করোনা আক্রান্ত ছিলেন আলী জাকের

আলী জাকের

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রবীণ অভিনেতা নাট্যজন আলী যাকের আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে ভোর ছয়টা দিকে আলী যাকেরের মৃত্যু হয়।

ইউনাইটেড হাসপাতালের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, আলী যাকের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। একইসাথে তিনি কোভিড১৯ পজিটিভ ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অনুষ্ঠান সমন্বয়ক রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গার্ড অফ অনার দেওয়া হবে একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম এই ব্যক্তিত্বকে৷

দুপুরে আলী যাকেরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে বনানী কবরস্থানে। সেখানে কবরস্থান মসজিদে জানাজার পর তাঁকে দাফন করা হবে৷

বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে এক সপ্তাহ চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলে গত রোববার বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন আলী যাকের৷ অবস্থার অবনতি হলে বৃহস্পতিবার তাঁকে ফের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ শুক্রবার ভোরে সেখানেই মারা যান তিনি৷

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ তথ্যটি নিশ্চিত করে বলেন, ‘যাকের ভাই গত কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

শুক্রবার ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।’

তিনি বলেন, ‘ উনাকে বিদায়ের জন্য সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট থেকে কোনও আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ আর পাচ্ছি না। কারণ, উনি কোভিড পজিটিভ ছিলেন।

গত চার বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন গুণী এই শিল্পী। সম্প্রতি তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে গত ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার সিসিইউতে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন।

তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

১৯৭২ সালে মঞ্চনাটকে আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে আলী যাকের নাট্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন।

টেলিভিশন নাটক এবং মঞ্চনাটকে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন আলী যাকের। ১৯৮০ এবং ৯০’র দশকে আলী যাকের অভিনীত বেশ কিছু নাটক দর্শকদের মনে স্থান করে নিয়েছিল।

বেশ কয়েক বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন আলী যাকের। সেই চিকিৎসার অংশ হিসেবে নিয়মিত থেরাপি চলছিল তাঁর। গত সপ্তাহে শারীরিক সমস্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় জরুরি ভিত্তিতে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে সিসিইউতে নেওয়া হয়।

পরে কিছুটা সুস্থ হলে গত শনিবার বাসায় নেওয়া হয়। রোববার আবার ভর্তি করানো হয়। সোমবার কোভিড-১৯ টেস্ট করানো হয়। ফলাফল হাতে পেলে জানা যায়, তিনি কোভিড-১৯ পজিটিভ।

১৯৪৪ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এ নাট্য ব্যক্তিত্ব। আলী যাকের ছিলেন চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। তাঁর বাবা মোহাম্মদ তাহের ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা।

বাবার চাকরির বদলি সূত্রে অল্প বয়সে কুষ্টিয়া ও মাদারীপুরে কাটান আলী যাকের।

আলী যাকের ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। ওই বছরেরই জুন মাসে তিনি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দেন।

তখন থেকে নাগরিকই তাঁর ঠিকানা। ‘বাকি ইতিহাস’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা’, ‘কোপেনিকের ক্যাপটেন’, ‘গ্যালিলিও’, ‘ম্যাকবেথ’সহ অনেক আলোচিত মঞ্চনাটকের অভিনেতা ও নির্দেশক তিনি।

পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেও তিনি পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি’, ‘পাথর’, ‘দেয়াল’সহ বহু নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন আলী যাকের।

বেতারে ৫০টির বেশি নাটক করেছেন তিনি। অভিনয় করেছেন বেশ কিছু চলচ্চিত্রে।

টেলিভিশনের জন্য মৌলিক নাটক লিখেছেন। নানা বিষয়ে দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও করেছেন দীর্ঘদিন। প্রকাশিত হয়েছে বই—‘সেই অরুণোদয় থেকে’, ‘নির্মল জ্যোতির জয়’। শখ করে ফটোগ্রাফিও করেন তিনি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসংগ্রামী ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে আরণ্যক নাট্যদলে যোগ দেন।

বিশ্বখ্যাত মঞ্চনাটক রূপান্তর করেছেন। মঞ্চের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।

বেশ কিছু চলচ্চিত্রেও করেছেন অভিনয়। টেলিভিশনের জন্য মৌলিক নাটক লিখেছেন। সমসাময়িক বিষয়ে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখিও করেন।

বের হয়েছে বই, যার মধ্যে আছে সেই অরুণোদয় থেকে, নির্মল জ্যোতির জয়সহ বই। একজন শৌখিন ফটোগ্রাফারও তিনি।

বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি গ্রুপের চেয়ারম্যান তিনি। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি।

যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির পূর্ণ সদস্য। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা।

মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০১৮-তে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন অভিনেতা আলী যাকের। স্ত্রী স্বনামধন্য অভিনয়শিল্পী সারা যাকের, ছেলে অভিনেতা ইরেশ যাকের, ছেলের বউ মিম রশিদ, নাতনি নেহা ও মেয়ে শ্রিয়া সর্বজয়াকে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। সব ছেড়ে আজ সকালে তিনি পাড়ি দেন না–ফেরার দেশে।

প্রধানমন্ত্রীর শোক

একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক আলী যাকেরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এক শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলী যাকেরের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আলী যাকেরের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী। আলী যাকেরের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান তিনি।