গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার ইতিবাচক দিক

শিক্ষার্থী

দেশের ৩৪টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথমবর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতিতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। জানা গেছে, উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্যসূচির ওপর ভিত্তি করে এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হবে।

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার কেন্দ্র থাকবে। গুচ্ছ পদ্ধতিতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সঙ্গে ১ ডিসেম্বর ইউজিসির এক মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় মূলত একই প্রশ্নপত্রে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা বিভিন্ন কেন্দ্রে নেয়া হয়ে থাকে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তিনটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে বড় চার বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ সমন্বিত ভর্তিতে আসবে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছে। তারা পৃথকভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেবে। এজন্য ১ ডিসেম্বরের বৈঠকে এ চার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের ডাকা হয়নি।

তবে ইউজিসি আশা প্রকাশ করছে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নেতৃত্বে এ বছর থেকেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আগে থেকেই জিপিএ’র ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেছেন, করোনার কারণে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা থেকে পিছু হটার সুযোগ নেই। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কথা চিন্তা করে সরাসরি ও সহজ উপায়ে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে তিনি ভিসিদের আহ্বান জানান।

সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ শর্ত ও চাহিদা উল্লেখ করে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করবে। ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্ত স্কোরের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ শর্ত ও চাহিদা মোতাবেক শিক্ষার্থী ভর্তি করবে।

এজন্য আলাদা করে কোনো ধরনের ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে না। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল ব্যাংক থেকে স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার বিধিবদ্ধ নিয়মানুসারে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সম্মিলিত ইউনিটগুলোতে বিভাগ পরিবর্তনের সুযোগ থাকবে।

প্রতিটি গুচ্ছে একটি করে পরীক্ষা নেয়া হলেও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তিনটি (সায়েন্স, আর্টস এবং কমার্স) ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কমিটির প্রধান কাজ হবে লিখিত ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করা।

উল্লেখ্য, কৃষিবিষয়ক সাত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে গত বছর স্নাতক শ্রেণিতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্য বহুদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি মৌসুমে ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া লাখো শিক্ষার্থীর হয়রানির প্রসঙ্গ বিশেষ আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এবার করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এটি আরও মারাত্মক চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

এ সময়টা কাটে ছাত্রছাত্রীদের টেনশনে। কোথাও ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের মধ্যে এ দুশ্চিন্তা কাজ করে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেয়া, সেখানে থাকার চিন্তা, সব মিলিয়ে বেশ বড় ধরনের সংগ্রাম করতে হয় এ সময়।

একজন শিক্ষার্থী যে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র একটি বিষয়ে ভর্তি হয়। অথচ তাকে এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দেশময় ঘুরে বেড়াতে হয় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতে অর্থ ও সময় তো নষ্ট হয়ই, উদ্বিগ্ন মনে ছোটাছুটির কষ্ট করতে হয় তার চেয়েও বেশি।

প্রতিবছর যে হারে পাসকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সে হারে আসন সংখ্যা বাড়ছে না। তার ওপর আবার রয়েছে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়, পছন্দের বিষয় নির্বাচন। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি হয়। উচ্চশিক্ষার জন্য তাই তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় তাদের।

কিন্তু এ তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে গিয়ে তাদের নানা বিড়ম্বনার মুখোমুখিও হতে হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় যে সমাধানটি গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আলোচনায় এসেছে তা হল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা।

বর্তমানে শুধু মেডিকেল কলেজগুলোতে এবং কৃষিবিষয়ক সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। অনেক আগে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির অধীনে কুয়েট, চুয়েট ও রুয়েটে (সে সময় যথাক্রমে বিআইটি খুলনা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী নামে এগুলো পরিচিত ছিল) একযোগে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মত থাকলেও আমাদের বিরাট এ কর্মযজ্ঞ যে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হয়, তাদের স্বার্থকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিতে হবে।

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমান মহামারী করোনাভাইরাসের মধ্যে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পদ্ধতি চালু করা দরকার। একদিকে মহামারী করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যে দীর্ঘ পথের ক্লান্তি, পাশাপাশি যানজট সমস্যা থেকে শিক্ষার্থীর মুক্তি দেয়া প্রয়োজন।

