মূর্তি, ভাস্কর্য এবং ধর্ম

ভাস্কর্য

নিছার আহমেদ: বয়ঃসন্ধিকালে যে স্কুলে পড়তাম সেখানে অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি পাঠাগার ছিল। আমি বলছি উনিশশ আশির দশকের শুরুর সময়কার কথা।

সে সময়ে বাংলাদেশে ওই রকম বাংলা এবং ইংরেজি বইয়ে ঠাসা স্কুল পাঠাগার আশা করা যেত না। সেই সৌভাগ্যের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি যথাসাধ্য।

প্রচুর বই পড়েছি তখন। বুঝি আর না বুঝি, দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশম্যান্ট’, টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর মতো দাঁতভাঙা বই পড়ার দুঃসাহস করেছি।

প্রেম, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, ভ্রমণ কাহিনি, আরও কত কী যে পড়েছি। বেশিরভাগই মনে নেই এখন আর। না থাকলেও ক্ষতি নেই, কারণ সেই বুভুক্ষের মতো বই গিলে খাওয়া নীরবে গড়ে তুলেছে আমার ভবিষ্যৎ মানস ও যুক্তিবাদী মনন।

ওই বয়সেই আমার ধর্মীয় চিন্তায় পরিবর্তন আসতে থাকে। নামাজে দাঁড়িয়ে মুখস্থ করা আরবি সুরা এবং দোয়া দরুদ নিঃশব্দে পড়তে পড়তে বিক্ষিপ্ত মস্তিস্কে অনেক রকম চিন্তায় ডুবে যেতাম।

অনেক প্রশ্ন এসে ভিড় করত মাথায়। কেন যে নামাজের সময়েই এমন সব চিন্তাভাবনা এসে ভিড় করত, জানি না। হয়তো নামাজে মনোযোগ না থাকায় মস্তিস্ক সময় পেত অন্য কিছু নিয়ে ভাববার।

ভাবতাম, নামাজের সব কিছু আরবিতে কেন বলতে হয়? নামাজ যদি আল্লার উদ্দেশ্যে হয়, আমি তো বুঝতে পারছি না আমি তার উদ্দেশ্যে কী বলছি।

এর চেয়ে কি আমি আমার মতো বাংলায় প্রার্থনা করলে ভালো হতো না? আমার প্রার্থনা কি নামাজের নিয়ম মেনেই করতে হবে? কেন? আরও কতসব প্রশ্ন।

সেসব প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া তো দূরের কথা, জিজ্ঞেস করারও সাহস হয়নি শারীরিক শাস্তি বা তিরস্কারের ভয়ে। নিজে নিজেই উত্তর খুঁজে নিতে থাকলাম ধীরে ধীরে বইয়ের জগতে।

ভাস্কর্য
বিভিন্ন দেশের ভাস্কর্য

সেসব উত্তর আমার নিজের জন্যই। আমার ধারণা, প্রত্যেক মানুষকেই তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে হয়। নাহলে কোনো উত্তরই পুরোপুরি সন্তোষজনক হয় না।

সে যাই হোক, পুরোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই নতুন প্রশ্ন জমাট বাঁধতে থাকল। তেমনি একটি প্রশ্ন নিয়ে এই লেখার অবতারণা।
এই প্রশ্ন যুগ-যুগান্তরের এবং আমার ধারণা এর সর্বজনস্বীকৃত উত্তর কোনো দিনই পাওয়া যাবে না, যতদিন মানুষের মাঝে ধর্ম বেঁচে থাকবে।

আসলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য উত্তরের প্রয়োজনও নেই বোধকরি। যে যার নিজের উত্তরে সন্তুষ্ট থাকলে এবং অন্যদের নিজস্ব উত্তরের অধিকার আছে মেনে নিলেই হলো।

এবার আসি আমি কী প্রশ্ন নিয়ে ভাবছি, কী উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছি এবং কেন সেই উত্তর আমার কাছে গ্রহণযোগ্য।

প্রশ্নটি অধিকাংশ মুসলমানের কাছে মূর্তি বা ভাস্কর্যের গ্রহণযোগ্যতার অভাব নিয়ে। আসলে গ্রহণযোগ্যতার অভাবটা প্রত্যেকের নিজস্ব গণ্ডির ভেতর থাকলে আমার মধ্যে তেমন কোনো ভাবনার উদ্রেক হতো না।

