শিক্ষা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের তলানিতে থাকা নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স-২০২০
আমরা যা করছি তার ফল আমরা এখন পাচ্ছি। এর সঙ্গে আরেক বড় সমস্যা হলো আমরা জ্ঞান নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে পরীক্ষা নির্ভর ব্যবস্থায় চলে গিয়েছি। সবাই শুধু কোন রকমে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে চায়। আরেকটা বড় সমস্যা হলো আমাদের শিক্ষা বা জ্ঞানে গবেষণা বলে কিছু নেই। কৃষিতে দেখেন আমরা কত এগিয়ে গিয়েছি? এটা সম্ভব হয়েছে গবেষণার কারণেই

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী এবং মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম।

এবার বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর হলো ৩৫.৯, যা বৈশ্বিক গড় পয়েন্ট ৪৬.৭ এর চেয়ে অনেক কম।

বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশ সবচে খারাপ অবস্থা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম।

এছাড়া গবেষণা ও উদ্ভাবনেও পিছিয়ে রয়েছে এদেশ, যেখানে ৯৬ তম অবস্থান বাংলাদেশের।

দক্ষিণ এশিয়ায় সবার শেষে রয়েছে বাংলাদেশ।

সূচকটি তৈরি করতে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনসহ সাতটি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

তালিকায় বাংলাদেশের চাইতে ভাল করেছে ভারত, ভুটান, নেপাল। এমনকি পাকিস্তানও বাংলাদেশের চাইতে এগিয়ে আছে।

এটি দেশের শিক্ষা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের দৈন্যদশাই নির্দেশ করে। কিন্তু কেন এই অধঃপতন? কেন জ্ঞানের সবগুলো খাত মিলে বৈশ্বিক তালিকার তলানিতে বাংলাদেশ?

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামগ্রিকভাবে আমাদের যে অবস্থান তাতে এটি হওয়ারই ছিল। বিশেষ করে আমাদের শিক্ষাখাতে মান উন্নয়নের জন্য যে বিনিয়োগ সেটি বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জ্ঞান সূচকে আমাদের অবস্থান সবার নিচে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড কমিউনিকেশনের প্রধান নির্বাহী মো. শামসুল ইসলাম বলেন, ‘এটা আমার কাছে অভাবনীয় কিছু মনে হয়নি। জ্ঞানে উন্নত হওয়ার জন্য একটা জাতির জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থাকতে হবে। জ্ঞানীকে সম্মান করতে হবে। কিন্তু আমাদের সেটি নেই।

ফেসবুকে বিদেশি অনেক একাডেমিক গ্রুপে, রাইটারস গ্রুপে আমি সদস্য। তাদের জ্ঞানের প্রতি প্যাসন, যুক্তিতর্ক আমাকে অবাক করে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানচর্চায় জীবন্ত। কিন্তু আমাদের দেশে জ্ঞানচর্চার সুযোগ নাই।’

সামাজিক বিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের দেশে ফেসবুকে একাডেমিক গ্রুপ নেই, থাকলেও লেখালেখি নেই। সুস্থ বিতর্ক নাই। আমি একটা একাডেমিক গ্রুপ খুললাম, কেউ লেখালেখি করে না দেখে বন্ধ করে দিয়েছি। মিডিয়ায় বা ফেসবুকে সবার সামনে আইডিয়া শেয়ার করা যায় না।

সেই সহিষ্ণুতা, সেই জ্ঞান আমাদের নেই। অকথ্য গালিগালাজ শুনতে হয়। জীবনের নিরাপত্তা হয় বিঘ্নিত।’

জ্ঞান সূচকে কেন এতটা পিছিয়ে বাংলাদেশ – এমন এক প্রশ্নে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জ্ঞানের যে অনুশীলন তার মূল্য পৃথিবীজুড়েই কমে গেছে। এখন আসছে তথ্যের যুগ। তথ্য আর জ্ঞানতো এক না।

তিনি বলেন, তথ্যের অবাধ প্র্রবাহ জ্ঞানের চর্চাকে খর্ব করছে পৃথিবী জুড়েই। জ্ঞান এখন পুরো পৃথিবীতে পণ্যে পরিণত হয়েছে, কেনা যায়। নিজের অনুশীলন বা গবেষণা দরকার হয় না। এটা কেনা যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরো খারাপ।

