যোগিক সাইন্সফিকশন ও জাফর ইকবালঃ বুদ্ধিজীবীতার তুলনামূলক আলোচনা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
পারভেজ আলমঃ

বাংলাদেশতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কেন্দ্র ছিলনা কখনো। সাহিত্যের কেন্দ্রও না। তো বাংলাদেশে আপনি একেবারেই মৌলিক সায়েন্স ফিকশন কিভাবে আশা করেন?

সায়েন্স ফিকশনতো খুব হালকা কিছু না। সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও প্রযুক্তির উৎকর্ষকে মাথায় রেখে ভবিষ্যত দুনিয়ার একটা ছবিতো তারাই আঁকতে পারবে, যারা সমসাময়িক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সাহিত্যের জগতের কেন্দ্রে অবস্থান করেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশ হইল পুঁজিবাদী দুনিয়ার প্রান্তে হাজির থাকা একটা বিচ্ছিন্ন এলাকা। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে এই বিচ্ছিন্নতা খানিকটা দূর হলেও আশি/নব্বইয়ের দশকে ঘটনা একেবারেই ভিন্ন ছিল।

তখনকার বাংলাদেশটা বর্তমানের সাপেক্ষে শুধু কয়েক দশক আগের না, একটা শতাব্দী এবং একটা শহস্রাব্দ আগের বাংলাদেশ।

গত শতাব্দীতে আমাদের উপন্যাস অনেকাংশেই আচ্ছন্ন ছিল এমন এক বাস্তবতাবাদ দ্বারা, যাকে আপনি ভেতো বাঙালি বাস্তবতাবাদ বলতে পারেন।

বাঙালি মধ্যবিত্তের সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন, সংগ্রাম ইত্যাদির বাইরে আমাদের উপন্যাসের এলাকা খুব একটা বিস্তৃত ছিলনা। আপনার সাংস্কৃতিক দিগন্তের সীমার মধ্যেই তো আপনার কল্পনার বিস্তার আটকে থাকবে। আমাদের দিগন্তটা অনেক ছোট ছিল।

মৌলিক সায়েন্স ফিকশন লিখবার মতো জিনিসপত্র আমাদের দৃশ্যপটে তেমন একটা হাজির ছিলনা।

যার কারনে আশি/নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে যারা জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন, তারা বিদেশী কাহিনীর অবলম্বন/অনুপ্রেরণাতেই তা করেছেন।

এই কারনেই মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে সরাসরি নকল করে লেখার অভিযোগটা আমার কাছে সমস্যার মনে হয়।

তাছাড়া সত্তর/আশির দশকে সায়েন্স ফিকশন জনরায় কাছাকাছি থিমের উপর নির্ভর করে অনেক বই লেখা হয়েছে, সিনেমা বানানো হয়েছে।

সায়েন্স ফিকশন ছিল বহুক্ষেত্রেই সচেতন ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি ও যৌগিতকতার সমাহার।

তবে আমার মনে হয় যে বিদেশী কোন কাহিনীর অবলম্বনে বা অনুপ্রেরণায় (তা যতো সামান্যই হোক না কেন) বাংলা উপন্যাস লিখলে অন্তত তা উল্লেখ করে দেয়া উচিৎ।

মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে এইক্ষেত্রে আমার হালকা অভিযোগ আছে। তবে ঐ যে বললাম, দুনিয়া বিচ্ছিন্ন একটা দেশের শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে ঐ সময় তা অতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা।

মুহাম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনগুলার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আসলে তার বই পাঠ করেই সায়েন্স ফিকশন পড়া শুরু। এরমধ্যে সবচাইতে বেশি কৃতজ্ঞ আমি তার সাইবারপাঙ্ক ঘরানার উপন্যাসগুলার কাছে।

ক্রুগো যার মধ্যে প্রধানতম, যে উপন্যাসটি ছিল আমার পড়া প্রথম সায়েন্স ফিকশন ঘরানার উপন্যাস, এবং প্রথম সাইবার পাঙ্ক ঘরানার কাহিনীও। আমি ঠিক শিওর না, তবে জাফর ইকবালই বোধহয় বাংলা ভাষায় সবচাইতে বেশি সাইবারপাঙ্ক ঘরানার উপন্যাস লিখেছেন।

