ব্যবস্থাপক যাহা করেন তাহাই ব্যবস্থাপনা -৫/২

ড. মীজানুর রহমান

“সঠিক কাজটি সঠিকভাবে করা”- (দ্বিতীয় কিস্তি)

(… প্রথম কিস্তির পর) 7-S ফ্রেমওয়ার্কের দ্বিতীয় ‘S’ টি হচ্ছে Strategy বা কৌশল । যুদ্ধ, রাজনীতি, ব্যবসায় বা খেলার পরিকল্পনার বিস্তারিত পন্থাকেই কৌশল বলে । কৌশল হচ্ছে উদ্দেশ্য অর্জনের উপায় (strategy is the way of gaining objectives) ।

প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই একটি যুদ্ধক্ষেত্র , জয়ের জন্য চাই কৌশল । বিশ্বাস, সাহস, মনোবল, দেশপ্রেম, শক্তি ইত্যাদি যুদ্ধ জয়ের জন্য আজও প্রাসঙ্গিক; কিন্তু ঘোড়া বা উটের পিঠে চড়ে তলোয়ারের যুদ্ধের আমলে এগুলো যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল আধুনিককালের যুদ্ধে ‘কৌশল’ এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে ।

অবশ্য আদিকালের চীনা সমরবিদ সান জু (Sun Tzu) যুদ্ধ জয়ের জন্য কৌশলের উপরেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন । খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে সান জু রচিত ” সুন্চি বিংফা” (The Art of War) কে রণকৌশলের উপর লেখা শ্রেষ্ঠ বই মনে করা হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর পরেও বইটি প্রাসঙ্গিক ।

কৌশলের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আগামী দিনে কিভাবে জয়ী হওয়া যাবে তা স্থির করা (‘determining how we going to win in the period ahead’) । কৌশল বিশেষজ্ঞ মাইকেল পোর্টার (Michael Porter) এর মতে একই বাজারে একই কৌশল অবলম্বনকারীদের নিয়ে ‘strategic group’ গঠিত হয় ।

কোন একটি কৌশল যে প্রতিষ্ঠান প্রথম প্রয়োগ করে তাঁরাই বেশি মুনাফা করে । যেসকল প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট কৌশল থাকে না এবং এ নিয়ে অস্থিরতায় ভুগতে ভুগতে প্রায় সকল কৌশল গ্রহণ করতে দৌড়ঝাঁপ করে তাঁরা সুবিধা করতে পারে না ।

অনেক প্রতিষ্ঠানই মনে করে সবাই যে কাজটি করছে সেই কাজটি যদি তাঁরা আরো কার্যকরভাবে করতে পারে তাহলেই প্রতিযোগিতায় জয়ী হবে । প্রচলিত কাজটি করার নৈপুণ্য বা দক্ষতা তাঁদের এগিয়ে রাখবে ।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রতিযোগীরা সহজেই তাঁর নৈপুণ্য বা দক্ষতা নকল করবে এবং তাঁর নৈপুণ্যকে বেঞ্চমার্ক ধরে একই জায়গায় পৌঁছে যাবে, এবং তা অতিক্রম করবে । এতে এগিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানটির কার্যকর দক্ষতার প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকবে।

মাইকেল পোর্টার এর মতে কৌশল হচ্ছে, “the creation of a unique and valuable position involving a different set of activities” । অর্থাৎ অন্যদের চেয়ে ভিন্ন কিছু করে একটি স্বাতন্ত্র্য ও মূল্যবান অবস্থান তৈরি করা ।

একটি কোম্পানি তখনই বলতে পারে তাঁদের কৌশল আছে, যদি তাঁরা প্রতিযোগিরা যা করে তার বাইরে কিছু করছে, অথবা প্রতিযোগিরা যেভাবে যে কাজগুলো করছে তাঁরা সেগুলো ভিন্নভাবে করছে (performs different activities from rivals or performs similar activities in different ways) ।

কৌশল নিয়ে চিন্তা করার প্রারম্ভিক সূচনা বিন্দু হিসাবে মাইকেল পোর্টার তিনটি আদি কৌশলের(generic strategies) প্রস্তাব করেছেন-