“আমরা দেখছি যে জ্ঞানের মূল্য এখন সমাজে নেই, রাষ্ট্রে নেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে জ্ঞানের চর্চা থাকবে সেখানেও আমরা জ্ঞানের মূল্যটা আমরা দিতে পারছি না। প্রতিষ্ঠানের যিনি প্রধান হন, তিনি জ্ঞানানুশীলনের জন্য সেই জায়গায় যান না।

তার যোগ্যতাটা হচ্ছে তিনি দলের সাথে আছেন, রাজনৈতিক আণুকূল্য পাচ্ছেন, তদবীর করছেন …কাজেই তিনি কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন না, অনুপ্রাণিত করতে পারেন না। আবার যারা শিক্ষকতা পেশায় আছেন, এখানে উন্নতি নির্ভর করছে ওই দলীয় আনুগত্যের ওপর। এবং সেজন্য গবেষণাও কমছে, প্রকাশনাও হচ্ছে না।”

দেশে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করছেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী।

তিনি বলছিলেন, ‘এটা তো অপ্রত্যাশিত নয়। গলদটা প্রাথমিক থেকেই শুরু। স্বাধীনতার পরে আমরা শুরু করেছিলাম ভালই। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট যেটা, সেটাতে খুব ভাল কিছু প্রস্তাবনা ছিল। উদ্যোগটা ভাল ছিল।

তখন যদি এটা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারতাম। তখন কিন্তু এতো বিভাজন ছিল না। মূল ধারা যেটাকে আমরা বলি, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আশি ভাগ শিক্ষার্থী পড়ে। এখানে একদিকে ব্যবস্থাপনায় নানা ধরনের ত্রুটি। আরেক দিকে বিনিয়োগ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানসম্মত শিক্ষার জন্য মানসম্মত শিক্ষক দরকার। কিন্তু এত বছরেও সেটা আমরা তৈরি করতে পারিনি। আমরা বিনিয়োগ করেছি, কিন্তু মানসম্মত জায়গায় বিনিয়োগ করতে পারিনি। আমাদের দেশে বৈষম্যটা ব্যপক হয়েছে।

শহর আর গ্রামে বিস্তর ফারাক। গ্রামে দেখবেন বিজ্ঞান পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু সেখানে ল্যাবরেটরি নেই, লাইব্রেরি নেই, এমনকি বিজ্ঞান পড়ানোর শিক্ষকও নেই। বাংলার শিক্ষক, ধর্মের শিক্ষক বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন।’

“উচ্চমান অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি বা শিক্ষকদের গবেষণা, শিক্ষার্থীদের গবেষণাগার, পাঠাগার এগুলো কিন্তু উন্নতমানের থাকতে হয়। এখানেও কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি”।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার পেছনে রাষ্ট্র ও সমাজে জ্ঞানীদের মূল্যায়ন না থাকার পাশাপাশি জ্ঞান চর্চার অনেক মৌলিক সমস্যারও সমাধান হয়নি।

শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জ্ঞানচর্চার পরিবেশও বাংলাদেশে স্বাধীন নয়। “জ্ঞানের যে অনুশীলন সেটার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের চর্চা না করলে সেই চর্চা গভীর হয় না, স্থায়ী হয় না, প্রভাবশালী হয় না। সেটা আমরা করতে পারি নাই।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা অনুবাদ করতে পারিনি পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের বই। আমরা নিজেদের ভাষায় পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানকে নিয়ে এসে সেই গ্রন্থ রচনা করতে পারিনি। আমরা সেটা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি।

কাজেই জ্ঞান কিন্তু একজন দু’জনের ওপর নির্ভর করে না। জ্ঞান নির্ভর করে গোটা সমাজের ওপর। সমাজের যে কাঠামো আছে সেই কাঠামোর ওপর”।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক বলেন, “আরেকটা জিনিস আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে সেটা হলো যে জবাবদিহিতা নেই। রাষ্ট্র থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের অধীনে যত প্রতিষ্ঠান আছে সমাজে যত প্রতিষ্ঠান আছে, কোথাও এখন জবাবদিহিতা নেই।

জবাবদিহিতা না থাকলে তো কোনো বিকাশ হয় না। প্রশ্ন করতে হবে, জিজ্ঞাসা করতে হবে, জবাব দিতে হবে এবং প্রশ্ন করার অধিকার দিতে হবে। সেইগুলো তো আমরা দিতে পারছি না”।

বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক তৈরিতে প্রাক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়ন, উদ্ধাবনের মতো সাতটি সেক্টরে ১৯৯টি ইন্ডিকেটর বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থায় কতগুলো সমস্যা সামনে আনেন।

তিনি বলেন, “আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশকিছু গলদ আছে। ব্যবস্থাপনা আমাদের ভীষণ রকম কেন্দ্রায়িত। সবকিছু সেন্ট্রালাইজড। স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা শিক্ষাব্যবস্থার কোন খাতের মধ্যেই নেই।

দ্বিতীয়ত, এতবড় শিক্ষাব্যবস্থায় যে দক্ষ শিক্ষকের প্রয়োজন, সেই দক্ষ শিক্ষকমণ্ডলীর অভাব আছে। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার অভাব আছে।”

রাশেদা কে চৌধুরীর মতে, সারা বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রের মধ্যে নানা ধরনের বৈষম্য বিরাজমান।

শিক্ষাব্যবস্থায় বহু ধারা উপধারা, মোটাদাগে তিনধারা – মূলধারা, ইংরেজি মাধ্যম এবং ধর্মীয় ধারা এই তিনটির মধ্যে বৈষম্য আছে, বিনিয়োগে বৈষম্য দক্ষতার ক্ষেত্রে বৈষম্য।

“সবকিছু মিলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আসলে তেমনভাবে এগোতে পারছে না গুণগত মানের দিক থেকে”।

বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে তালিকাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কাছাকাছি সময়ে স্বাধীন কোরিয়া এবং ভিয়েতনামে রয়েছে দীর্ঘ যুদ্ধের ইতিহাস। এসব দেশের অগ্রগতির পেছনেও একটা বড় কারণ হলো শিক্ষা এবং গবেষণায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ।

বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ এখনো কাঙ্খিত নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “ইতিমধ্যে আমাদের যে সকল দেশ আমাদের প্রায় সমান সমান ছিল, যেমন ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, এসব দেশের শিক্ষার্থীরা কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতো এক সময়। এখন আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পড়তে যায় সেসব দেশে।

“কেনিয়ার মতো দেশ মোট বাজেটের ৪৫ শতাংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করে। এই প্রাধিকারের জায়গাটা আমাদের এখন পর্যন্ত আমরা ঠিক করতে পারিনি।”

রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যা করছি তার ফল আমরা এখন পাচ্ছি। এর সঙ্গে আরেক বড় সমস্যা হলো আমরা জ্ঞান নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে পরীক্ষা নির্ভর ব্যবস্থায় চলে গিয়েছি। সবাই শুধু কোন রকমে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে চায়।

আরেকটা বড় সমস্যা হলো আমাদের শিক্ষা বা জ্ঞানে গবেষণা বলে কিছু নেই। কৃষিতে দেখেন আমরা কত এগিয়ে গিয়েছি? এটা সম্ভব হয়েছে গবেষণার কারণেই। কিন্তু শিক্ষায় সেটা নেই।’

তবে সাংবাদিক ও লেখক শাখাওয়াত টিপু মনে করেন, জ্ঞানের মান কমে যাওয়ার পিছনে শুধুমাত্র শিক্ষা ব্যবস্থার দোষ নেই। সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজে যে অধঃপতন হচ্ছে, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ।

তিনি বলেন, ‘একটি দেশের বা সমাজের দুটি সম্পদ থাকে। একটি মানব সম্পদ আরেকটি মানস সম্পদ। একটা সমাজ তখনই উন্নত হবেক যখন সেই সমাজে মানসিক বিকাশের সবগুলো উপাদান যথাযথভাবে থাকবে।

জ্ঞানের এই অবস্থার পিছনে আমাদের রাজনৈতিক ও সামগ্রিক শাসন কাঠামোর যোগসূত্র রয়েছে। শুধু তিন বেলা খেতে পারলেই তো মানুষ হয় না। আরও অনেক কিছু লাগে। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে বৈশ্বিক জ্ঞান ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই রিপোর্ট যে পুরোপুরি সঠিক সেটাও বলা যাবে না। এই ইনডেক্স তৈরি করার জন্য যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে সেটা একটা কমিউনিকেশনের মধ্য দিয়ে হয়েছে। আমাদের দেশ থেকে সে সময়ে কিছু সমস্যা হয়ে থাকতে পারে।

