অর্থ পাচারে রাজনীতিবিদের চেয়ে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা বেশী

আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এ কথা বলেন।

ড. এ কে আবদুল মোমেন কানাডায় অর্থ পাচারের বিষয়ে বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে।

কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি।

সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’

দেশটিতে অর্থ-পাচারের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চারজন। এ ছাড়া কিছু আছেন আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ীরা।

আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি। তবে পাচারে শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা।

তবে তথ্য পাওয়া খুব কঠিন। বিভিন্ন মিডিয়ায় যে তথ্য বের হয়, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, আসলে সংখ্যাটি তত নয়।’ ‘যেমন, সুইজারল্যান্ডে কে ব্যাংকে টাকা রাখল, সেই তথ্য আমাদের দেয় না।

তারা ট্রান্সপারেন্সির কথা বলে, কিন্তু যদি বলি কার কার টাকা আছে, সেই তথ্য দাও, তখন তারা দেয় না। এটি একটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ড।’

যদিও বুধবার ওই অনুষ্ঠানে জনাব মোমেন কারা এসব টাকা পাচারকারী তাদের কারও নাম উল্লেখ করেননি। তবে তিনি বলেনট, আঠাশটি ঘটনার তথ্য তারা পেয়েছেন যেগুলোর মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলছেন, কানাডায় বিনিয়োগ কারা করেছেন – সে সম্পর্কে খোঁজ দিতে কমিশন আগেই মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলো।

“আগে দেখতে তো হবে যে কারা বিনিয়োগ করেছেন। তারপর তদন্ত করে দেখা যাবে টাকা পাচার হয়েছে কি-না। কারণ বৈধ আয়ও তো বিনিয়োগ হতে পারে এবং সেটিতে তো পাচার বলা যাবেনা। তবে মন্ত্রী যেহেতু পাচারের কথা বলেছেন তাই তিনি সে তথ্য কমিশনকে দিলে আমরা অবশ্যই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো,” মিস্টার মাহমুদ বললেন।

কমিশন নিজ থেকে কিছু করতে পারে কি-না এ বিষয়ে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “অবশ্যই পারে এবং কমিশনের তেমন আইনি ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমাকে তো আগে তথ্যগুলো পেতে হবে। সেগুলো পেলেই কেবল আমরা তদন্তের উদ্যোগ নিতে পারি”।

যদিও বাংলাদেশ থেকে ক্যানাডায় অর্থ পাচারের বিষয়টি গত কয়েক বছর ধরেই নানা আলোচনায় আসছে। পুরো ক্যানাডায় প্রায় আশি হাজারের মতো বাংলাদেশী আছেন বলে ধারণা করা হয়।

গত এক দশকে বহু উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী ক্যানাডায় গেছেন অভিবাসী হয়ে।

২০০৮ সালের দিকে ও এর পরে ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিতে একটি ভিসা দেয়া হতো, তখন কানাডায় একটি নির্দিষ্ট অংক বিনিয়োগ করে বা ক্যানাডা সরকারের কাছে অর্থ জমা রেখে ইমিগ্রেশনের সুযোগ ছিল।

পরে সেখানকার সরকার এই সুযোগ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এর সুযোগ অনেকে বাংলাদেশী নিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।

অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ক্যানাডায় বাংলাদেশীদেরই মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের মতো ঘটনাও ঘটেছে চলতি বছরের শুরুর দিকেই।

আর ক্যানাডায় অর্থ পাচারের বিষয়ে উদাহরণ দিতে গিয়ে অনেকেই সেখানে বাংলাদেশী এমন ব্যক্তিদের বাড়িঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বেগমপাড়ার কথা উল্লেখ করেন রূপক অর্থে।

সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, টিআইবি যা বলছে
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড: ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে এতদিন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচারের যে অভিযোগ করা হচ্ছিলো – সেটি সত্যি।

তিনি বলেন, “সরকারি কর্মকর্তারাও অনেকে অর্থ পাচারে জড়িত । তারা বিদেশে যাতায়াত করেন। প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে পড়াশোনা বা চিকিৎসা সহ নানা কারণে যেতে পারেন। পাচারের সেটা একটা অন্যতম মাধ্যম”।

তিনি বলেন, এটা সর্বজনবিদিত যে সরকারি খাতে যে অনিয়ম দুর্নীতি হয় তাতে ব্যবসায়ীদের সাথে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকে। এছাড়া সরাসরি ঘুষ নেয়ার অভিযোগ তো অনেকের বিরুদ্ধে আছেই।

অন্যদিকে আবার দেশেও বৈধ সম্পদ যা দেখা যায় তাও আয়ের সাথে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

কিন্তু যারা অর্থ পাঠিয়েছে তার সবই কি বেআইনি ?
ড: ইফতেখারুজ্জামান বলছেন সন্তানদের পড়াশোনা বা চিকিৎসার জন্য বিদেশে অর্থ নেয়ার বৈধ পথ আছে এবং এর সীমারেখাও আছে। কিন্তু যে পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে তার তুলনায় এটি খুব কম।

“চিকিৎসা বা পড়াশোনার জন্য সীমারেখার বাইরেও বিশাল অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে চলে যায়। মন্ত্রী বিষয়টি বলে এ ধারণার বৈধতা দিয়েছেন যে সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতির সাথে জড়িত। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা অংশই হলো রাজনৈতিক অবস্থান হলো অর্থ আয়ের একটি উপায়”।

আর বিদেশে অর্থ রাখা যেহেতু নিরাপদ মনে করা হয় সে কারণে ব্যবসায়ীদের পাশে সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদের একাংশও নিয়ে থাকেন বলেন মন্তব্য করেন মি. ইফতেখারুজ্জামান।

বেগমপাড়া আসলে কোথায়

চলতি বছরের শুরুতে ক্যানাডায় বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে যে মানববন্ধন হয়েছিলো সে সংবাদ প্রকাশ করেছিলো বিবিসি বাংলা।

সে প্রতিবেদনেই কানাডার আলোচিত বেগমপাড়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছিলো যে , “টরন্টোতে বা ক্যানাডায় সেই অর্থে কী কোন সুনির্দিষ্ট এলাকা আছে, যেটিকে বেগমপাড়া বলা হয়?

ওই সময় ক্যানাডায় বসবাসকারী বাংলাদেশী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর বলেছেন, এই বেগমপাড়া আসলে ক্যানাডায় পাড়ি জমানো দুর্নীতিগ্রস্তদের স্ত্রীদের দ্বিতীয় নিবাস অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে এমন কোন সুনির্দিষ্ট এলাকা নেই, যেটিকে ‘বেগমপাড়া’ বলা হয়।

সাজ্জাদ আলি নামে টরন্টোতে একজন রিয়েলটর (রিয়েল এস্টেট এজেন্ট) বলেছিলেন যে এরকম বেগমপাড়া নামে হয়তো কোন এলাকা নেই, কিন্তু এমন জায়গা বাস্তবে রয়েছে, যেখানে এধরণের বহু বাংলাদেশি গিয়ে বসতি গেড়েছেন।

তিনি তখন বলেছিলেন, “বেগমপাড়া যে শুধু কথার কথা, লোকমুখে শোনা ব্যাপার, তা নয়। আমরা দেখি এখানে বাংলাদেশিরা অনেক সংখ্যায়, এমন সব জায়গায় বাড়িঘর কিনেছেন, যেটা একটু অভিজাত এলাকা।

কিন্তু তাদের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে তাদের এই সম্পদ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারা এখানে তেমন কিছু করেন বলে তো আমরা দেখি না। কীভাবে তারা এক বা দুই মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়ি কেনার ক্ষমতা রাখেন!”

কানাডার সাধারণ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ধারণা, কানাডায় অর্জিত সম্পদ দিয়ে তারা এসব বাড়ি কেনেননি, এই অর্থ এসেছে বাংলাদেশ থেকে।

কীভাবে এই অর্থ পাচার হচ্ছে?

বিবিসির আগেকার এক রিপোর্টে বলা হয়, মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কানাডার আইনকানুন যথেষ্ট কড়া।

অর্থ পাচার এবং অবৈধ লেন-দেন বন্ধ করতে কানাডায় কাজ করে ফিনান্সিয়াল ট্রান্সেকশনস অ্যান্ড রিপোর্ট এনালিসিস সেন্টার অব কানাডা বা ‘ফিনট্রাক।’ এসব আইন-কানুনে কি এমন কোন ফাঁক আছে, যার সুযোগ নিচ্ছেন এই কথিত অর্থপাচারকারীরা?

