganga River

এই প্রথম আংকেলের সাথে লঞ্চে যাতায়াত শুরু করি ঢাকার উদ্দেশ্যে মেঘনা,পদ্মা পাড়ি দিয়ে বুড়িগঙ্গা ঢুকতেই চোখে পড়ল

“কালো পানি” আর বাতাসে বিষাক্ত “পানির গন্ধ” আংকেল কে প্রশ্ন করলাম এটা কোথায়?বলল “সদরঘাট এর কাছাকাছি”ঢাকা আর বেশি দূরে নয় চলে এসেছি প্রায়। আমি অবাক হয়ে আবার প্রশ্ন করতে গিয়েও চুপ হয়ে যাই,চোখ দিয়ে চারপাশ শুধু দেখছি একদিকে কলকারখানার “বর্জ্য” গুলো পানির সাথে নদীতে এসে পরছে অন্যে দিকে সিমেন্ট,ইটের ভাটার ধোঁয়ায় ‘দম’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।

যতই ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই হতাশ হয়েছি,আমি খুঁজতে লাগলাম আমার বইয়ের সে শিক্ষা কোথায়? কতরকম মানুষ,পোশাকের দিক দিয়ে খুব স্মার্ট, কথাগুলোও বেশ সুন্দর কিন্তু শিক্ষা কোথায়?পরিবেশ দূষণ কি এই শহরে উপকারী?

Plastic-polution-Bangladesh-
Plastic-polution-Bangladesh

কিছুক্ষণের মধ্যেই সদরঘাট চলে এলাম লঞ্চ থামতেই কিছু কিশোর বস্তা নিয়ে দৌড় দিল প্রথমে ভয় পেয়ে গেলাম লঞ্চের সব প্লাস্টিকের “বোতল” গুলো তারা সংগ্রহ করে কোথায় যেন নিয়ে গেল,মনে পরে গেল বইয়ের সেই “রিসাইক্লিং”এর কথা।একটু মন ভালো হয়ে যাওয়ার পর আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

কোট-টাই পরা সেই ভদ্র মানুষগুলো কি তাহলে মূর্খ ছিল?যারা নদীতে প্লাস্টিক ফেলে দিল?তাদের সংখ্যাই কি বেশি নাকি এই “রিসাইক্লিং” এর লোকগুলো এই শহরে বেশি?

Sdarghat launch Terminal
Sdarghat launch Terminal

লঞ্চ থেকে নেমেই রাস্তা দিয়ে হাটাশুরু করলাম,শিক্ষিত মানুষগুলো দেখে দেখে আমিও জ্যাম ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম কোন শৃঙ্খলা নেই,এ যেন এক তুলকালাম অবস্থা কার আগে কে যাবে,শহরে এসেই মানুষের গতি বেড়ে গেল।আমি স্থির হয়ে সব কিছু লক্ষ করতে লাগলাম।

এত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষগুলো কিভাবে ময়লা-আবর্জনার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে।অনেকগুলো ডাস্টবিনও দেখতে পেলাম কিন্ত ডাস্টবিনগুলো ফাঁকা ময়লা তার আশেপাশেই পরে আছে।শিক্ষা কোথায়?একটু অবাক হলাম

Dhaka City

এবার বাসে উঠতেই দেখি কোন শৃঙ্খলা নেই,নিয়ম নেই,আংকেল এর কাছে “দু-সিটের” পুরো ভাড়াটাই নিল।একটু যেতেই গাড়ি ব্রেক চাপল “হুড়মুড় ” করে শিক্ষিত মানুষগুলো বাসে উঠে দাঁড়িয়ে যেতে শুরু করল।‘দু-একজন’ অতিরিক্ত যাত্রীর জন্য প্রতিবাদ করলেও বাকিরা চুপ থাকল।

এখানেও শিক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ।

Traffic Light
Traffic Light

গাড়ি একটু এগিয়ে গেলেই ট্রাফিক জ্যামে পরলাম ,ট্রাফিক পুলিশ আর সিগনাল ল্যাম্প ঠিকই আছে,দায়িত্বরত”ট্রাফিক পুলিশ” জ্যাম কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্ত  মানা হচ্ছেনা সেই লাল,হলুদ,সবুজ সিগনাল!

আংকেলকে বললাম আংকেল এই সিগনাল ল্যাম্প আর ট্রাফিক জ্যামইত বইতে পড়েছিলমা।এটাত ঢাকা শহর তাইনা?এখানেত সবাই শিক্ষিত কিন্ত ট্রাফিক সিগনাল,রোড ক্রসিং রুলস কেউত মানছেনা,আমার শিক্ষা এখানেও প্রশ্নবিদ্ধ।

আমি আর কত?অনিয়মের “অভিযোগে” আমার শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করব?ধীরে ধীরে আমি অভ্যস্ত হতে লাগলাম কিন্তু আমি এখনো বইয়ের শিক্ষা হারাইনি।এখনো নিয়ম আর শৃঙ্খলায় মেনে আমি আমার দেশকে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করছি।

ময়লা ফেলতে যতদূর যাওয়া লাগুক ডাস্টবিন ইউজ করি,কখনো কোন লাইনে দাঁড়ালে সিরিয়াল ভাঙ্গিনা,রোড ক্রসিং রুলস মেনে চলি।মাঝে মাঝে আমি দেশ নিয়ে ভাবলেই এই “শিক্ষিত মূর্খ” মানুষগুলো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে,যে তুমি একা ময়লা ডাস্টবিনে ফেলে কি হবে?তুমি নিয়ম মেনে পিছিয়ে পরে তোমার লাভ কি হবে?

আমি মুচকি হেসে মনে মনে বলি যে দেশ আমাকে “শিক্ষিত” করছে সে দেশের সাথে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারিনা।আসুন আমরা আমাদের দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি, শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ করি,দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই।

মোঃ হাসিব উল হাসান
(বাংলাদেশ তাঁত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট)