“অপেক্ষা”

“অপেক্ষা”

কোয়ারেন্টাইনের ৩১তম দিনে পদার্পণ করলো সুমন। এতদিন কিভাবে গৃহবন্দী ছিল সেটাই বারংবার ভেবে অবাক হয় সে। আর কতদিন এভাবে থাকতে হবে সে জানেনা। নিজেকে জেলখানার কয়েদী মনে হতে লাগলো তার। অবশ্য ভালই হলো,জীবনের একটি অদ্ভুত ইচ্ছেও ছিল জেলখানায় যাওয়া। ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে গেল নাকি ভেবে ক্ষণিকের মুচকি হাসি দেয় সে। সারাটা দিন ঘরে বসে কাটে সুমনের। মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে যায়। আরে! ঘড়ির কাটা এতো ধীরগতিতে চলছে কেন? বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বাবাকে ডাক দেয়, মাকে ডাক দেয়। মা ঠাট্টা করে বলে লকডাউন শেষে সুজনকে পাবনায় ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসবে।

সুমন লজ্জা পেল। দূরন্ত ছেলেটি এতদিন ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছে। সুমন খেয়াল করলো, তার মা তার ডাকে সাড়া দিলেও বাবা সাড়া দেয়নি। পরক্ষণেই মনে পড়লো তার বাবা আজ তিন দিন ধরে অসুস্থ। দিনেক পাঁচ আগে তিনি বাজার থেকে আগামী দশ দিনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যাদি কিনে রেখেছিলেন।

অসুস্থতার প্রথম দিন থেকেই বাবা নিজেকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে দূরে দূরে রাখছেন। বাবা হয়তো কিছুটা আঁচ করে ফেলেছেন। খাবার খাচ্ছেন আলাদা রুমে,ঘুমাচ্ছেন আলাদা রুমে, আলাদা ওয়াশরুম ব্যবহার করছেন। চতুর্থ দিন বাবার অবস্থা আরো অবনতির দিকে। যেটি সন্দেহ করছে সেটিই যেন না হয় এই দুয়াই করতে থাকে সুমন। বাবাকে সে টেস্ট করাতে নিয়ে গেল। দুর্ভাগ্যবশত টেস্ট পজিটিভ। তার বাবাকে আইসোলেশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এবং সুমনকে পরিবারসহ ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার নোটিশ দেয়া হয়েছে।

বাবার খবর নেয়ার কোনো উপায় নেই। ওদিকে মা অস্থির হয়ে আছেন। নতুন করে হোম কোয়ারেন্টাইনের চতুর্থ দিনে সুমনের মোবাইলে কল আসলো। কলের ওপার থেকে কন্ঠস্বর শেষ হতেই ধপাস করে হাত থেকে পড়ে গেল মোবাইলটি। তার মায়ের আর বুঝতে বাকি রইলো না। নোটিশ অমান্য করে মা, ছেলে মিলে তাদের প্রিয়জনের মুখখানা দেখার জন্য রওনা দিল। মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদছে। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সুমন মাকে শান্তনা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।

এদিকে রাস্তায় আর্মিদের বাধা তাই রিক্সা দিয়ে উলটো পথে যাচ্ছে তারা। হঠাৎ করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের রিক্সাটি কিছুক্ষণ হাওয়ায় ভেসে পুরোদস্তুর উল্টিয়ে গেল। “লড়িটি কি সত্যিই ধাক্কা দিয়ে গেল?” মনে মনে ভাবছে সে। কিছুটা আহত সুমন মায়ের দিকে তাকাতেই তার চক্ষু ছানাবড়া। বাবা হারানোর শোক শুরু না হতেই মায়ের নিথর দেহ এখন চোখের সামনে। আর নিতে পারছে না সে।

কষ্টে বুকফাটা চিৎকার দিয়ে সুমনের ঘুম ভাঙ্গলো। কি বিদঘুটে স্বপ্নই না ছিল! ফ্যান চলছে তবুও সুমন ঘামছে। সুমনের টুকটুকে,সুন্দরী ও পরহেজগার অর্ধাঙ্গিনী আয়িশা দৌড়ে এসে কাছে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“এই কি হলো হঠাৎ? খারাপ স্বপ্ন দেখছো নাকি? এতো ঘামাচ্ছো কেন?”
কোনো কথা না বলে সুমন তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এই ভয়ংকর ঘটনাটি শুধু স্বপ্ন ছিল ভেবে খুশিতে বউকে জড়িয়েই ধরে থাকে সে। ওদিকে বউয়ের রান্না পুড়ে যাচ্ছে সেদিকে তার তোয়াক্কা নেই। আজ যেন নতুন করে সুমনের ভালবাসা উৎলিয়ে পড়েছে।

ক্ষণিক পরে সুমন একটি পুরুষ কন্ঠস্বর শুনতে পেল, “এই সুমন!সুমন! উঠোস না ক্যারে? দুপুর হই গেছে তো ব্যাটা। ত্রাণ আনতে যাবিনা? এই সুমন!”
সুমনের ঘুম ভেঙ্গে গেল। এতো সুন্দর মুহুর্তটি হারিয়ে যাওয়ায় কিছুটা আফসোস করে সে। ফজরের নামায পড়ে ক্ষুধার জ্বালায় জিকির করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আজ ৩১দিন ধরে চাকরি নেই তার। এক গার্মেন্টসের সিকিউরিটি গার্ড ছিল। এদিকে জমানো টাকাও প্রায় ফুরিয়ে আসছে। গ্রামে ভালই আর্থিক অবস্থা ছিল সুমনের। বাবা-মায়ের একসঙ্গে অকাল মৃত্যুর পর তার একমাত্র চাচা জমিজমা সব লিখে নিয়ে সুমনকে তাড়িয়ে দেয়। সেই থেকে এতিম সুমন শহরে রফিক নামক এক পাতানো ভাইয়ের সাথে থাকে।

ঘুম থেকে উঠে কোনো রকমে মুখে পানি দিয়েই সুমন রফিকের সাথে ত্রাণ আনতে গেল। অনেক মানুষের ভিড়। অনেক কষ্টে সুমন ত্রাণের ব্যাগ সংগ্রহ করলো। ত্রাণের পরিমাণ দেখে খুশি হয়ে গেল সে। আগামী কয়েকদিন চলে যাবে। মহান রব্বুল ‘আলামিনের কাছে শুকরিয়া আদায় করে আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছে সুমন। নিশ্চয়ই রিযিকের মালিক ওই একজনই। সুমনের দেখাদেখি রফিকও আকাশের পানে চেয়ে আছে।

– এভাবে আর কতদিন চলবো ভাই?(সুমন)
– জানিনা রে। সবর কর। আল্লাহ আমগো পরীক্ষা কঠিন কইরা দিছে। এগুলা আমগো সবার পাপের ফসল। তওবাও করতাছিনা আমরা।
– আয়িশারে তো বড্ড দেখতে ইচ্ছা করতাছে… (সুমনের হবু বউ)
– তাকদিরে লেখা থাকলে তোদের মিলন হইবই।

আজ কোয়ারেন্টাইনের অর্ধশততম দিন। সুমনের মত এমন হাজারো সুমন সেই সুদিনের অপেক্ষায়…