কানাডায় বহু বছর ধরে ইমিগ্রেশন আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন ব্যারিস্টার রেজাউর রহমান। একসময় বাংলাদেশের ‘আইন-আদালত’ নামের এক জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন।

তিনি বলছেন, যখন কেউ প্রথম কানাডায় আসেন, তখন তিনি যে কোন অংকের অর্থ নিয়ে আসতে পারেন, যেটা তার বৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বলে তিনি ঘোষণা করছেন।

“এখন বৈধভাবে যিনি আসছেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চয়ই তিনি কিছু কাগজপত্র দেখাচ্ছেন- যে আমার এই অর্থ ছিল, আমার এই সম্পদ ছিল, সেটা বিক্রি করে, সেখানে কর প্রদান করে আমি এখানে আসছি। সেক্ষেত্রে কানাডার পক্ষে দেখা কঠিন, এই টাকা সত্যি সত্যি বাংলাদেশে বৈধভাবে অর্জিত হয়েছে কীনা।”

বাংলাদেশ থেকে ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় বড় দুর্নীতিবাজরা যে অর্থ পাচার করে কানাডায় নিয়ে এসেছে বলে শোনা যায়, সেটা কানাডার পক্ষে বন্ধ করা কঠিন। এক্ষেত্রে বড় দায়িত্ব বাংলাদেশের, বলছেন তিনি।

“কানাডা তো কানাডার দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তারা কীভাবে বের হয়ে আসলো? এবং কারা তাদেরকে সহায়তা করলো? কীভাবে করলো? সেটা কিন্তু দেখা প্রয়োজন।”

রেজাউর রহমান জানান, পেশাগত জীবনে এমন অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে, যারা কানাডায় অভিবাসী হতে চেয়েছেন অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে।

কিন্তু তিনি কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছেন, তারা প্রচুর মিথ্যে তথ্য দিয়ে আর জাল কাগজপত্র তৈরি করে এই সুযোগ নিতে চেয়েছেন।

“আমার কাছে যখনই কেউ বাংলাদেশ থেকে এধরণের আবেদন নিয়ে আসেন, তার কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর আজ অবধি আমি কাউকে অভিবাসন দিয়ে আনতে সহায়তা করতে পারিনি।

কারণ তারা সেই যোগ্যতা অর্জন করেননি, তাদের কাগজপত্রে দারুণ ভেজাল ছিল। তবে আমি না করলেও তারা অন্য কারও কাছ থেকে এই সহায়তা পেয়েছেন । এরপর আমাকে এসে বলে গেছেন, আপনি তো করেননি, আরেকজন তো করে দিয়েছে।”

রেজাউর রহমান বলেন, “যেটা আমি শুনতে পেয়েছি, বা আমাকে যেটা বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে তারা প্রথমে টাকা পাচার করে অন্যদেশে নিয়ে রাখে- যেমন মধ্যপ্রাচ্যে।

এরপর সেই দেশের ব্যাংক থেকে টাকাটা ট্রান্সফার করেন কানাডায়। তারা দেখান যে, এই টাকা তারা বৈধভাবে অর্জন করেছেন।”

“তারা যদি দেখান যে তাদের কাছে আয়কর প্রদানের কাগজ আছে, যে কাগজপত্র আসলে সম্পূর্ণ ভুয়া, তারা যদি দেখান যে তাদের সম্পত্তির মূল্য এত, যেটা আসলে সম্পূর্ণ ভুয়া, সেটা তো এখানে কারও পক্ষে যাচাই করা কঠিন।”

(তথ্যঃ বিবিসি বাংলা)

বিশ্লেষণঃ টাকা পাচার কেন করে, কীভাবে করে?

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম নির্বাচন কমিশনের কাছে আয় ও সম্পদের কোনো দৃশ্যমান উৎস দেখাননি। ব্যাংকে আমানত পৌনে চার কোটির টাকার একটু বেশি আর প্রায় ২৩ কোটি টাকার বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ার।

ফোর পয়েন্ট জেনারেল ট্রেডিং ও ফোর পয়েন্ট হাউজিং নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তাদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফোর পয়েন্ট হাউজিং রিহ্যাবের সদস্যও নয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেওয়া আয়কর বিবরণী অনুযায়ী, মোহাম্মদ শহিদ ইসলামের একমাত্র আয় ব্যাংকে আমানত রেখে ৭৩ লাখ টাকা সুদপ্রাপ্তি। কৃষি, বাড়ি, ব্যবসা, চাকরি কিছুই তাঁর নেই। পেশার ঘর খালি, কোনো বৈদেশিক মুদ্রাও নেই। এমনকি বিদেশ থেকে কোনো আয়ও নেই।

অথচ অন্তত ৫০ কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচন করেছেন, একজন প্রার্থীকে বসিয়ে দিয়েছেন, ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীদের সমর্থন কিনেছেন, স্ত্রীকেও সাংসদ বানিয়েছেন।

অবৈধ অর্থের লেনদেন নিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) হিসাবে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অবৈধ অর্থ আসে জাল পণ্য কেনাবেচা, মাদক ব্যবসা ও মানব পাচার থেকে। শহিদ ইসলামের বিপুল অবৈধ সম্পদের বড় উৎস মানব পাচার। সরকার যে কালোটাকার খোঁজে থাকে, সেই কালোটাকার মালিক শহিদ ইসলাম।

সুযোগ দিলে কালোটাকা মূলধারায় ফিরে আসে এমন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য বা গবেষণা নেই। এখন পর্যন্ত কালোটাকা বিনিয়োগ জমি, বাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে কালোটাকার গন্তব্য মূলত অন্য দেশ।

সুইস ব্যাংকে জমা হয় কিছু অংশ, কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো ‘ট্যাক্স হেভেন’ নামের পরিচিত দেশে কোম্পানি গঠন বা সম্পত্তি কেনা হয়। যেমন আলোচিত সিকদার গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ড, আবুধাবি ও সিঙ্গাপুরে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। কালোটাকা দিয়ে সিঙ্গাপুরে পাঁচ তারকা হোটেল বা বাণিজ্যিক জায়গা কেনার উদাহরণও আছে। মূল কথা হলো কালোটাকা দেশে থাকে কম, পাচার হয় বেশি।

কালোটাকার সন্ধানে

ব্রিটিশ নৃবিজ্ঞানী কিথ হার্ট ১৯৭১ সালে ঘানার ওপর এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রথম ইনফরমাল ইকোনমি বা অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। এরপর থেকেই অবৈধ অর্থনীতির সমার্থক হিসেবে ‘ইনফরমাল ইকোনমি’, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমি’, ‘হিডেন ইকোনমি’, ‘শ্যাডো ইকোনমি’ বা ‘আনরেকর্ডেড ইকোনমি’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

বিশ্বব্যাপী কালোটাকার সবচেয়ে বড় গবেষক জার্মান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নাইডার। তিনি মনে করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছায়া বা কালো অর্থনীতি তৈরি হচ্ছে মূলত সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও করকাঠামোর অব্যবস্থার কারণে।

তাঁর সমীক্ষা অনুযায়ী, গড়ে সবচেয়ে বেশি কালোটাকা আছে লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চল, সাব-সাহারা আফ্রিকা ও এশিয়ায়।

প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে কালোটাকার পরিমাণ কত। অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্নাইডারের হিসাব অনুযায়ী তা জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ২৮ শতাংশ।

বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়ে কালোটাকা নিয়ে গবেষণা হয়েছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্যোগে ২০১১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় এ নিয়ে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছিল।

‘বাংলাদেশের অপ্রকাশ্য অর্থনীতির আকার: একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ’ নামের এ সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে কালোটাকার হার জিডিপির সর্বনিম্ন ৪৬ থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৮১ শতাংশ।

সমীক্ষায় ১৯৭৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়কে বিবেচনা করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী, টাকার অঙ্কে বাংলাদেশে সে সময় কালোটাকা ছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা।

স্বাধীনতার পর থেকে এ কালোটাকা সাদা করার জন্য অন্তত ২০ বার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জরিমানাসহ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি সাদা হয়নি। তাহলে বিপুল পরিমাণ কালোটাকা কোথায় যায়?

