ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণ মামলায় মজনুর যাবজ্জীবন জেল

মজনু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে রাজধানীর ব্যস্ত একটি সড়ক থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ ও নির্যাতনের মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইন অনুসারে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানার শাস্তিও দেয়া হয় অভিযুক্তকে। অনাদায়ে আরো ৬ মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে তাকে।

বাদীপক্ষের আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহমেদ জানান, আসামীর বিরুদ্ধে যে আইন অনুসারে চার্জ গঠন করা হয়েছে, সেই ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

আজ বৃহস্পতিবার ( ১৯ নভেম্বর) সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয় মামলার একমাত্র আসামি মজনুকে। এরপর তাকে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়।

আদালতে হাজতখানায় নেওয়ার পথে পুলিশ সদস্যদের প্রতি হাত উঁচু করে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয় মজনু। কী কারণে এই হুঁশিয়ারি, জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনও কিছু বলতে নারাজ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, মজনুর কাঁধের ওপরে একটি শার্ট রাখা ছিল। সেটি নামাতে বললে সে ঔদ্ধত্তপূর্ণ আচরণ করে।

দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে তাকে আদালতে নেয়া হয়।

আদালতের কাঠগড়ায় তোলার সময় মজনু অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন। পুলিশ ও আইনজীবীদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও চেঁচামেচি করেন তিনি।

আদালতে নেওয়ার পর সে বলতে থাকে, ‘আমারে ছাইড়া দেন। আমি তো কোনেও অন্যায় করিনি। আমি এতিম। আজ এক বছর যাবত আমি জেলে। আমি ধর্ষণ করিনি।’

আদালতের এজলাসে দুপুর ২টা ২৯ মিনিটে হাজির করা হয় তাকে। এসময় খুবই উচ্চস্বরে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে মজনু। সে আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিরাপত্তা বাহিনী সদস্যদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে।

ভবন থেকে লাফ দেওয়ার হুমকি দিয়ে বলে, ‘আমারে ছাইড়া দেন। আমি রিকশা চালাই। জেলে আমাকে ডাল আর কচুর ভর্তা খেতে দেয়। আমারে ছাইড়া দেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি ধর্ষণ করি নাই, ধর্ষণ করছে চারজন মিলে। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছে না। আমি গরিব দেখে আমাকে ধরেছে। আমার নাম মজনু পাগল, আমার গায়ে শক্তি নাই। আমাকে ছেড়ে দেন।’

আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টায় দিকে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম মোসাম্মৎ কামরুন্নাহার এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মামলার একমাত্র আসামি মজনুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বুধবার (১৮ নভেম্বর) রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আফরোজা ফারহানা আহম্মেদ অরেঞ্জ বলেন,

‘ঢাবি শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলার একমাত্র আসামি মজনুর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা হবে বৃহস্পতিবার (১৯ নভেম্বর)। মামলাটির কার্যক্রম রাষ্ট্রপক্ষ ১৩ কার্যদিবসে শেষ করতে সক্ষম হয়েছে।

আসামি মজনুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছে। তাই আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রত্যাশা করছি আসামি মজনুর সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।’

অপরদিকে আসামি মজনুর আইনজীবী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘মজনুর বিরুদ্ধে ধর্ষণের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। রায়ে মজনু খালাস পাবেন বলে আশা করছি।’

এর আগে, ১২ নভেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম মোসাম্মৎ কামরুন্নাহার রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য বৃহস্পতিবার (১৯ নভেম্বর) দিন ধার্য করেন।

এই মামলার ২৪ সাক্ষীর মধ্যে ২০ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। এর আগে গত ২৬ আগস্ট ঢাকার নারী ও শিশু ট্রাইবুনাল-৭ এর বিচারক বেগম মোসাম্মৎ কামরুন্নাহারের আদালত অভিযোগ গঠন করেন।

গত ১৬ আগস্ট ঢাকার নারী ও শিশু ট্রাইবুনাল-৭ এর বিচারক মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন।

গত ১৬ মার্চ ঢাকা মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশ পরিদর্শক আবু সিদ্দিক মজনুকে একমাত্র আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

গত ৯ জানুয়ারি ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার আসামি মজনুর সাত দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। রিমান্ড শেষে গত ১৬ জানুয়ারি আদালতে ধর্ষণের ঘটনায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে সে।

জবানবন্দি শেষে বিচারক কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। বর্তমানে মজনু কারাগারে রয়েছে।

কী ঘটেছিল সেদিন?