বৈশ্বিক মহামারীর এ কঠিন সময়ে অপরিচিত স্থানে ভ্রমণ- আবাসনের অনিশ্চয়তা, যাত্রাকালে যানবাহনে সমস্যা ইত্যাদিসহ দুশ্চিন্তা থেকে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের মুক্তি দিতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া বিকল্প কোনো পদ্ধতির কথা কেউ বিবেচনা করতে পারছেন না।

তবে শুধু শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের দুশ্চিন্তামুক্ত করার লক্ষ্যেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু, বৈজ্ঞানিক এবং স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করে একটি স্থায়ী গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি চালু করার স্বার্থে সমন্বিত ভর্তি ব্যবস্থাকে অবশ্যই চালু করতে হবে। কারণ এর কোনো বিকল্প নেই।

ফলে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবক, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই উপকৃত হবে। প্রচলিত ধারণা এটাই যে, কোচিং ছাড়া কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় না। তাই সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে নামিদামি কোচিংয়ে যুক্ত হতে অনেক অভিভাবকের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।

কিন্তু যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল নন, তাদের ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল কোচিংয়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয় না। আলোচ্য পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা চালু হলে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে যুক্ত হওয়ার কথা আর ভাবতে হবে না। মেধা অনুযায়ী তারা কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে। সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা চালুর মধ্য দিয়ে কোচিং সেন্টারগুলোর বাণিজ্য বন্ধ করা সম্ভব।

লক্ষ করা যায়, ভর্তি কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার পর শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম তোলার পালা। আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে আলাদা আলাদা ফরম তুলতে হয়। ফরম কেনার সাধ্যও অনেক পরিবারের থাকে না। সেখানেও গরিব মেধাবীরা পিছিয়ে পড়ে।

একজন সামর্থ্যবান শিক্ষার্থী প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফরম তুলে ফেলে; তাতে তার হাজার হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। দেখা যায়, এইচএসসি পরীক্ষার পর থেকে শুরু করে কেবল ফরম তোলা পর্যন্তই মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করতে হয়। এ সামর্থ্য অনেকের থাকে না। দেশের একেক প্রান্তে এক একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবস্থিত।

দেখা যায়, আজ ঢাকায় তো আগামীকাল সিলেট, পরশু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা। ফলে ঢাকার পরীক্ষা শেষ করে ছুটতে হয় গাড়ি ধরতে। এতে বিশ্রাম নেয়ার সময়টুকুও থাকে না। তার পরদিন হয়তো পরীক্ষা থাকে দেশের অন্য কোনো প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এভাবে ছুটতে গিয়ে যাদের গাড়ি যানজটে আটকে যায়, তাদের জন্য কারও করার কিছু থাকে না। অথচ তাদের বিন্দুমাত্র দোষ নেই। মহামারীর এ আতঙ্কের সময়ে এ বিষয়টি সবচেয়ে আতঙ্কের ও দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে। এ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ দেশের বড় বড় শিক্ষাবিদ এ পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে আশা প্রকাশ করেছেন। তারা প্রচুর লিখেছেন এবং দেখিয়েছেন কেন এ পদ্ধতির প্রয়োগ আমাদের সন্তানদের জন্য প্রয়োজন। অনেকেই চাইছেন এর বাস্তবায়ন হোক; কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

যে কোনো পদ্ধতি চালু করতে সমস্যা সৃষ্টি হতেই পারে। সেক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা যদি সমন্বিতভাবে নেয়া সম্ভব হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ পদ্ধতির প্রয়োগ সম্ভব হবে না কেন?

যদি দেশের সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় রাজি হতো, তাহলে একজন পরীক্ষার্থী সিলেট বা যশোর যে কোনো একটি স্থান থেকেই দেশের সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারত। এমন কল্যাণকর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এত দেরি হচ্ছে কেন?

বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের ওপর রয়েছে মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধুবান্ধবের চাপ। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা একধরনের দিশেহারা অবস্থায় পড়ে যায়। শিক্ষা বিষয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ধরনের ব্যবস্থা আছে-ভর্তির আগে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এসব তথ্য বিস্তারিত জানতে চান।

তারা যাতে সহজে এসব তথ্য জানাতে পারেন, এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওয়েবসাইটে পর্যাপ্ত তথ্য নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বর্তমান মহামারীর মধ্যে সংশ্লিষ্ট সবার স্বার্থে গুচ্ছ পদ্ধতির সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

লেখকঃ সৈয়দ ফারুক হোসেন : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়