টাকা পাচার: সুইস ব্যাংক মডেল

১৯৩০–এর দশকে ফ্রান্সের রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের একটি অংশ টাকা পাচার করে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে গোপনে রেখে দিয়েছিলেন।

পরে সেই তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। এরপরই ১৯৩৪ সালে সুইজারল্যান্ড ‘সুইস ব্যাংকিং অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন পাস করে। আইন অনুযায়ী, কোনো গ্রাহকের তথ্য সুইস ব্যাংকগুলো প্রকাশ করতে পারবে না।

এরপর থেকেই সুইস ব্যাংকগুলোর গোপন হিসাবে অর্থ রাখার প্রবণতা বেড়ে যায়। তবে ত্রিশের দশকের শেষ দিকে জার্মানিতে নাৎসিদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করলে ইহুদিরা তাদের অর্থ সুইস ব্যাংকে রাখা শুরু করে। সুইস ব্যাংকের রমরমা ব্যবসা তখন থেকেই শুরু।

তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক শাসক ও রাজনীতিবিদ এবং উন্নত বিশ্বের অসাধু ব্যবসায়ীদের অর্থ লুকিয়ে রাখার বড় জায়গা এই সুইস ব্যাংক।

তবে কর ফাঁকি, অপরাধমূলক ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে কঠোর অবস্থান থেকে এখন সরে আসতে হচ্ছে তাদের। তবে সুনির্দিষ্ট গ্রাহকের তথ্য তারা এখনো প্রকাশ করে না।

আর সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের রাখা অর্থের হিসাব পাওয়া যায় ২০০৪ সাল থেকে। দেখা যাচ্ছে, সুইস ব্যাংকের রমরমা অবস্থা যতই কমে যাক, বাংলাদেশিরা সেখানে অর্থ রাখা ক্রমে বাড়িয়েছেন। তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে, এ ভয় সম্ভবত বাংলাদেশিদের নেই।

যেমন ২০০৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ৪ কোটি ১০ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বর্তমান বাজারদর ৮৯ টাকা ধরলে বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ ৩৬৫ কোটি টাকা। আর সর্বশেষ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ২০১৯ সালের। এখন সেখানে অর্থ আছে ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা।

ভারত বা অন্যরা কী করেছে

সুইস ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি অর্থ রাখেন যুক্তরাজ্যের নাগরিকেরা। এরপরই আছে যুক্তরাষ্ট্র, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ফ্রান্স ও হংকং। বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫তম।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থান একমাত্র ভারতের, ৭৭তম। অন্যদের অবস্থান তুলনামূলক ভালো। যেমন পাকিস্তানের অবস্থান ৯৯তম, নেপাল ১১৮তম, শ্রীলঙ্কা ১৪৮তম, মিয়ানমার ১৮৬তম এবং ভুটান ১৯৬তম।

কালোটাকার গন্তব্য মূলত অন্য দেশ, যাকে বলা যায় পাচার

এ নিয়ে খালি বক্তৃতাই দেওয়া হয়, কার্যকর কোনো উদ্যোগ আসলে নেই

পাশের দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, ২০০৪ সালে সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখা দেশের তালিকায় ভারত ছিল ৩৭তম। আর এখন তারা ৭৭তম।

২০০৫ সালে ভারতের নাগরিকদের রাখা অর্থ ছিল ৫৩৫ কোটি সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি টাকায় যা ৪৭ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। আর সে সময়ে বাংলাদেশের ছিল ৯ কোটি ৭০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮৬৩ কোটি টাকা।

২০১৯ সালে এসে সেই ভারত বাংলাদেশের প্রায় কাছে চলে এসেছে। এখন সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের অর্থের পরিমাণ ৬০ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৩৭ কোট টাকা। আর ভারতীয়দের আছে ৯০ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ১০ কোটি টাকা।

বলে রাখা ভালো, সুইস ব্যাংকগুলোতে রাখা অর্থ সাদা না কালো তার কোনো নিশ্চিত তথ্য নেই। হয়তো বৈধ অর্থও আছে।

