উন্নয়ন প্রবাহ এবং হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি

উন্নয়ন প্রবাহ এবং হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি

পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি৷
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সর্বত্র আজ উন্নয়নের ছোঁয়া, সময়ের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে বিধ্বস্ত এক দেশের চিত্র। কখনো মানব সৃষ্ট দুর্যোগ, কখনো বা প্রাকৃতিক- এ দেশ বিধ্বস্ত হয়েছে বার বার। কিন্তু বীরের জাতির দেশ সকল দুর্যোগ কাটিয়ে স্বমহিমায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে, বিশ্ব দরবারে নিজেকে চিনিয়েছে অন্য এক রূপে। আজ আমরা মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। তবে আজ আমাদের নবজাগরণের দিনে আমাদের হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতির কথা ভুলে গেলে চলবে না – যার উপর ভিত্তি করে এদেশের কাঠামো গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তেতো হলেও সত্যি যে, আমরা কিন্তু আমাদের লালিত সংস্কৃতিকে হারাতে বসেছি। সময়ের সমান্তরালে যতটা লালন করার কথা, ঠিক ততটাই অবহেলা করছি আমাদের বাপ-দাদার ধ্যান, জ্ঞান আর কর্মের সূত্রগুলোকে।

এক সময় গরুর গাড়ি ছাড়া নতুন বউয়ের নাইয়র যেতো না। ৮০’র দশকে এই গরুর গাড়ি নিয়ে রচিত হয় বিখ্যাত গান, “আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে, ধুত্তুর ধুত্তুর ধুত্তুর ধু সানাই বাজিয়ে, যাবো তোমায় শ্বশুর বাড়ি নিয়ে”। সময় পরিক্রমায় এখন সেই গরুর গাড়িও নেই, গাড়িয়াল ও নেই। না আছে সানাই বাজিয়ে বিয়ে করার চল, না আছে সানাই বাদকদের অস্তিত্ব। হয়তো সময়ের চাহিদায় বদলে গেছে সংস্কৃতির এ ধারা। পরিবর্তিত হয়েছে, মোটরসাইকেলের শো-ডাউন, আতশবাজি কিংবা রাতভর বাদ্যযন্ত্রের উচ্চ শব্দের উল্লাসের মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের পূর্ব পুরুষদের যে সংস্কৃতি ছিলো তা রক্ষার্থে আমরা কি নিতে পেরেছি যথোপযুক্ত ভূমিকা? সময়ের সাথে সাথে ধারার পরিবর্তন হবে- প্রকৃতির স্বাভাবিকতায় এ সত্য মেনে নিতে বাধ্য আমরা। কিন্তু পরিবর্তনকে মেনে নিতে গিয়ে অতীতকে ভুলে যাওয়া কিংবা অতীতের স্মৃতি মুছে দেওয়া আমাদের কতটা নৈতিকতার আওতাভুক্ত তা নিয়ে আমি সন্দিহান।

আমাদের বাউল গান হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জারি গান, সারি গান। আগে গ্রাম বাংলায় কিচ্ছার আসর বসতো। দেশ বিদেশের কত্তো রাজা রাণী আর রাজপুত্রের গল্প হতো সেসব কিচ্ছায়। গ্রামের মুরুব্বিদের মুখে শুনা এসব কিচ্ছা, শিশু-কিশোরদের রোমাঞ্চ দিতো। মায়ের কোলে ঘুমোতে যাওয়া ছোট্ট শিশুটি স্বপ্ন দেখতো সে একদিন জাহাজের নাবিক হয়ে সিন্দাবাদের মতো সওদাগর হবে। গুপ্তধনের খুঁজে ছুটবে দিকবিদিক। কিচ্ছার গল্প গুলোর সাথে সাথে কিচ্ছা শব্দটাও হারিয়ে গেছে আধুনিক সভ্যতার অতলে। রেডিওর গানের সুরের চেয়ে কিচ্ছার মাধুর্যতা কি কম ছিলো? তুলনা করছি না, কিন্তু এ কথা তো সত্য – আধুনিক সভ্যতার অনুকরণে রেডিওর গান শুনা শুরু না করলে আমাদের কিচ্ছা বা পালা গানের আসর গুলো হয়তো হারিয়ে যেতো না। টিকে থাকতো আরোও যুগের পর যুগ। সভ্যতার উন্নয়নের প্রবাহ আমাদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে তা কিন্তু আমাদের বুঝার সক্ষমতার বাইরে নয়। আমরা ঠিকই বুঝতে পারি। সময়ের সাথে সাথে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পরিবর্তন একত্রিত হচ্ছে, পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের সভ্যতা, আমাদের সংস্কৃতিগত বোধ।

