পয়সাওয়ালাদের খপ্পর থেকে আপনি নিরাপদ তো?

ভিক্টিম মেয়েটাকে ‘রক্ষিতা’ বলে শোরগোল করছে যে জনপদের মানুষেরা। তারা নিজেরাই যে বসুন্ধরা গ্রুপের রক্ষিতা নিজের অজান্তে, সে ভাবনা আর তাদের মাথায় আসে না।

বিশেষতঃ ঢাকা, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিসের প্রত্যেকটা নাগরিকই এই বসুন্ধরা গ্রুপের লালসার পরোক্ষ শিকার।

ঢাকা শহর বাসযোগ্য করার জন্য নকশা হিসেবে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) হয়েছিল ২০১০ সালে।

কিন্তু বসুন্ধরার দখলকৃত হাজার হাজার কোটি টাকার জমি দখলে চাপ পড়বে, এজন্য মন্ত্রণালয়ের মিটিং-এ সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানকে হুমকি ধমকি দিয়েছিল, এই বসুন্ধরা গ্রুপের মালিক আহমদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলম। বেচারা মন্ত্রী মান্নান খান আর এমপিই হতে পারেন নাই এরপর।

ওই মিটিং-এর বিশেষজ্ঞ প্রয়াত প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে অত্যন্ত অপমানজনক কথা বলে তেড়ে এসেছিল এই বসুন্ধরার শাহ আলম।

ঢাকা চট্টগ্রাম কিংবা নায়ারণগঞ্জের শত শত মানুষ জানে বসুন্ধরা গ্রুপের লালসা কত মারাত্মক হতে পারে। সেখানে এক মফস্বলি টিনেজার মেয়ে নিতান্ত অসহায়।

এই মালিকের বড় ছেলে সানভীর চার দলীয় জোট আমলে একই নারী ঘটিত কারণে তাদের এক ইঞ্জিনিয়ারকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলে। হাওয়া ভবনের মধ্যাস্থতায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুতফুজ্জামান বাবর, সেই মামলা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন।

বিনিময়ে বিএনপির নির্বাচনী ফান্ডে ১০০ কোটি দেয়ার স্বাক্ষ্য আছে বাবরের তত্ববধায়ক আমলের জবানবন্দিতে।

ওই লেনদেন হয়েছিলো কি না, সেই সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এই ঘটনার পর আর তিন মাস ক্ষমতায় ছিলো বিএনপি সরকার। সে যে জড়িত ছিল, এই ঘটনার স্বাক্ষী কাজের মেয়ের স্বাক্ষ্যকে বাতিল করা হয়েছিল, মেয়েটির মাথায় সমস্যা আছে এবং চরিত্র খারাপ এই আখ্যা দিয়ে।

২০১১সালের ১৫ডিসেম্বর অর্থাৎ আওয়ামী লীগের আমলে রাষ্ট্রপক্ষের উপর দায় চাপিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামী সানবীমসহ সকল আসামীকে বেকসুর খালাস দেয় দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল। সেখানে আসামী পক্ষের উকিল ছিলো ব্যারিস্টার তাপস, এখন যে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র।

পাপী মনে প্রশ্ন জাগে হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার জন্য যদি ১শ কোটি টাকা চাওয়া হয় তবে বেকসুর খালাসের খরচ কত। মনে রাখতে হবে, বিএনপি মামলাটা ধামাচাপা দিতে ব্যর্থ হলেও আওয়ামী লীগ আমলে বেকসুর খালাসে কোনো ব্যর্থতা ছিলো না। শুধু রায়ের দিন বাদী পক্ষের কেউ কোর্টে উপস্থিত ছিলো না, তারা আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছিলো কি না এ সংক্রান্ত তথ্যও মিডিয়ায় আসেনি।

আর মালিক আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলমের ব্যাক্তিগত কাজের লোকের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে এই ১০ মাস আগে। সেই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে।

এই যে এই সাম্প্রতিক ঘটনায় জড়িত ছোট ছেলেটা, এর বিরুদ্ধে এরকম বহু নারী কেলেংকারী আর জবরদস্তির অভিযোগ আছে।

এমনকি চট্টগ্রামের এক এমপি-র পূত্রবধূকে তুলে নেয়ার হুমকিরও অভিযোগ আছে।

কিছুদিন আগেও রাস্তায় এক বৃদ্ধকে গাড়ি চাপা দিলেও কিছুই হয় নাই এর বিরুদ্ধে।

এর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আরেক শিল্পপতির ছেলের কথা শুনেছিলাম ঢাকার এক প্রাইভেট মেডিক্যালের কাশ্মিরি ছাত্রীকে এরকম ‘মামুনুল স্টাইলে মৌখিক কবুল পড়ে’ এভাবে ম্যানিপুলেট করছিল।