তবে এর মধ্যে অবৈধ বা কালোটাকার পরিমাণ কত, তা অনেক দেশই এখন জানতে চাইছে। এ জন্য সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে বেশ কিছু দেশ বিশেষ একটি চুক্তিও করেছে।

স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময়কাঠামো নামের এই চুক্তি ভারত করেছে ২০১৬ সালে এবং ২০১৯ সাল থেকে তথ্যও পেতে শুরু করেছে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সুইস ব্যাংকে কী পরিমাণ অর্থ রেখেছে, তার বিস্তারিত তথ্য চাইলে ভারত এখন তা পাবে। এতেই সুইস ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে ফেলছেন ভারতীয়রা।

বাংলাদেশ কী করেনি

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ আছে, এ আলোচনা অনেক পুরোনো।

সাবেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতনের পর তাঁর পাচার করা অর্থ উদ্ধার নিয়ে অনেক আলোচনাও হয়েছিল। ধারণা করা হয়, সে সময় এরশাদের অর্থ সুইস ব্যাংকে রাখা ছিল। এ জন্য ফায়ারফক্স নামের একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছিল সে সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু এর কোনো সুরাহা হয়নি।

তবে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের কী পরিমাণ অর্থ আছে, তা জানা যায় ২০০৪ সাল থেকে। এ নিয়ে ব্যাপকভাবে লেখালেখি শুরু হয় ২০১৪ থেকে।

সাধারণত জুনের শেষ দিকে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনে দেশভিত্তিক আমানতের তথ্য প্রকাশ করা হয় বলে এ সময়টাতেই আলোচনা বেশি হয়।

২০১৪ সালের জুন মাসে সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখা নিয়ে লেখালেখি শুরু হলে ওই বছরের ২৮ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, তাঁর সরকার আমানতকারীদের তালিকা চেয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধপত্র পাঠাবে।

এর আগের দিন, ২৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও তিনি সুইস ব্যাংকে কে কত টাকা রেখেছে, তা বের করার কথা বলেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাই তখন কিছু নড়াচড়াও শুরু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের তিন দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে সুইজারল্যান্ডের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) কাছে সে দেশের ব্যাংকগুলোতে রাখা বাংলাদেশিদের অর্থের তথ্য চাওয়ার পাশাপাশি সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করার জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছিল। অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ওইটুকুই।

এর আগের বছরের (২০১৩) জুলাই মাসে বিএফআইইউ এগমন্ট গ্রুপের সদস্যপদ পেয়েছিল।

এগমন্ট গ্রুপ হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম, যারা মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নসংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কাজ করে।

এগমন্ট গ্রুপের সদস্যরা বিভিন্ন দেশের একই ধরনের সংস্থার কাছ থেকে মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও বিদেশে পাচার করা অর্থের তথ্য পেতে পারে। এ সদস্যপদ পাওয়ার পর সংবাদ সম্মেলন করে তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচার করে কেউ আর সহজে পার পাবে না।’

এরপর থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য নিয়ে লেখালেখি হলেই মুখস্থ কিছু বক্তব্য পাওয়া যায়।

কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার তথ্য আর পাওয়া যায় না। আসলে জোরালো কোনো পদক্ষেপই বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত নেয়নি। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান প্রতি জুনে ধরতে গেলে একই বক্তব্য দিয়ে আসছেন। তবে চলতি বছরে তিনি উদ্যোগ না নিতে পারার জন্য করোনাকে দায়ী করেছেন। যাক একটা অজুহাত তো পাওয়া গেল।

টাকা পাচারের আরও তথ্য

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোন দেশ থেকে কত অর্থ পাচার হয়ে থাকে তার একটি নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রকাশ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই)। এ ক্ষেত্রেও ২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশের তথ্য পাওয়া যায়। অন্য সব দেশের অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া যায় ২০১৭ সাল পর্যন্ত। কিন্তু বাংলাদেশের সর্বশেষ তথ্য ২০১৫ সালর।

কেননা, পরের দুই বছরের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তথ্য জাতিসংঘকে বাংলাদেশ দেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে খোঁজ নিয়েও তথ্য গোপন রাখার সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

জিএফআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। বর্তমান বাজারদরে (৮৫ টাকায় প্রতি ডলার) এর পরিমাণ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। গড় অর্থ পাচারের হিসাবে ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৩তম।

