ইতিহাসবিদ ড. আব্দুল করিম – চবির গর্ব

আবদুল করিম ১৯২৮ সালে চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীর চাপাছড়ি গ্রামে এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি ২০০৭ সালে ২৪ জুলাই মারা যান। তিনি ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

ড. করিম ১৯৫২ সালে ‘সোশ্যাল হিস্টরি অব দি মুসলিম ইন বেঙ্গল’ গবেষণাকর্মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম পিএইচডি ও ১৯৬২ সালে ‘মুর্শিদকুলী খান অ্যান্ড হিজ টাইমস’ গবেষণাকর্মে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

ইতিহাসবিদ ড. করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। তিনি একুশে পদক, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল, ইন্ডিয়ান আকবর সিলভার মেডেলসহ দেশ-বিদেশে বহু সম্মাননা লাভ করেন।

তার লেখা বাংলার ইতিহাস, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, সোশ্যাল হিস্টরি অব মুসলিম ইন বেঙ্গল, ঢাকা মোগল ক্যাপিটাল, বাংলার সুফিসমাজ, বাংলা সাহিত্যের কালক্রম, সমাজ ও জীবনসহ দুই শতাধিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে।

ড. আবদুল করিম হাটহাজারী কলেজ ও পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্রি কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

প্রফেসর ড. আবদুল করিমের আত্মজীবনী থেকে…
বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে সাঙ্গু নদীর উর্বর মাটির সন্তান ড. আব্দুল করিম ১ জুন ১৯২৮ সালে বাঁশখালী থানার বাহারছড়া ইউনিয়নের চাঁপাছড়ি গ্রামের সৈয়দ বংশে জন্ম গ্রহণ করেন।

তাঁর বাবা মৌলভী ওয়াইজুদ্দিন বার্মায় (মিয়ানমার) একটি মসজিদের মুয়াজ্জিনের চাকরি করতেন এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় বাঁশখালীতে ফিরে আসেন। মা সৈয়দা রশিদা খাতুন এক কামেল পরিবারের পর্দানশীন মেয়ে ছিলেন। ড. করিম অত্যন্ত ধৈর্য্য সহকারে কঠোর পরিশ্রমে বাল্য, কৈশোর ও যৌবন পার করেছেন।

তার উঠে আসার দু:খকাহিনী তিনি নিজে তাঁর আত্মজীবনী “সমাজ ও জীবন” গ্রন্থে নিপুণ হাতের কালিতে লিপিবদ্ধ করেছেন। ‘‘সমাজ ও জীবন’’ তার শুধু আত্মজীবনী নয় বরং তৎকালীন সমাজের নানা ঘটনার প্রতিচ্ছবি।

সমাজের নানা অসঙ্গতি, কুসংস্কার, অনিয়ম ও ফতোয়াবাজদের ভন্ডামি তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন। এ বইয়ে তিনি লিখেছেন ‘‘ নারী নির্যাতন গ্রামের একটি সাধারণ ব্যাপার।

গ্রামে অবশ্যই নির্যাতন মানেই স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে কথায় কথায় মারধর করা, শাশুড়ি কর্তৃক বউকে লাঞ্চিত করা। ইসলামে স্ত্রীর যে মর্যাদা দিয়েছে, স্বামীর উপর স্ত্রীর যে অধিকার সাধারণ মুসলমান তা কখনো বিশ্বাস করতেন না।

মোল্লা-মৌলভীরাও এই বিষয়ে কোন কিছু বলত না। তারা মনে করে স্ত্রী হল স্বামীর দাসী। স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার অন্যতম কারণ আর্থিক অসচ্ছলতা। সামান্য কারণে ঝগড়াঝাটির পরে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অসংখ্য ঘটনা দেখেছি।

আবার তালাক দিয়ে স্ত্রীকে ঘরে রাখার জন্য ফতোয়াবাজ মোল্লা-মৌলভীর কাছে ধর্না দেয়। মোল্লা-মৌলভীরাও অর্থের বিনিময়ে তালাক হয়নি মর্মে ফতোয়া দিতে কসুর করত না”।

ড. আবদুল করিম ধর্ম ভীরু ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না।
ড. করিমকে মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে কোরআন হেফজ করতে দেন তার ছোট বেলার শিক্ষক মাওলানা মনিরুজ্জামান।

ছোটবেলার মেধাবী করিম নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে উচ্চ প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করে এবং তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রামের ইসলামিক ইন্টামিডিয়েট কলেজে (বর্তমান হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ)।

১৯৪৪ সালে এই কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং ১৯৪৬ সালে প্রথম বিভাগে ৮ম স্থান অধিকার করে আই, এ পাস করেন।

উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৯ সালে ইতিহাসে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩য় স্থান অধিকার করে বি. এ অনার্স এবং ১৯৫০ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম পেয়ে এম. এ পাস করেন।

১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের প্রভাষক পদে যোগদান করে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক হন।

এই হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে তিনি চট্টগ্রামের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ভিসি ইনামুল সহ অসংখ্য ছেলেদের সার্বিক সুখ দুঃখের খবর নিতেন বলেই তিনি চাটগাঁর ছেলেদের অভিভাবক হিসেবে পরিচিত হন।

