প্রতিবছরই চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চতর শিক্ষা, গবেষণার লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান।
পরিবার পরিজন ছেড়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা বিদেশের মাটিতে চুয়েট এবং বাংলাদেশের সুনাম কুড়াচ্ছেন।
এমনি একজন ব্যাক্তিত্ব চুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের প্রভাষক নুরুজ্জামান শুভ।
বর্তমানে তিনি স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য নেদারল্যান্ডসের ওয়াজেনিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তিনি জানান
প্রতিদিনের মত রুটিন মাফিক জীবন,সকালে ওঠেই নাস্তা করেই ভোঁ দৌড়। আর আমার সাথে থাকে আমার প্রিয় সাইকেল।
তারপর পুরো সপ্তাহ সকাল ৯.০০ টা থেকে বিকাল ৫.০০টা পর্যন্ত ক্লাশ, ব্যবহারিক, সেমিনার, মিটিং এভাবেই চলতে থাকে সপ্তাহের কর্মমুখর দিনগুলো। শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে যায়ে সাপ্তাহিক উল্লাস।
শুক্রবার রাত এখানকার পার্টির রাত, যদিও তেমন একটা যাওয়া হয় না। আমাদের পার্টিগুলোকে অনেকটা অন্য কোন প্রবাসী বাঙ্গালীর বাসায় দাওয়াত বলা যায়।
তারপর প্রতি রবিবারের রুটিন হচ্ছে সকালে নাস্তা করি কোন রেস্টুরেন্টে, তারপর ওইদিন এখানে খোলা বাজার বসে অনেকটা আমাদের দেশের হাটেরমত।
ওখান থেকেই সাধারনত বাজার করি । তারপর বাসায় ফিরে পুরো সপ্তাহের জন্য রান্না-বান্না করি যেন পুরো সপ্তাহ জুড়ে তেমন একটা কিছু রান্না করতে না হয় ।
রবিবার হচ্ছে আমার জন্য আসল ছুটির দিন । এভাবেই চলতে থাকে আমার যান্ত্রিক জীবন।
আর এর মাঝেই দুই একটা দিন ছুটি পেলেই ঘুরে আসি পাশের কোন একটা দেশ থেকে ।
যেহেতু এখানে শেনগানভুক্ত দেশগুলোতে ঘুরতে আলাদা কোন ভিসা লাগে না তাই এই সুযোগ তো আর মিস করা যায় না ।
এই ঘুরোঘুরির কথা বলে শেষ করা যাবে না। মজার ব্যাপার হল, এই প্রবাসে অমি পাড়ি জমাই ২০১৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এবং সেই মাসের ২৯ তারিখ চলে যাই জার্মানির মিউনিখ শহরের একটা উৎসবে।
সেই থেকে এখন পর্যন্ত চলছে। এখন পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসহ মোট ৯টা দেশে (জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, ভ্যাটিকান সিটি) ঘুরতে গিয়েছি।
এমনকি যখন এই কথাগুলো লিখছি তখনো ইংল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ড যাওয়ার পরিকল্পনাটা ঠিকঠাক করছি ।
কারণ সামনেই আসছে ৫ দিনের লম্বা একটা ছুটি ।
এখানে এসে আমি শিখতে পেরেছি মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক হচ্ছে পরিবেশ-প্রকৃতি।
প্রতিটা সময় নতুন কোন শহরে,ভিন্ন একটা সংস্কৃতি,ভিন্ন মানুষগুলো,ভিন্ন তাদের চিন্তা-ভাবনা,ভিন্ন তাদের বিধি-বিধান।
সবকিছু থেকেই শেখার আছে অনেক কিছু। এখানকার মানুষগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা আমাকে অবাক করেছে তা হল এখানকার সমাজে কোন ভেদাভেদ নেই,নেই উচুঁশ্রেণী-নিচুশ্রেণী, সবাই এক।
একজন দারোয়ানকে ওরা যেভাবে আচরণ করে একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও তাই। আসলে চমকে দেয়ার মত একটা সমাজ ওদের।