(১) সর্বনিম্ন খরচে ব্যবসায় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা (overall cost leadership) : উৎপাদন, ক্রয়, বিতরণ, ও অন্যান্য খরচ কমিয়ে ক্রেতাকে মূল্য এবং অন্যান্য সুবিধা দেয়া গেলে সহজেই অধিক মার্কেট শেয়ার দখলে নেয়া যায় । চাহিদার সার্বজনীন তত্ত্ব অনুযায়ী, কিছু ব্যতিক্রম বাদে অন্যান্য শর্ত ঠিক রেখে, যে কম দামে পণ্য দিতে পারবে তাঁর পণ্যই বেশি বিক্রি হবে ।

প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অনেক সময়ই মূল্যের উপর কোন কোম্পানির একক নিয়ন্ত্রণ থাকেনা । বাজার মূল্যে কোম্পানিকে পণ্য বিক্রি করতে হয় । বাজার মূল্যে সবাই পণ্য বিক্রি করলে প্রতিযোগীদের মধ্যে সেই লাভবান হবে যার উৎপাদন ও বন্টন খরচ কম ।

পণ্যের দামের সাথে মানের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান এ পথে যেতে চান না । তাহলে খরচ হ্রাস পেলে দাম না কমিয়েও ভ্যালু বৃদ্ধির জন্য বাজারজাতকরণের অন্যান্য উপাদানে, যেমন- উন্নত বিতরণ ও কার্যকরী প্রমোশনে, উৎপাদন খরচের সাশ্রয়ী অর্থ ব্যয় করে বাজার দখলে নেয়া যেতে পারে ।

পোর্টারের এই কৌশলটি Harvard বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে । আসলে এটা অনেক পুরনো একটা ভারতীয় প্রবচন, যা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও আছে, “বেচার সময় লাভ করা যায় না, লাভ করতে হয় কেনার সময়” ।

আজকাল মাছ বাজারেও সকল মাছ বিক্রেতা একই দামে মাছ বিক্রি করে । তবে এদের মধ্যে সেই সবচেয়ে লাভবান হয় যে আরিচা ঘাটে মাছ কেনার সময় কম দামে কিনে, বেশি পরিমাণে কিনে, নিজস্ব পরিবহনে ঢাকায় এনে নিজেই মাছ বিক্রি করে, অথবা সারারাত মাছ ধরে (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) ।

কম খরচে উৎপাদন ও ব্যবসায় করার জন্য উদ্ভাবনের কোন বিকল্প নেই । কাঁচামাল ও জ্বালানি সংকটের এই দিনে কোম্পানিকে সাশ্রয়ী বিকল্প কাঁচামাল এবং বিকল্প সূত্র থেকে শক্তির যোগান নিতে হবে । কম খরচে বেশি উৎপাদনের গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে । কৃষি, শিল্প এবং ব্যবসায় সবক্ষেত্রেই খরচ কমানোর জন্য উদ্ভাবনী চিন্তা করতে হবে ।

(২)পৃথকীকরণ(differentiation): ভিন্নতা হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের অন্যতম আবশ্যকীয় উপাদান, ভিন্নতা আপনাকে আনতেই হবে । প্রতিযোগিতামূলক দুনিয়ায় ভিন্নতা না থাকলে আপনি কারো নজর কাড়তে পারবেন না । প্রত্যক্ষণ তত্ত্ব অনুযায়ী ভিন্নতাই মানুষের মনোযোগের প্রথম কেন্দ্রবিন্দু ।

রাস্তা দিয়ে অনেকগুলো রাজহাঁস হেঁটে যাচ্ছে ওই দলে একটা পাতি হাঁসের বাচ্চা থাকলে সবার আগে আপনার দৃষ্টি সেদিকেই যাবে । হিন্দি সিনেমায় অনেক সুন্দরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় নায়িকাকে ভিন্ন পোশাক পরিয়ে অন্যদের থেকে আলাদা করা হয় । কখনো কখনো সহনায়িকারা মূল নায়িকার চেয়ে সুন্দরী হতে পারে ।