পারভেজ আলম, লেখক, একটিভিস্ট, ব্লগার

এর পেছনে একটা কারন হয়তো যে তিনি যেই সময় আমেরিকায় ছিলেন, সেই সময়টাতে সাইবারপাঙ্ক ঘরানার বেশকিছু ক্লাসিক উপন্যাস লেখা হয়েছে, সিনেমা বানানো হয়েছে।

সাইবারপাঙ্ক ঘরানার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যে তা খুব আশাবাদী কোন ভবিষ্যত কল্পনা করেনা, বিজ্ঞানের আশির্বাদে দুনিয়ায় কোন স্বর্গ হাজির করেনা।

বরং এই জনরাগুলা আমাদেরকে দেখায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের পাশাপাশি বৈষম্য, বর্বরতা, অবিচারের এক দুনিয়া।

Cyberpunk

সাইবারপাঙ্ক গল্পগুলাতে হাইটেক এবং লো-লাইফের এক ধরণের সমন্বয় দেখা যায়। পুঁজিবাদী বাস্তবতাবাদ জিনিসটা সাইবারপাঙ্কে যেভাবে ধরা পড়ে, তা এই জনরাকে আলাদা করেছে।

একটা সময় ডিসটোপিয়ান উপন্যাস বা সিনেমা ছিল নতুন জীবন ও জগত কল্পনার উপায়। কিন্তু উত্তরআধুনিক কালপর্বে দেখা গেল যে ডিসটোপিয়ার মধ্যেও আমরা পুঁজিবাদী বৈষম্য ও অবিচারের বাইরে নতুন কিছু কল্পনা করতে পারছিনা।

এধরণের গল্পে তাই সুপার কম্পিউটার আর মহাকাশযানের পাশাপাশি আমরা দেখি সার্ভেইলেন্স প্রযুক্তিতে আবদ্ধ জীবন, এবং/অথবা অধিকার হারিয়ে ফেলা ও হতদরিদ্র মানুষের জীবন।

ব্লেড রানার বা ম্যাট্রিক্সের মতো সিনেমাগুলা যারা দেখেছেন, তারা এই জনরার বৈশিষ্ট্যটা সহজেই ধরতে পারবেন।

আশি/নব্বইয়ের সাইবারপাঙ্ক জনরার গল্পগুলা যে ধরণের ভবিষ্যত হাজির করেছিল তা আসলে আমাদের বর্তমানেরই একধরণের প্রফেসি বা প্রগনসিস ছিল। বাঙলা ভাষায় এই ধরণের ভবিষ্যত আমাদেরকে যিনি দেখিয়েছেন সবচাইতে বেশি, তিনি হলেন মুহাম্মদ জাফর ইকবাল।

অন্তত আমি ভবিষ্যতের এই ধরণের প্রফেসি বা প্রোগনোসিস তার লেখা থেকেই পেয়েছি প্রথম। এখন এই প্রোগনোসিস বা ভিশন মৌলিক না হয়ে জনরার বৈশিষ্ট্য হতে পারে, কিন্তু তাতে আমার লাভের গোলাটা শূন্য হয়ে যায় না।

তাছাড়া এই ধরণের দুনিয়ার নায়কদের যে খানিকটা অসামাজিক, এডভেঞ্চারাস, ট্রাকিয়েশন খুলে ফেলে সামাজিক নিরাপত্তা ও সার্ভেইলেন্সের বাইরে চলে যাওয়া জীবন, এবং একিসাথে মানুষ, অন্য প্রাণ, সাইবর্গ ও রোবটদের জন্যেও দয়া বা রহমত ধারণ করা চরিত্র হিসাবে হাজির করতেন মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, তাও আমাকে খুব আকর্ষণ করতো।

আমার রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনকে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালীই মানবো। রাজনৈতিক কর্তাসত্তা অর্জনের জন্যে সায়েন্স ফিকশন পাঠ করাটা আমাদের সময়ে রাজনৈতিক দর্শন পাঠ করার চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনগুলার কেজো গুরুত্ব আমরা এখনো ঠিকভাবে অনুধাবন করে উঠতে পারি নাই। তা করা জরুরি।