আর ডাচদের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সবার সাইকেল থাকবে,সারাদিন শুধু পাউরুটি খাবে আর সবার একটা করে কুকুর থাকবে।
মানে এই তিনটা জিনিস ছাড়া রীতিমত ডাচ্ হওয়া যাবে না।
তারপর আসি এখানকার পড়াশোনার পদ্ধতির ব্যাপারে। অমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তার নাম হচ্ছে ওয়াজেনিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ব র্যাকিংয়ে এর অবস্থান ৭৩ তম। আর এখানকার বিশেষ দুটি বিভাগ তো বিশ্বসেরা। আর এর একটি হল লাইফ সাইন্স বিভাগ,আরেকটার কথা এই মুহূর্তে ঠিক মনে নেই।
এখানকার শিক্ষাপদ্ধতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল ওরা এমন জিনিস নিয়ে অধ্যয়ন বা গবেষণা করে যা এই মুহূর্তে ওদের দেশে দরকার।
আমাদের দেশের পড়াশোনাটা অনেকটা গতানুগতিক । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমি এমন একটা কোর্স করেছি যার নাম হচ্ছে বাৎসরিক পরামর্শ প্রশিক্ষণ(অ্যানুয়েল কনসালটেন্সি ট্রেনিং)।
এই কোর্সটা অনেকটা এই রকম ছিল যে স্পেনের একটা বিশেষ এলাকাতে পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছিল,তো সেখানকার কমিশনার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্যের জন্য আবেদন করেন।
তারপর আমাদের বিভাগ থেকে আমি সহ ৩০ জনকে এক মাসের জন্য সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হয় সমস্যাটা নিয়ে গবেষণার জন্য।
আমি মনে করি আমাদের দেশের পড়াশোনাটাও এইরকম হওয়া উচিত। যেমন পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীদের এস্টিমেশন ল্যাব এর সময় ছেড়ে দেয়া হোক না কোন বাস্তব প্রজেক্টে।
যে জ্ঞানটা তাদের জন্য হবে সারা জীবনের পথ চলার পাথেয়। আর এ বিষয়ে অনেক শিক্ষকই সামনে এগিয়ে এসেছেন যারা সত্যিকার প্রশংসার দাবিদার এবং
দেশে ফিরে যাওয়ার পর একজন শিক্ষক হিসেবে আমিও এই একই কাজ করার স্বপ্ন দেখি। শিক্ষা হতে হবে বাস্তবমুখী। কারণ আমাদেরকেও হাল ধরতে হবে,দেশটাকে সুন্দর আগামীর পথে পরিচালিত করতে হবে।
দেশের কথা আসতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতাই হচ্ছে এটা। দেশের কথা খুব মনে পড়ে। মিস করি বাবা-মাকে,ভাই-বোনদেরকে,সব আত্নীয়-স্বজনকে,সব বন্ধুদেরকে;মানে বলে বুঝাতে পারব না।
মনে হয় যেন প্রতিটা বাঙ্গালীকে মিস করি। যাই হোক প্রথমদিকে এত ঘুরাঘোরির গল্প বলার একটাই উদ্দেশ্য ছিল যে আমার সহপাঠী,ছোটভাই থেকে আমার প্রিয় শিক্ষার্থীদের সবাইকে একটু উৎসাহিত করা।
জীবনটা কত সুন্দর হতে পারে তা ঘর থেকে বের না হলে কখনোই বুঝা সম্ভব না। তাই সবাইকে বলব একটু ভালকরে পড়াশোনা করে ছড়িয়ে যাও গোটা বিশ্বে।
আর খুজে বেড়াও জীবনের আসল সৌন্দর্য, জীবনের সত্যিকার অর্থ।
তারপর অজস্র জ্ঞান আহরণ করে ফিরে আসো আবার আমার সোনার বাংলায়।
কোন একজনের পক্ষে দেশটাকে পরিবর্তন করা সম্ভব না। কিন্তু আমরা সবাই যদি আমাদের নিজেদের অবস্থান থেকে একটু করে চেষ্টা করি,শক্ত করে ধরি একজন আরেকজনের হাত, তাহলে সেই দিন আর বেশি দূরে নেই, যেদিন ইউরোপসহ গোটা বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে আসা তথাকথিত সাদা মানুষগুলো আমার মায়ের,আমার জাতির ,আমার বাংলাদেশের জয়গান করবে ।
অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নই পারে ভবিষ্যতের পথ দেখাতে।