হয়তো এই পরিবর্তন আমাদেরকে মেনে নিতেই হবে। কেননা পরিবর্তন হয় বলেই সভ্যতা টিকে থাকে। কিন্তু পরিবর্তনের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে অতীতকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। কোন সংস্কৃতির সীমারেখা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় যেমন সত্য, তেমনি অপর এক সত্য হচ্ছে, চেষ্টা করলেই যে কেউ তার সংস্কৃতির মহাত্ম এবং এর গভীরতা অনুধাবন করতে পারে।

ধীরে ধীরে আমরা উন্নত জাতির মাইল ফলকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। বহুল আকাঙ্খিত উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের রাষ্ট্রেও বুলেট ট্রেন চলবে, পানির নিচ দিয়ে গাড়ি ছুটবে, উঁচু উঁচু দালানের উপর ছায়াছবির চিত্রগহণ করা হবে, কিন্তু সেই আমরা অতীত থেকে সেই সময়ের জন্য কি নিয়ে যাচ্ছি সেটা কি কখনো ভেবে দেখার সুযোগ হয় আমাদের? দেশের উন্নয়নের মাধ্যমে যেভাবে কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে, একইভাবে কিন্তু সংস্কৃতিগত পরিবর্তন ও লক্ষ্যনীয়। আমরা আমাদের গ্রামীণ বাংলার গরুর গাড়ি ভুলে গিয়েছি- সংরক্ষণের কোন প্রচেষ্টাও নেই। আমরা জারি, সারি ভুলে যাচ্ছি পরিবর্তে ভিন্ন দেশের, ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন ধারার গান গুলোকে আপন করে নিচ্ছি ধীরে ধীরে। পাঠ্যসূচির বাইরে কাউকে জসীমউদ্দিনের কোন কবিতা আবৃত্তি করতে শুনা যায় না। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, উন্নয়ন প্রবাহে প্রভাবিত হয়ে ভিন্ন সংস্কৃতির চর্চায় আমরা স্বীয় সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিয়ে সংস্কৃতির পরিসর বড় করছি। অদূর ভবিষ্যতে যার ফল হবে- “পরগাছা জাতিতে রূপান্তর।”

সংস্কৃতির পরিসর বড় হতেই পারে, তবে বড় হতে হতে তা যেনো মূল সংস্কৃতি থেকে সরে না যায় তা আমাদেরকেই লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। সংস্কৃতি ধারণ করার পাশাপাশি, হারানো সংস্কৃতি সংরক্ষণ করার উদ্যোগ এখনই নিতে হবে, নতুবা অদূর ভবিষ্যতে আমরা হয়তো সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্ব সংকটে পড়বো। কিছু কিছু বিষয় লক্ষ্য করে ভরসা পাই, যেমন- সম্প্রতি আমাদের পুরোনো মসলিন আবার নবরূপে ফিরে এসেছে। কিছু সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আমাদের গ্রাম বাংলার অতীত সংস্কৃতি আবার পুনঃরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। তবে এতটুকুই যে যথেষ্ট নয় তা হয়তো এতক্ষণে সকলে অনুধাবন করতে পেরেছেন। অন্য কোন সংস্কৃতি আমাদের পরগাছা জাতিতে রূপান্তরের পূর্বেই আমাদেরকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করবো, সংস্কৃতি মেলার আয়োজন, সংস্কৃতি রক্ষায় জাদুঘর তথা বৃহৎ আর্কাইভ গঠন, এবং জনমনে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি ইতিবাচক ধারণা আনার লক্ষ্যে যেনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় হয়তো উন্নত জাতি হিসেবে আর্ত-সামাজিক এবং কাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি, সংস্কৃতির স্বকীয়তা বজায় রেখে নিজেদেরকে পৃথিবীর সকল জাতির নিকট এক অনন্য-আদর্শ জাতি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবো।

মহাকালের উত্থান পতনে দোলিতে দোলিতে,
ছুটিতে হইবে, আপন সত্য ধারণ করিয়া।

তানজীম খান নকিব,
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।