৫ই জানুয়ারি রবিবার সন্ধ্যে সাতটার সময় ওই ছাত্রীকে ব্যস্ত রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।

নির্যাতিত ছাত্রী বলেছিলেন, রবিবার সন্ধ্যায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়ে বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল একসাথে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া।

সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি কুর্মিটোলা এলাকায় বাস থেকে নামেন।

সেখান থেকেই অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার মুখ চেপে ধরে পাশের একটি নির্জন স্থানে নিয়ে যায়।

ঘটনার আকস্মিকতায় সেখানেই জ্ঞান হারান ছাত্রীটি।

নির্যাতনের এক পর্যায়ে জ্ঞান ফিরে পান তিনি এবং আবার জ্ঞান হারান।

ডাক্তারি পরীক্ষায় নির্যাতনের শিকার ছাত্রীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে।

রাত ১০টার দিকে জ্ঞান ফিরলে নিজেকে একটি নির্জন জায়গায় আবিষ্কার করেন ওই ছাত্রী। পরে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে যান তিনি।

রাত ১২টার দিকে তাকে ঢামেক হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করেন সহপাঠীরা।

ঐ ছাত্রীটির ধর্ষণের খবর ছড়িয়ে পড়লে অভিযুক্ত ধর্ষকের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলকায় বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা।

পরদিন সকালে অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করে ওই ছাত্রীর বাবা ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন। এবং শাহবাগ থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়।

মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি উত্তর)।  ৮ জানুয়ারি মজনুকে গ্রেফতার করে র‍্যাব।

অভিযুক্তকে গ্রেফতারের পর র‍্যাব জানায়, ধর্ষণকারী হিসেবে সন্দেহভাজন ঐ ব্যক্তিকে আটকের পর ধর্ষণের শিকার শিক্ষার্থীর কাছে মোবাইল ফোনে তার ছবি পাঠিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করা হয়।

৯ জানুয়ারি সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে মজনুকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পুলিশকে অনুমতি দেন আদালত।

১৬ জানুয়ারি ধর্ষণের দায় স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন অভিযুক্ত।

গত ১৬ মার্চ ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে মজনুর বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আবু বক্কর।

২৬ আগস্ট ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক বেগম মোসাম্মৎ কামরুন্নাহার ভার্চুয়াল আদালতে মজনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

গ্রেপতারের পর সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম বলেছিলেন, মজনু মাদকাসক্ত। তার বাড়ি হাতিয়ায়। যদিও তার স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হাতিয়ায় তার বলা ঠিকানার কোনো অস্তিত্ব নেই।

সে এর আগেও ওই একই এলাকায় ভিক্ষুক ও প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণ করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী যেদিন ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে সারোয়ার বলেন, সেদিন মজনু অসুস্থতার কারণে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গিয়েছিলেন।

সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রীকে দেখেন ও তাকে ধর্ষণ করার জন্য টার্গেট করেন।

কয়েক বছর আগে মজনু বিয়ে করেছিল ও তার স্ত্রী মারা গেছেন বলেও জানিয়েছে র‌্যাব। পেশায় হকার মজনু চুরি-ছিনতাইয়ের সাথেও জড়িত।

র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, ৫ জানুয়ারি (রোববার) মেয়েটি কুর্মিটোলায় বাস থেকে নামার পর মজনু অনুসরণ করে তার গলা চেপে ধরে।

তাকে রাস্তার কিনারা থেকে ঝোপঝাড়ের পেছনে নিয়ে যায়। এরপর তাকে কয়েকবার কিল-ঘুষিও মারে। ধর্ষণের সময় কয়েকবার তার গলা টিপে হত্যার হুমকি দেয় মজনু।

তিনি আরও বলেন, মজনু ওই ছাত্রীকে তিন ঘণ্টা সেখানে রেখেছিল। এর মধ্যে মেয়েটি কয়েকবার অচেতন হয়ে পড়ে। সর্বশেষ মেয়েটির যখন জ্ঞান ফেরে তখন সে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে রাস্তার ওপারে চলে যায়।

মজনুর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে সারোয়ার বিন কাশেম জানান, ধর্ষণের সময় মজনু একা ছিল আর কেউ ছিল না।

সে একজন ছিনতাইকারী এবং সিরিয়াল রেপিস্ট। তার কাছ থেকে কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি। এর আগেও বেশ কয়েকজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও ভিক্ষুক নারীকে এই ঝোপঝাড়ে এনে ধর্ষণ করে মজনু।