কেননা গত শতকের দুনিয়া বিচ্ছিন্ন দেশটি এখন সারা দুনিয়ার সাথে যেমন অনেক বেশি কানেক্টেড হয়েছে – তেমনি পরিণত হয়েছে এই দুনিয়ার সবচাইতে বড় একটি বস্তি ও ভাগাড়ে।

বাংলাদেশকে এখন আপনার একটা সাইবারপাঙ্ক উপন্যাসেরই অংশ মনে হলে আপনি ভুল করবেন না।

বর্তমান বাংলাদেশের এই সাইবারপাঙ্ক বাস্তবতা সবচাইতে ভালভাবে ফুটে উঠেছে হলিউডি রিপ্রেজেন্টেশনের জগতে। যেমন আপনি যদি এক্সট্রাকশন নামক একশন সিনেমাটির শুরুর দিকের দৃশ্যাবলীর সাথে সাইবারপাঙ্ক জনরার সিনেমা এলিসিয়ামের শুরুর দৃশ্যাবলীকে মিলিয়ে দেখেন – আশ্চর্য মিল পাবেন।

 

এক্সট্রাকশন
হলিউড নির্মিত “এক্সট্রাকশন” ছবিতে ঢাকার চিত্র

মিল পাবেন ব্লেড রানার সিরিজের সিনেমাগুলার বিভিন্ন দৃশ্যের সাথেও। আমি এখানে তুলনা হিসাবে এলিসিয়াম ও এক্সট্রাকশন সিনেমার শুরুর দিকের দুইটা দৃশ্যের ছবি তুলে ধরছি।

প্রথমটায় দেখানো হয়েছে বস্তিতে পরিণত হওয়া একটা ভবিষ্যত দুনিয়ার (যেখানে শাসক শ্রেণী আকাশে বানানো এক বেহেশতে থাকে) দৃশ্য, আর দ্বিতীয়টায় দেখানো হয়েছে দক্ষিণ ঢাকার একাংশের দৃশ্য।

সবমিলিয়ে, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের তথাকথিত যৌগিক সায়েন্স ফিকশনগুলা আসলে তার পত্রিকায় লেখা কলামগুলার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

(মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে কলাম লিখতে মানা করা আহমদ ছফার একটি বক্তব্য সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। ছফার বক্তব্য যা-ই হোক, আমার মনে হয় বাংলাদেশে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের প্রতি মানুষের যে ক্ষোভ ও অভিযোগগুলা আছে তার জন্যে আসলে এই মানুষদের বাসনাগুলাই বেশি দায়ী।

তারাইতো তাকে কলাম লেখা বুদ্ধিজীবী বানিয়েছেন। আমি কখনো মুহাম্মদ জাফর ইকবালের কলাম থেকে কিছু শিখতে যাই নাই, তাই কলাম লেখক বুদ্ধিজীবী হিসাবে তার প্রতি আমার তেমন কোন অভিযোগও ছিলনা (না লিখলেই ভাল করতেন এই মতের বাইরে)।

আসলে যারা বিজ্ঞানের লোক, এবং একিসাথে সাহিত্য করতে চান, তাদের জন্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখা রাজনৈতিক কলাম লেখার চাইতে অনেক বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিকভাবে জরুরি কাজ।

আমাদের দেশে মানুষ বুদ্ধিজীবী বলতেও খুব সীমাবদ্ধ একটা চরিত্র হাজির করে, যা বৈচিত্রময় বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার জন্যে ক্ষতিকর।

আসলে, যেকোন ডিসিপ্লিন বা পেশার লোকই নিজেরা যা ভাল পারেন, তা দিয়েই বুদ্ধিজীবী হিসাবে বেশি ভাল ভূমিকা পালন করতে পারেন।

বুদ্ধিজীবীরতো বিশেষ কোন টাইপ নাই। তাছাড়া আপনি নিজের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের জায়গা থেকে লেখালেখি করলে, সায়েন্স ফিকশন লিখলেই কী আর কলাম লিখলেই কী?

আপনি তখন বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করতে পারবেন খুব বেশি চিন্তা না করেই, কারন আপনার নিজের এলাকায় আপনি একজন বুদ্ধিজীবী – একেবারে আনকনসাস লেভেলেই)।

লেখকঃ পারভেজ আলম, ব্লগার, একটিভিস্ট