প্রশ্ন জেগেছে যখন দেখলাম মুসলিমদের মধ্যে একাংশ তাদের অপ্রীতিটা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ে গেল সেই স্কুলজীবনের নামাজ পড়ার সময়ের একটা ভাবনার কথা।

ভাবতাম, মুসলিমদের মতো হিন্দুরাও প্রার্থনা করে তাদের স্রষ্টার কাছে। মুসলিমরা প্রার্থনা করে এক নিরাকার স্রষ্টার কাছে আর হিন্দুরা করে স্রষ্টার কোনো এক কাল্পনিক রূপকে সামনে রেখে।

তাহলে মূর্তির সামনে বসে প্রার্থনা বা পূজা মুসলিমদের কাছে কেন গ্রহণযোগ্য নয়?

দু’পক্ষই প্রার্থনা করছে কোনো এক অদেখা শক্তির কাছে তাদের সব দুঃখ, বেদনা, আশা, আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে, কৃত পাপের জন্য ক্ষমা চেয়ে এবং পাপের পথ থেকে মুক্তি চেয়ে, আর মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে শান্তির আশায়।

মনে হতো, নিরাকার আল্লাহয় তো মনোযোগ রাখতে পারছি না। আসলে সেই অমনোযোগের দায় যে আমার অল্প বয়সের বিক্ষিপ্ত মস্তিস্কে সেটা বোঝার বয়স তখনও হয়নি।

আরও অনেক পরে প্রাপ্ত বয়সে এসে বুঝতে পেরেছি প্রার্থনা যে আঙ্গিকেই করি না কেন আমার প্রার্থনাকালীন ভাবনাটাই আসল।

যা খুঁজছি তা অন্তঃস্থলের কত গভীরে ধারণ করতে পারছি চিন্তায়, চেতনায় সেটাই প্রধান অভীষ্ট। আমার সামনে কিছু আছে বা নাই সেটা মুখ্য নয়।

সাধু বুজুর্গ মানুষের না লাগে মূর্তি না লাগে জায়নামাজ। তারা ভীষণ কোলাহলের মধ্যেও নিমগ্ন হয়ে যেতে পারেন তাদের সত্যের সন্ধানে।

প্রার্থনার নিয়ম, কাঠামো, কিংবা সাকার বা নিরাকার স্রষ্টার প্রয়োজন হয় আমার মতো সাধারণ মানুষের। আমার বাবা-মা দু’জনেই চলে গেছেন অনেক বছর হয়ে গেল।

নিজের এবং সংসারের প্রাত্যহিক চাহিদা পূরণ, সন্তানের ভালো-মন্দ দেখভাল করা এবং অন্যান্য সামাজিক দায়িত্ব পালন করে জীবনের সময় কেটে যায় ব্যস্ততায়।

যতই দিন যায়, বয়স বাড়ে, বাবা-মার মুখচ্ছবি ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে আসতে থাকে।

কিন্তু যখনই বাবা বা মায়ের একটি ছবি দেখি, বাঁধভাঙা স্রোতের মতো একগাদা স্মৃতি ভেসে আসে তাদের স্বচ্ছ মুখাবয়বের সঙ্গে।

মেহেরপুরের মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে
মেহেরপুরের মুজিবনগরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। 

নির্জীব ছবিটি রূপ নেয় একটি চলচ্চিত্রে; যার মধ্যে আমার বাবা-মা জীবন্ত হয়ে ওঠেন। একটা ছবি আমাকে নিয়ে যায় তাদের অনেক কাছে।

যাদের ভালোবাসা আমার চেয়ে গভীর কিংবা ধ্যানের উৎকর্ষ অনেক উঁচুতে তারা হয়তো চোখ বুজলেই দেখতে পান প্রিয়জনদের। কিন্তু, আমার জন্য ওই একটা ছবিই উৎকৃষ্ট মাধ্যম।

সুতরাং, জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নিরাকার স্রষ্টাকেই খোঁজা হোক অথবা স্রষ্টার কাল্পনিক মূর্তির মাধ্যমে তাকে খোঁজা হোক, কোনোটাই আমার কাছে অগ্রহণযোগ্য নয়।