৫০ বা ১০০ বান্ধবীসহ নায়িকা সমুদ্রসৈকতে ঢেউয়ের তালে তালে নাচছে, এরমধ্যে নায়িকা কোন্ টা ? দেখবেন, পরিচালক অন্য সকলকে হাফপ্যান্ট পরালেও নায়িকাকে ফুলপ্যান্ট পরিয়েছে । তাঁর কাপড়ের রংও অন্যদের চেয়ে ভিন্ন । বাজারে অবস্থান(position) অর্থাৎ ক্রেতর মনে স্থান পেতে এই ভিন্নতা কাজে আসে ।

আজকাল ব্র্যান্ডিং নিয়ে যত তৎপরতা তার প্রারম্ভিক বিন্দু হচ্ছে পৃথকীকরণের মাধ্যমে ক্রেতার মনে অবস্থান গ্রহণ । (বাজারে অবস্থান গ্রহণ বা positioning নিয়ে আমার ‘সংকটে মার্কেটিং’ পুস্তকে বিস্তারিত উপস্থাপনা আছে । আগ্রহী পাঠক ওই পুস্তকটির দশম অধ্যায়টি পড়লেই পুরো বিষয়টা অনুধাবন করতে পারবেন, বইটি ‘রকমারী’তে পাওয়া যায়) ।

(৩) ফোকাস(Focus): কোন কোম্পানির পক্ষে সকলকে সন্তুষ্টি করা অসম্ভব । এমনকি সব কোম্পানির চেষ্টার পরও সকল ক্রেতাকে সন্তুষ্ট করা যাবেনা । কিছু অসন্তুষ্ট ক্রেতা থেকেই যাবে, তাঁদের সন্তুষ্টির জন্য ‘nichemanship’ লাগবে । কোন কোম্পানিরই সকল ক্রেতাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা উচিত নয় ।

বাজারের এক বা একাধিক সুনির্দিষ্ট অংশকেই তাঁকে টার্গেট করতে হবে । ঢাকা শহরে একটা মাইক ভাড়া করে সারাদিন একই কথা বলে, ” আমি তোমাদের ভালোবাসি, আমি তোমাদের ভালোবাসি…” মাইকিং করলেও একমাত্র শব্দ দূষণের দায়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকদের হাতে মামলা খাওয়া ছাড়া আর কোনো সাড়া পাওয়া যাবে না ।

যাকে ভালোবাসেন তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে মাইক তাক করে নাম ধরে বলতে হবে, ” …. (নাম), আমি তোমাকে ভালোবাসি” । তখনই ঋণাত্মক(বদমাশ) অথবা ধনাত্মক(পা গ ল ! ) যাই হোক না কেন একটা সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা আছে ।

(৩) জোট (Alliance): আজকাল ব্যবসায় সফলতার অন্যতম একটি কৌশল হচ্ছে কয়েকটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মিলে জোট গঠন করা (আমাদের দেশের তেল ব্যবসায়ীদের “সিন্ডিকেট” নয়) । অনেকটা নির্বাচনে জেতার জেটের মত । রাজনৈতিক জোট গঠন করে প্রতিপক্ষ দলকে ধরাশায়ী করতে দেখা যায় । দেশে দেশে, বিশেষ করে আমাদের এই অঞ্চলের রাজনীতিতে জোটের প্রভাব বেশি ।

পাকিস্তানে অতিসম্প্রতি জোটের রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতায় উত্থানপতন দেখেছি। জোট গঠনের সূত্রটি আমরা জ্যামিতি থেকে পাই, “ত্রিভুজের যেকোনো দুইটি বাহুর দৈর্ঘ্যের সমষ্টি তৃতীয় বাহু অপেক্ষা বৃহত্তর” (উপপাদ্য- ৪) । কৌশলগত অংশীদারিত্ব তৈরীর মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা লাভবান হচ্ছে ।