খোঁজ নিলে দেখা যাবে হয়তো, এক্ষেত্রেও দুই জন স্বাক্ষী রেখে মৌখিক বিয়ে করেছিল গোপনে। কয়েক সেকেন্ডের ওই মেকি বৈধতায় দুই বছরের জিম্মি জীবন। এজন্যই মেয়েটা ওর স্ত্রীকে সব ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিল স্বীকৃতির আশায় সম্ভবতঃ।

কিন্তু বসুন্ধরা গ্রুপের ম্যাক্রো লেভেলের রক্ষিতা আমাদের সহ-নাগরিকরা এখন একটা এতিম, মফস্বল থেকে আসা ভাগ্যবিড়ম্বিত মেয়ের লাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভিক্টিম ব্লেমিং করছেন। মেয়েটি গোল্ড ডিগার ছিল, সে পারিবারিক অনুশাসন মানে নাই, সে রক্ষিতা ছিল- এসব বহু জল্পনা।

অথচ এই মানুষেরা বুঝতে যায় না, হাজার হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া, হাজার হাজার একর জনগণের সম্পত্তি জোর দখল করে রাখা এই আনভীররা একটা টিনেজার মেয়ের দিকে তাকালে, সেই মেয়ের অসহায়ত্ব।

আমার এক বন্ধু আমাকে মেয়েটার ইন্সটাগ্রাম আইডির লিংক দিয়েছে। তো মেয়েটার আইডিতে গেলে আপনি দেখবেন, তার হাতে মেহেদী দিয়ে আনভীরের নামের আদ্যক্ষর লেখা। মানে সে কী পরিমাণ ম্যানুপুলেট করতো নিজের মেয়ের বয়সী একটা টিনেজারকে।

মেয়েটার পোস্টের কিছু খাবার দাবার, কিছু মেয়েটির ছবি। তো ইন্সট্যাগ্রামে কথিত রক্ষিতার ছবি দেখতে গিয়ে নিজের ছোটবোন কিংবা কাজিনের মতোই একটা সাধারণ সৌম্য শান্ত মেয়ের ছবি দেখলে হয়তো হতাশও হবেন নাগরিককূল।

আর ইন্সট্যাগ্রামের সবচে’ আনেক্সপেক্টেড কিন্তু হৃদয়গ্রাহী জিনিস লক্ষ্য করলাম- যে ওর নিজের ছবি কিংবা এক্টভিটির চাইতে বেশী শেয়ার দেয়া ছিল কোরআনের আয়াত, হাদিস সংকলন, ধৈর্য্যের দোয়া, খোদার ক্ষমা প্রার্থনা।

এইসব যে ওর প্রিটেনশাস কার্যকলাপ, সে আলাপের চেয়েও বেশী সন্দেহ করি, ওর জীবনের মনস্তাত্বিক বিপন্নতাকে।

প্রভাবশালী, পয়সাওয়ালা হায়েনার খপ্পড়ে পড়ে গেলে বের হয়ে আসা মুশকিল। সেই যে জৌলুশময় দোযখ, সেই যে জীবনের জাহিলিয়্যাত; এসব থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব না। কেবল খোদার সাহায্য প্রার্থনা ছাড়া।

জালেমের ফ্ল্যাটে থেকে যে তাহাজ্জুদের দোয়া শেয়ার দেয় খোদার নৈকট্য চেয়ে। আল্লাহর মাগফিরাতের দোয়া আর রাসূলের হাদিস শেয়ার দেয়। এসব দেখে, আমার চেয়ে কমপক্ষে দশ বছরের ছোট একটা টিনেজারের জিম্মি জীবনের ডিলেমা আমি অনুভব করবো না হয়তো। কিন্তু কিছুটা বুঝতে পারি।

কারণ বাংলাদেশের নাগরিক মানেই তো জালেমের ফ্ল্যাটে জিম্মি থেকে, সমাজের কাছে সহায়হীন হয়ে, খোদার শেষ বিচারে অন্ততঃ ভরসা রাখা।

নিজের ভ্রান্তি আর নাগরিক লালসার আলাপ তো সেকেন্ডারি আলাপ। এই মেয়ের ক্ষেত্রেও হবে তাই।

কিন্তু ভাই এই জাহিলিয়াতের সমাজে, যে মানুষ লাশ হয়ে গেছে, মজলুমের চিহ্ন রেখে। আসুন অন্ততঃ তার জালেমকে ঘেন্না করি, মজলুমের লাশ না খুঁটিয়ে। ওইটুকু দরদ যেন পায় কোন লাশ।