আজকের মত অসংখ্য টিভি চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা, গণমাধ্যম তখন ছিল না। কিন্তু ড. করিম সাহেব শিলালিপি, মুদ্রা বিদ্যা, সুফী সাধকের জীবন চরিত্র, জাতিসত্ত্বার বিকাশ, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ, নিরীক্ষণ, পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাসকে অনেক উঁচু আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

এসব দুর্লভ গবেষণা ও ইতিহাস চর্চার জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৫৮ সালে ইতিহাসে পি. এইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। জ্ঞানের পরিসীমা আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়ে দিতে ১৯৬০ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’ এ দুই বছর পড়াশোনা শেষে ‘মুর্শিদকুলি খান এন্ড হিজ টাইমস’ রচনা করে ২য় বার পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫১ সাল হতে তিনি ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে বিভিন্ন সেমিনারে যোগদান করে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।

তিনি একই সাথে এশিয়াটিক সোসাইটির সেক্রেটারী এবং বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির সভাপতি ছিলেন (১৯৬৪-১৯৬৬)। চট্টগ্রাম দরদি এই কিংবদন্তি পুরুষ ১৯৬৬ সালে প্রাণের টানে চট্টগ্রামে জ্ঞানের মশাল জ্বালাতে নব প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভি. সি. ড. মল্লিকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।

এই বিভাগের চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি ‘ইতিহাস’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি ছাত্রদের থাকার জন্য আবাসিক হল ‘আলাওল হল’ নির্মাণের ব্যবস্থা করেন এবং এই হলের প্রথম প্রভোষ্ট ছিলেন (১৯৬৬-১৯৭০)।

তিনি কলা অনুষদের ডিন ছিলেন ১৯৭০-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভি.সি কবি ও সাহিত্যিক আবুল ফজল বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টা নিযুক্ত হলে তিনি প্রথমে অস্থায়ী এবং পরে স্থায়ী ভিসি হিসেবে দায়িত্বপালন করেন ২৮ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল থেকে ১৮ই এপ্রিল ১৯৮১ সাল পর্যন্ত।

১৯৮১ সালে পাকিস্তানি নোবেল বিজয়ী আব্দুস সালামকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেন। দীর্ঘ সময় ভি.সি’র দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক দায়িত্বের পাশাপাশি হাটহাজারী কলেজ ও বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ নির্মাণে ভূমিকা রাখেন।

অবসরের পর ১৯৯০ সালে পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা ও এর গভর্নিং বড়ির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

এই মডার্ন শিক্ষাবিদ ব্যক্তিকে ১৯৯২ সালে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এবং তারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ব্যারিষ্টার জমির উদ্দিন সরকার জাতীয় অধ্যাপক করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি প্রাণ প্রিয় চট্টগ্রাম শহরকে ছেড়ে যেতে রাজি না হওয়ায় এই সুযোগ হাতছাড়া হয়।

ড. করিম সাহেবের তুলনা তিনি নিজেই। তার মননশীল চিন্তা, গভীর জ্ঞানের পরিসীমা ও গবেষণা তাকে এক পাহাড়সম অবস্থানে নিয়ে যায়। তিনি ৪০টির মত গবেষণা গ্রন্থ লিখেছেন।

তার মধ্যে ঢাকাই মসলিন, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, বাংলার সুলতানী আমল, চট্টগ্রামের ইতিহাস , বাংলার সূফী সমাজ, মক্কা শরীফে বাঙালি মাদ্রাসা, বাংলার ইতিহাস মোঘল আমল, বাংলার ইতিহাস ও এতিহ্য , বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সমাজ ও জীবন ইত্যাদি।

তার এই গবেষণার স্বীকৃতি হিসাবে আকবর সিলভার মেডেল (১৯৬০), একুশে পদক (১৯৯৫), জাতিসংঘের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আই.এ.আর. এফ শান্তি পদক (১৯৯৫) , ড. এনামুল হক পদক (২০০২), আব্দুল হক চৌধুরী স্বর্ণ পদক (২০০২), বাংলাদেশে ইতিহাস সমিতির গোল্ড মেডেল (২০০৫), এশিয়াটিক সোসাইটির গোল্ড মেডেল (২০০৬) সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।

ড. আব্দুল করিম নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। অসংখ্য জ্ঞানী গুণী ব্যক্তির স্রষ্টা তিনি। চট্টগ্রামের অসহায় দরিদ্র ছেলেদের জন্য তার দরজা সব সময় খোলা থাকতো।

ড. আব্দুল করিমকে ১৯৯৫ সালে ইমেরিটাস অধ্যাপক করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে একটি অংশের বিরোধীতায় তা ভেস্তে যায়। পরে ২০০১ সালের নভেম্বরে তাকে এই পদে সম্মানিত করা হয়।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। এই মহান ব্যক্তি পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে, হাজারো ভক্ত-সমর্থক, ছাত্র-শিক্ষকের চোখে অশ্রু ঢেলে ২০০৭ সালের ২৪ জুলাই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

©Human’s of CU