অন্যের সাথে অংশীদারিত্ব ছাড়া পৃথিবীর বৃহত্তম কোম্পানির পক্ষেও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব অর্জন সম্ভব নয় । এক কোম্পানির সম্পদ এবং যোগ্যতা অন্য কোম্পানি ব্যবহার করার পিছনে অন্যতম যুক্তি হচ্ছে, “যে কাজটা আমি ভালো পারি সেই কাজটা নিজেই করব, যে কাজটা অন্য কেউ আমার চেয়ে ভালো পারে বা সাশ্রয়ীভাবে করতে পারবে, তাঁকে দিয়ে সেই কাজটা করিয়ে নেব” ; এতে উভয়পক্ষের লাভবান হওযর সুযোগ থাকে ( Ricardian Theory of Competitive Advantage) ।

পুরো প্রক্রিয়াটা আজকাল আউটসোর্সিং এর অংশ । এছাড়া অনেক দেশেই বিদেশীরা ব্যবসায় করতে গেলে স্থানীয় একটি কোম্পানিকে নিয়ে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি করতে হয় । এমনকি কোন কোন দেশে স্থানীয় একটি কোম্পানি থেকে কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ ইত্যাদি কিনে ওই দেশ পণ্যটিকে আভ্যন্তরণীকরন (internalization) করে নিতে হয় ।

আমাদের দেশে যত বিদেশি ঠিকাদার কাজ করছে তাঁদের প্রত্যেকেরই স্থানীয় একজন অংশীদার আছে । স্থানীয় অংশীদার কোম্পানির লোকেরা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও আইনি পরিবেশে খাপ খাওয়াতে, তদবির করতে, ফাইল move করাতে, ঘুষ প্রদান এবং প্রভাব বিস্তারে বিদেশি কোম্পানিকে সাহায্য করে ।

নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে ক্রেতাদের নিকট সেবা ও পণ্যসম্ভার যত বিস্তৃত হচ্ছে এতে জোট গঠনের আবশ্যকতা ততোই বাড়ছে । কৌশলগত জোটের আবশ্যকীয়তা অনেক পুরনো প্রবাদ থেকে এসেছে, ” if you can’t beat ’em, join ’em” ।

প্রবাদটিকে ইদানীংকালে সামান্য পরিবর্তন করে বলা হয় “Join ’em and you can’t be beat.” (J C Mason,1993)। এর অর্থ হচ্ছে প্রতিপক্ষ যদি এতই শক্তিশালী হয় কোন ভাবেই তাকে পরাস্ত করা সম্ভব নয় তাহলে তাঁদের সাথে মিলে যাওয়াটাই ভালো । এতে মিলিতভাবে জয়ী হওয়া যাবে, না হলে অন্তত পরাজয়টা এড়ানো যাবে ।

১৯৩২ সালে “Atlantic Monthly” পত্রিকায় সিনেটর ওয়াটসনের উক্তি হিসেবে এটি বেশ সাড়া জায়গায় , যদিও এটি একটি প্রাচীন প্রবচন (“If you can’t lick ’em, jini ’em”) । বাস্তবতা হচ্ছে নতুন দিনের প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পগুলো জন্মের সময়ই বৈশ্বিক কোম্পানি হিসেবে জন্মগ্রহণ করে (‘born global’) ।

তাঁরা সবকিছুই বিভিন্ন দেশের কৌশলগত অংশীদারদের সহায়তা নিয়ে করে । বিভিন্ন কারণে জোট গঠনের ধারণা আরো জোরালো হচ্ছে- চলতি বাজারের ও প্রযুক্তির শূন্যতা পূরণ করা, অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করে লাভবান হওয়া, নতুন বাজারে প্রবেশের খরচ হ্রাস করা, নতুন পণ্য বাজারে ছাড়া ত্বরান্বিত করা, অর্থনৈতিক স্কেল অর্জন অর্থাৎ বেশি উৎপাদনের মাধ্যমে খরচ কমানো, ব্যবসায় এবং আইনি প্রতিবন্ধকতা উতরে যাওয়া, বর্তমান কার্যক্রমের আওতা সম্প্রসারণ, বাজার থেকে সরে আসার খরচ কমানো ।

