২ আগস্ট, কি ঘটেছিল চবিতে!
২ আগস্ট, ২০১০, সেদিন ছিল সোমবার। আজকের মতো এমন এক সকালেই প্রশাসনের নির্দেশে পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে ছিলো পুলিশের সতর্ক চোখ।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় ২০০% বর্ধিত ফি বাতিলের দাবিতে ২৬ জুলাই থেকে চলা টানা ৭ দিনের আন্দোলন ছাত্র ছাত্রীদের মনে তৈরি করে তীব্র ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ যেকোনো সময় পরিনত হতে পারে জ্বলন্ত আগুনে।
সেই আশংকায় সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে অবস্থানকারী পুলিশদের সাথে যুক্ত হয় আরও ১২ প্লাটুন পুলিশ, কয়েক প্লাটুন র্যাব ও এক ইউনিট ফায়ার সার্ভিস। এ যেন এক যুদ্ধযুদ্ধ অবস্থা!
১ আগস্ট ষোলশহর এবং নগরীর ২নং গেইটে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশ নির্বিচারে হামলা চালায়। তাতেই তেতে উঠে শিক্ষার্থীরা।
তাই ২ আগস্ট সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা শহর ছেড়ে ক্যাম্পাসে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশের।
ছাত্ররা দল বেঁধে সকাল থেকেই জড়ো হতে থাকে ক্যাম্পাসে। ছাত্রদেরকে প্রথম অবস্থাতে রুখে দিতে বেপোরোয়া হয়ে উঠে পুলিশ বাহিনী৷
এলোপাথাড়ি রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে ছত্রভংগ করে দেয় ছাত্রদের মিছিল।
সহপাঠী ছাত্র ভাইদের উপর এমন ন্যাক্কারজনক হামলা দেখে ছাত্রী হলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে হাজার হাজার ছাত্রীদের মিছিল।
পুলিশ যেনো তা দেখে আরও তেতে উঠলো দ্বিগুণ। ধাওয়া দিয়ে তাদেরকে কোনঠাসা করে দিলো ছাত্রী হলের গেইটেই। এরপর শুরু হয় ছাত্রীদের উপরও এলোপাথাড়ি রাবার বুলেটও টিয়ার শেল!
চবির ছাত্রীরা ক্যাম্পাস পুলিশের এমন সরাসরি হিংস্ররুপ দেখিনি সেদিনের আগে।
কিন্তু এই অপমান ও অন্যায় মেনে নিতে না পেরে সাথে সাথেই রাবার বুলেট ও টিয়ারশেলকে উপেক্ষা করে তারা সম্মিলিত মিছিল নিয়ে জোরালো অবস্থান নেয় চবির কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
পুরো ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ স্লোগান। চারদিক থেকে ছুটে আসে আরও অসংখ্য ছাত্রী। মূলত পুরো শহীদ মিনার ঘিরে তখন অবস্থান চলছিলো ছাত্রী এবং সাংবাদিকদের।
মিডিয়ার সামনে তখনকার প্রশাসনের সরাসরি নির্দেশে কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই চারদিক থেকে ছাত্রীদের ঘিরে ফেলে পুলিশ-র্যাব। শুরু হয় ছাত্রীদের উপর ইতিহাসের জগণ্য হামলা।
টিয়ারশেল এবং লাঠির আঘাতে প্রায় শতাধিক ছাত্রী ও সাংবাদিক আহত হয়। নিরস্ত্র ছাত্রীরা খালি হাত পায়ে ছুটাছুটি করতে থাকেন অসহায়ভাবে।
অথচ ঘিরে থাকা পুলিশের লাঠির আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েও পিছপা হোননি এককদমও।
ছাত্রীদের বাঁচাতে ছাত্ররা এগিয়ে এলেও তাদের উপর চলে আরও দ্বিগুণ নির্যাতন। বুট দিয়ে লাথি মেরে মেরে তাদেরকে করা হয় রক্তাক্ত।
কারও হাত দিয়ে, কারও পা দিয়ে, কারও মাথা পেটে অনবরত রক্ত ঝরতে দেখা যায়। এমনি অবস্থাতেও কোন চিকিৎসা না দিয়ে চলতে থাকে গণগ্রেফতার!
বিকাল তখন ৪টা, বুঝার ঠিক কোন উপায় নেই এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে শিক্ষার্থীদের শতশত স্যান্ডেল।
হঠাৎ কোন আগন্তুক আসলে হয়তো ভাবতে পারে এখানে কিছুক্ষণ আগে বয়ে গেছে ভয়াবহ কোন ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কালো প্রশাসন সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই সকল ছাত্র ছাত্রীকে হল ও ক্যাম্পাস ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।
অথচ ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্ট বা ১নং গেইটে কোন শিক্ষার্থীকে দেখা মাত্রই গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ।
আবাসিক হল থেকে সন্ধ্যা না হওয়ার আগেই প্রায় চার শতাধিক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়।
পরদিন প্রায় ৫০০ জনের নামে মামলা করে বসে প্রশাসন। শুরু হয় জেল, মামলা ও রিমান্ডের প্রহসন। প্রায় ২ মাস বন্ধ ঘোষণা করা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পরদিন ৩ আগস্ট দেশের সবগুলো জাতীয় দৈনিকের লাল কালিতে শিরোনাম হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ন্যাকারজনক এক কালো অধ্যায়ের কথা। দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।
মূলত ছাত্র ছাত্রীদের অপ্রতিরোধ্য সেই ভয়াল ২ আগস্ট পরিবর্তন করে দেয় পুরো ক্যাম্পাস। সেদিন প্রতিটি ছাত্র ছাত্রী যেন হয়ে উঠেছিল একে অপরের প্রিয় বন্ধু।
একজনের উপর চলা আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসলো অন্যরা, ভ্রাতৃত্ববোধের সে এক জ্বলন্ত উদাহরণ। ২০১০ সালের প্রশাসন মূলত বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল দরিদ্রদের জন্য উচ্চ শিক্ষা।
আজ আপনি যে বেতন-ফি তে চবিতে পড়াশুনা করছেন হয়তো আপনাকে আজ পরিশোধ করতে হত তার দ্বিগুণের চেয়েও বেশি ।
আজ আপনি যা পেলেন তার অবদান চবির ২০১০ সালের বর্ধিত বেতন-ফি প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনকারি সেই সব ছাত্র ছাত্রীদের।
জয়তু চবি শিক্ষার্থী, জয়তু চবিয়ান