টাকা পাচার নিয়ে জিএফআই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরের চিত্রও সেই একই। খানিকটা হইচই, ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি, এমনকি দুদক থেকেও কঠোর হওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু কোনো কিছুই হয় না।

কেন পাচার হয়

বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের বড় মাধ্যম হুন্ডি। সব ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের অর্থ পরিশোধের জন্য হুন্ডির ব্যবহারই বেশি। দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকে। তাঁরা মনে করেন, ভবিষ্যৎ সেখানেই, বাংলাদেশে নয়।

এ কারণেও অর্থ অন্য দেশে চলে যায়। কানাডার ‘বেগম পাড়া’ এর বড় উদাহরণ। আরেকটি কারণ হচ্ছে দেশে বিনিয়োগের ভালো ক্ষেত্র না থাকা। সুশাসনের অভাবেই মূলত একটি দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে থাকে।

নির্বাচনের সঙ্গে টাকা পাচারের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক এরিকা ফ্রান্টজ।

আফ্রিকার ৩৬টি দেশের ওপর করা ‘ইলেকশন অ্যান্ড ক্যাপিটাল ফ্লাইট:

এভিডেন্স ফ্রম আফ্রিকা’ নামের এ গবেষণায় ১৯৭১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে এরিকা ফ্রান্টজ দেখান, নির্বাচনী চক্রের (ইলেকশন সাইকেল) সঙ্গে পুঁজি পাচারের একটি যোগসূত্র রয়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলেই অনিশ্চয়তা বেড়ে যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটি দেখা গেছে। যেমন ২০০৬ ও ২০০৭ সালের প্রবল রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা রাখার পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল।

তবে সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কঠোর অবস্থান নেওয়ায় ২০০৮ সালে অর্থ পাচার কমে যায়। আবার ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা থাকায় এর ঠিক আগে টাকা পাচার আবার বেড়ে যায়।

এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কি আসলেই অর্থ পাচার বন্ধ করতে চায়? সুইস ব্যাংকের সঙ্গে কোনো আলোচনায় যেতে না পারা কি কেবলই দক্ষতা ও সক্ষমতার অভাব, নাকি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নির্দেশনার অভাব। কার না কার নাম বের হয়ে আসে, সেই ঝুঁকিও তো আছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, অর্থ পাচার রোধে যে আইন ও প্রতিষ্ঠানের দরকার, তা বাংলাদেশের ঘাটতি আছে বলে মনে করি না। যা নেই তা হচ্ছে রাজনৈতিক উৎসাহ।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’-এর ঘোষণা কার্যকর করতে রাজনৈতিকভাবে দৃশ্যমান ও ধারাবাহিক কোনো পদক্ষেপ নেই। আর দুদক প্রকাশ্যে যতই সঠিক কথা বলুক না কেন, প্রভাবশালী কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এ রকম একটি উদাহরণ নেই। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সেটা যে রাজনৈতিকভাবে উপকারী, সেই অনুধাবন না আসা পর্যন্ত কোনো কাজও হবে না। আর সামাজিক ও রাজনৈতিক জবাবদিহির জায়গা শক্তিশালী না হলে এ অনুধাবন আসবে না

সবশেষে তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নতির জন্য গত ১০ বছরে দেশের খেটে খাওয়া মানুষ, বিকাশমান মধ্যবিত্ত, পেশাজীবী, প্রবাসী শ্রমিক, কৃষকসহ সবাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে আসছেন। আর সেই সময় আমাদের উচ্চবর্গের এক দল মানুষ ঠিকমতো কর দেয়নি, শেয়ারবাজার থেকে লুটপাট করেছে, পুঁজি পাচার করেছে, অতিমূল্যায়িত প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

সাধারণ মানুষেরা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে পরিশ্রম করেছে আর সেই আস্থা ও বিশ্বাস নেই বলে উচ্চবর্গের মানুষেরা অর্থ অন্য দেশে নিয়ে গেছে। আর রাজনীতি তাদেরই রক্ষা করছে। সুতরাং রাজনীতির উচ্চারণ ও আচরণের মধ্যে পার্থক্য থাকলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।

(তথ্যঃ প্রথম আলো)