আমরা একক বা সম্মিলিতভাবে প্রার্থনার যে পদ্ধতিতেই বিশ্বাস করি না কেন, অন্যের পথটা যে তার জন্য উপযুক্ত বা কার্যকরী নয় সেরকম ভাববার কোনো যুক্তি নেই।

মূর্তি প্রসংগের অবতারণা যখন করলামই, আরেকটু বলি। আমার জানা মতে, প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলাম এবং ইহুদি ধর্মে প্রতিমার সামনে প্রার্থনা করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ।

ইহুদিদের একাংশ মনে করে এমনকি তাদের ধর্মগ্রন্থকে সম্মান দেখিয়ে নম করাটাও বিগ্রহ পূজাসম। গোড়া ইহুদিদের কাছে কোনো বস্তুই- সেটা যদি তাদের ধর্মগ্রন্থ তোরাও হয়- অতিরিক্ত ভক্তির উপযুক্ত নয়; সেরকম ভক্তি দেখানো বিধাতার অবাধ্যতা।

ঢাকায় কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য
ঢাকায় কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য

ইসলামে প্রতিমা পূজা নিষিদ্ধ হলেও, নবী এবং কোরআন অতি উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠিত। এই দুটি ধর্মীয় স্তম্ভের প্রতি সাধারণ মুসলমানের ভক্তির গভীরতা গোড়া ইহুদিদের বিচারে একাত্ববাদবিরোধী বিবেচিত হবে।

তাই বলে গোড়া ইহুদিরা ঠিক বা মুসলমানরা ভুল, এর কোনোটাই নয়। যেটা একাহ্নে বিবেচ্য তা হচ্ছে, এক ধর্মের কাছে যা গভীর শ্রদ্ধার প্রকাশ অন্য ধর্মে তা হয়ে যায় বিগ্রহ পূজা, একাত্ববাদের পরিপন্থি।

আমার জানামতে অধিকাংশ মুসলমানের আপত্তি মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর প্রতিকৃতি বা ছবিতে। অনেক মুসলমান পরিবার তাদের বাড়িতে কোনো ভাস্কর্য কেন, কোনো ছবিই রাখেন না।

যদিও আমার অতি সীমিত জ্ঞানে ভাস্কর্য বা ছবির পূজা না করলে শুধু রাখাটা ধর্মবিরুদ্ধ কাজ হবার কথা নয়। মুসলমানরা প্রার্থনা করে একমাত্র আল্লাহর কাছে।

সেটা মেনেই যদি কেউ তার বাবা বা মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে মা-বাবার জন্য দোয়া চায়, সেটা ধর্মের খেলাপ হবে কেন? আফগানিস্তানের বামিয়ানের পাহাড়ে বুদ্ধের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে তো কেউ বুদ্ধের পূজা করে নাই বা কুষ্টিয়ার শেখ মুজিবের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে কেউতো মুজিবের কাছে প্রার্থনা করে নাই।

বঙ্গবন্ধু ভাঙ্গা ভাস্কর্য মূর্তি
বঙ্গবন্ধু ভাঙ্গা ভাস্কর্য

তাহলে সেসব ভাস্কর্যের প্রতি কেন আক্রোশ ধর্ম বিশ্বাসীদের? এতে কি মুজিবের প্রতি কারও ভালোবাসায় এতটুকু চির ধরবে, ধর্মের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বাড়বে, নাকি ধর্মবিশ্বসীদের আমরা অসহিষ্ণু ভাবব?

ফলাফল অনুমান করা কঠিন নয়। মূর্তি, ভাস্কর্য যাই বলি না কেন, শিল্পকর্ম চিরকালই ছিল এবং থাকবে। যারা শিল্পকর্মকে ধর্মের বিপক্ষে দাঁড় করাচ্ছেন, পরাজয় তাদেরই হয়েছে চিরকাল।

শিল্পকর্মকে অসম্মান করে ধর্মের সম্মান উদ্ধার করা যাবে না। বুঝতে হবে, ধর্ম ও শিল্পকর্ম একে অপরের বিরোধী নয়।