আমাদের দেশে ভাল শিক্ষক, ছাত্র আছে। কিন্তু যখন একটা সমাজে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অবনমন ঘটে তখন তার প্রভাব জ্ঞানের উপর গিয়ে পড়ে। আমরা যদি সমাজের দিকে তাকাই তাহলে দেখব দেখার মতো কোন চেহারা নেই। আমাদের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিমান গত সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু গুণগত সংখ্যা বাড়ছে না।’

চলতি বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক তালিকায় প্রথম এক হাজারের মধ্যে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। আবার এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ব্যয় করে।

এ বিষয়টি উল্লেখ করে ঢা্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান বলেন, ‘এই যখন অবস্থা তখন হঠাৎ করে নলেজ ইনডেক্সে তো আপনি ভাল করার আশা করতে পারেন না। সামগ্রিকভাবে যা হওয়ার কথা তাই হয়েছে। ৩০ বছর আগে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মানের শিক্ষক ছিল এখন তা নেই। মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় না। এ কারণে তাদের ব্যক্তিত্ব থাকে না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা প্রাথমিকের।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রাথমিকের শিক্ষকদের কীভাবে ব্যবহার করা হয় দেখুন। কোন উপায় না পেয়ে মানুষ প্রাথমিকের শিক্ষক হয়। বিদ্যালয়ে ভবন নেই, কোন সুবিধা নেই। পড়ার কোন পরিবেশই নেই। গবেষণা বলছে, আমাদের দেশের অর্ধেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক শেষ করার পরেও ঠিকভাবে বাংলাই পড়তে পারে না। এই অবস্থায় নলেজ ইনডেক্স কীভাবে ভাল হবে?’

গ্লোবাল নলেজ ইন্ডেক্স
গ্লোবাল নলেজ ইন্ডেক্স

ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন বলেন,

“জ্ঞান তৈরী হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে, গবেষণার মাধ্যমে। আর আমাদের দেশে রিসার্চকে মূল্যায়ন করা হয় না সিস্টেমগত কারনেই। যারা প্রথা ভেংগে কিছু করার চেষ্টা করেন তাদেরকে সাপোর্টের পরিবর্তে পদে পদে হেরেজমেন্টের স্বীকার হতে হয়।

তাই এমন অবস্থা অতি স্বাভাবিক। খুশী হওয়া উচিত আমরা লাস্ট পজিশন পায়নি (১৩৮)। দেশে পিএইচডির সংখ্যা নেপাল, ভুটানসহ অনেক কান্ট্রির চেয়ে বেশী, কিন্তু এরপরও তেমন কোন আউটপুট নেই।

এই ধরণের রিপোর্ট বের হলে কিছু সিনিয়র ইন্টেলেকচুয়াল মন্তব্য করবেন, দোষারোপ করে থাকেন। বড় বড় পজিশনের বড় কর্মকর্তা মিডিয়াতে ভারী ভারী নীতি-নৈতিকতার বানী দিবেন। যারা নেতৃত্বে আছেন তাদের রিসার্চে ট্রেক রেকর্ড কেমন? তার নিজেরাই যে এই অবস্থা তৈরী করেছেন তা ভুলে যান।

এ থেকে উত্তরণের কোন উপায় আছে?

বিশ্বব্যাপী তুলনামূলক কম বয়সী লিডার/রাস্ট্রপ্রধান হিসেবে সফল। কানাডা, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড আরো অনেক দেশে ৩০-৪০ এর কোঠায় সফলভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেগবান করতে হলে ৪৫-৫০ বছর বয়সী রিসার্চে ডাইনামিক প্রফেসরদের ভিসি লেভেলে আনতে হবে। এই বয়সের লোকদের নিজেদের প্রমান করার ব্যাপার থাকে কেরিয়ারের স্বার্থেই।”

তিনি আরো বলেন-
“বেশীরভাগ পাবলিক/প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র পজিশনে আছেন অবসর প্রাপ্ত এবং অবসরে যাবেন এমন মানুষ। যারা মূলত চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পান। সম্ভবত জীবনের শেষ ইচ্ছা থাকে একটি বড় পজিশনের ট্যাগ লাগিয়ে অবসরে যাওয়া। ”

বাংলাদেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, প্রাথমিকে ভর্তির মতো সংখ্যাগত দিক থেকে সাফল্য অর্জিত হলেও শিক্ষার মানের ঘাটতি উঠে আসছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষণায়।

বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার যে চিত্র, সেটি শিক্ষা ব্যবস্থার সংকটের আরেকটি দৃষ্টান্ত বলেই মনে করেন সবাই।