এক দেশে যখন পণ্যের পতনকাল দেখা যায়, অন্য দেশে সেটা তখনও প্রবৃদ্ধি স্তরে রয়ে গেছে, তখন এক দেশ থেকে পন্য বা উৎপাদন ব্যবস্থা অন্য দেশের স্থানান্তর করা যায় (Stratford Sherman,1992 ) । মারকেটিং জগতে প্রচলিত জোটেগুলো হচ্ছে- পণ্য বা সেবা জোট, প্রমোশন জোট, লজিস্টিক জোট, এবং মূল্য জোট ।

রাজনৈতিক জোটে (বিশেষ করে বাম জোটে, কথিত আদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে) যেমন প্রায়ই ভাঙ্গন দেখা দেয় তেমনি ব্যবসায়িক জোটেও ভাঙ্গনের হার কম নয় । জোটের গঠনের পক্ষে অনেক যুক্তি থাকার পরও এক্ষেত্রে শতকরা হিসাবে ব্যর্থতার হার বেশ উঁচু । McKinsey and Company একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন ৪৯ টি ব্যবসায় জোটের এক তৃতীয়াংশ অংশীদারের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় ব্যর্থ হয়েছে বা ভেঙ্গে গেছে ।

এ ধরনের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা যেন না হয় সেজন্য বিশ্বখ্যাত পরামর্শক কোম্পানিটির তিনটি সুপারিশ হচ্ছে- ১) কৌশলগত মিল(strategic fit): কারো সাথে জোট গঠনের আগে কম্পানিকে তাঁর নিজের মৌলিক কর্মক্ষমতাগুলো মূল্যায়ন করতে হবে। এরপরেই তাঁদের অংশীদার হিসেবে ব্যবসায় একই ধারায়, ভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানে অথবা তাদের কর্মদক্ষতার(competencies) সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে এমন অংশীদারি নির্বাচন করতে হবে ।

bkash এবং visa card এর মধ্যে অংশীদারিত্ব কৌশলগত মিলের কারণে অনেকদিন টিকে থাকবে । তাছাড়া দুটি প্রতিষ্ঠান আলাদাভাবে এত লোকের কাছে পৌঁছাতে পারবে না । (২) দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি (long term focus): সাময়িক অসুবিধা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে তাৎক্ষণিক লাভের আশায় যেমন সমবায় সমিতি টিকে থাকে না, তেমনি ব্যবসায়ী জোট স্বল্প দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তৈরি হলে তাও টিকবে না ।

সাময়িকভাবে কিছু অর্থ সাশ্রয় অর্জনের বিষয়টি মাথায় না রেখে দীর্ঘমেয়াদী ফলাফলকে গুরুত্ব দিতে হবে । (৩) নমনীয়তা(flexibility): নমনীয় হতেই হয় ব্যবসায়ী জোটকে । নমনীয় জোটিই টিকে থাকে । বিশেষ করে বিদেশী অংশীদাররা পারিপার্শ্বিকতার কারণেই বিভিন্ন মোচড় দিতে পারে । মোচড়ের সুযোগ না রাখলে জোট ভেঙে যাবে ।

২০০৪ সালে অধ্যাপক ডব্লিউ. চ্যান কিম এবং রেনে মাবার্ণ (W Chan Kim and Renée Mauborgane) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সর্বোচ্চ সাফল্যের এক যুগান্তকারী কৌশলের বর্ণনা করেছেন । তাঁদের “Blue Ocean Strategy: How to Create Uncontested Market Space and Make Competition Irrelevant” বইয়ে প্রতিযোগীদের রক্তে রঞ্জিত মহাসাগরে (Red Ocean) না নেমে এমন সাগরে (বাজারে) নামতে হবে যেখানে প্রতিযোগী নেই, থাকলেও অতি নগন্য ( Blue Ocean ) ।

তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে মূল্য যুদ্ধ হয় ভয়ঙ্কর । যেহেতু অধিকাংশ ক্রেতা যে পণ্যের দাম কম সেটার প্রতি আগ্রহী হয় সেজন্য বেশিরভাগ প্রতিযোগী বাজার দখলের জন্য ধ্বংসাত্মক মূল্য প্রতিযোগিতায় নামে, এটাই বাস্তবতা । বাজার তাঁদের দখলেই যাবে যারা বেশি মূল্য সুবিধা দিতে পারবে ।

কিন্তু সকল প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ধ্বংসাত্মক মূল্য যুদ্ধে নেমে অনবরত মূল্য কমানো সম্ভব নয় । বাজার অংশ বৃদ্ধি পেলেও এতে মুনাফা কমে যায় । তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে বাজার অংশ বৃদ্ধি চলমান কালেই মুনাফা কমতে থাকে । কারণ শেষের দিকের ক্রেতারা ‘হার্ড কাস্টমার’ অথবা অন্য কোম্পানির কাস্টমার ।

অবিবাহিত কাউকে বিয়ে করার চেয়ে বন্ধুর বউ বা বান্ধবীর স্বামীকে বিয়ে করা বেশ কঠিন ; কষ্ট(cost) বেশি হবে । বাজারজাতকারীর সংখ্যা বেড়ে গেলে ভোক্তার অনুপাত কমে যায় । এভাবেই তৈরি হয় ‘রেড ওশান’ ।

বিদ্যমান বাজারের সম্ভাবনা কমে গেলে নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হয় যেখানে প্রতিযোগিতা নেই । ক্রেতা বিভাজিত হবেনা আর দামও কমাতে হবে না । এটাই হচ্ছে ‘ব্লু ওশান’ , যার অর্থ হচ্ছে নতুন চাহিদা সৃষ্টি করা । ক্রেতারা মনে মনে খুঁজছে (Latent demand) অথচ বাজারে নেই এমন জিনিস নিয়ে আসতে পারলেই প্রতিযোগিতা প্রাসঙ্গিকতা হারাবে ।

ক্রেতার মনে নতুন পণ্যটির ধারনা না থাকলেও ক্রেতা যদি অভিনব (innovative) পণ্যটি সম্পর্কে অবগত হওয়া মাত্রই পণ্যটির প্রয়োজন অনুভব করে তাহলেও সার্থকতা আসতে পারে । ব্লু ওসান কৌশলের অন্যতম মর্মার্থ হচ্ছে সাশ্রয়ী দামে পৃথকীকরণ (differentiation at low cost) ‌, অভিনব পণ্য বা সেবা সাশ্রয়ী দামে বাজারে নিয়ে আসা।

Dr. Mizanur Rahman

মাইকেল Porter কম খরচে ব্যবসায় এবং পৃথকীকরণকে আলাদা কৌশল হিসেবে দেখালেও ব্লু ওশান কৌশলে দুটির সম্মিলিত প্রয়োগ এর উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ‌‌ ।

Al Ries এবং Jack Trout কর্তৃক সুপারিশকৃত বাজারে অবস্থান গ্রহণের অন্যতম কৌশল,”খালি জায়গা দখল করার (‘to grab an unoccupied position’) সাথে এর মিল আছে । তবে ব্লু ওশান কৌশলের বাস্তব প্রয়োগের অনেক সফলতার কাহিনী আছে ।

এখানে প্রতিযোগিতা অপ্রাসঙ্গিক । প্রতিযোগীদের বাজার থেকে বের করার চেষ্টা না করে নিজেই এমন জায়গায় চলে যাওয়া যেখানে প্রতিযোগিতা নেই ।

‘ব্লু ওশান কৌশলে’ বলা হয় ক্রেতা যেটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে অর্থাৎ value এবং তাঁর সাথে সামর্থের মধ্যে যেকোন একটাকে বেছে নেয়ার করার সুযোগ নেই । ক্রেতা যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় সেটা কিভাবে তার সামর্থ্যের মধ্যে আনা যায় এই দুইটা বিষয়কে সমানভাবে গুরুত্ব দিলেই ‘পৃথকীকরণ এবং কম খরচ’ দুটিই অর্জন সম্ভব।…(চলবে)