লিউকেমিয়া থেকে ফিরে ক্যান্সার চিকিৎসক!

সালটা ছিল ২০০০। ক্লাস নাইনে উঠেছি,সবেমাত্র সায়েন্স নিয়ে পড়া শুরু করেছি।

কয়েক মাসের মধ্যেই হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে দুর্বল হয়ে গেলাম। সেটি আমার বাবা-মায়ের চোখ এড়ালো না।

বাবা-মা দু’জনেই ডাক্তার হওয়ায় খুব দ্রুত একটি সিবিসি টেস্ট করালেন যার রিপোর্ট আমার চারপাশের পৃথিবীটাকে মুহূর্তের মাঝেই পরিবর্তন করে দেয়।

আমার লিউকেমিয়া ধরা পড়ে। আর এরপরের যত দুশ্চিন্তা, কষ্ট আর লড়াইয়ের গল্প সেটি কেবল আমার আর আমার পরিবারের।

লিউকেমিয়া ধরা পড়বার পর আমার হাতে সময় ছিল খুব অল্প।

আমার রিপোর্ট এতটাই খারাপ ছিল যে,কয়েকজন ডাক্তার এমনও বলে দিয়েছিলেন,আমি হয়তো বাঁচবো সর্বোচ্চ আর মাত্র সাতদিন।

আমার রোগটা ছিল আমার পরিবারের জন্য দুঃস্বপ্নের মত আর এভাবে সময়সীমা বেঁধে দেওয়াটা সেই দুঃস্বপ্নেরও সীমা ছাড়িয়ে গেল।

বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের ভিড় বাড়তে লাগলো। কেউ কেউ তো আমাকে কেমোথেরাপি দেওয়াটাও অপ্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন।

তারা হয়তো চেয়েছিলেন,অন্তত আমার মৃত্যুটা যেন কষ্টের মধ্যে না হয়। সবার এই হতাশামূলক কথার বিরুদ্ধে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন আমার বাবা আর মা।

তারা আমাকে কোনভাবেই মৃত্যুর কাছে ছেড়ে দেবেন না। আমার জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমাকে বাঁচানোর আশা তারা ছাড়বেন না।

বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর এই দুই দেশ মিলিয়েই আমার চিকিৎসা চলে। কেমোথেরাপি অনেক কষ্টের-মানুষ কেবল একথা মুখেই বলতে পারে কিংবা শুনতে পারে।

কিন্তু কষ্টের মাত্রা কতটা তীব্র হতে পারে,সেকথা একজন পেশেন্ট ছাড়া আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। কেমোর কারণে যখন আমার চুল পড়া শুরু করে,আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি।

এক পর্যায়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখারও সাহস পেতাম না। মাঝেমাঝে এমনও মনে হত, এত যন্ত্রণা ভোগ করে বেঁচে থাকার কোন মানে নেই,এর থেকে মরে যাওয়াটাই সহজ।

কিন্তু ঠিক এর পরেই আমি যখন আমার বাবার কিংবা মায়ের মুখ দেখতাম,আমার মনে হত আমাকে বাঁচতে হবে; যত কষ্টই হোক না কেন।

আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠি। আর দশজন সাধারণ মানুষের মতই আমি এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করি,তাদের সাথে আমার কোন পার্থক্য নেই।

অনেকেই হয়তো মনে করবে,লিউকেমিয়া হওয়াটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।

কিন্তু আমি সবাইকে বলি এবং বিশ্বাস করি,আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিয়েছে এই বিপর্যয়।

মৃত্যুর খুব কাছাকাছি গিয়েছিলাম বলেই জানি,জীবনের মূল্য কতটুকু। তাই সুস্থ হবার পর থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আমার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়।

লিউকেমিয়ার ধকল কাটিয়ে আবার পড়ালেখা শুরু করি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পাওয়া নিঃসন্দেহে আমার আত্নবিশ্বাস কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।

চিকিৎসা সেবার জন্যে নিজেকে যোগ্য করে তবেই আমি মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করতে চাই।

তাই এমঅারসিপি পাশ করে ইংল্যান্ডে গেলেও আবার আমি দেশেই ফিরে আসবো। ভবিষ্যতে ক্যান্সার রোগীদের নিয়ে কাজ করতে চাই।

নিজে যেহেতু একজন ক্যান্সার সারভাইভার তাই জানি,দেহ থেকে ক্যান্সার দূর করতে পারলেও সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে মন থেকে ক্যান্সার দূর করাটা অত সহজ নয়।

সমাজ তোমাকে বারেবারে মনে করিয়ে দিবে,তোমার ক্যান্সার ছিল এবং তুমি অভিশপ্ত।

ক্যান্সার যে কোন ছোঁয়াচে রোগ নয় কিংবা এটি সন্তান-সন্ততিতে স্থানান্তরিত হয় না-এ নিয়ে আজও মানুষের মনে ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে।

তাই ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে চাই,ক্যান্সার রোগীদের পাশে দাঁড়াতে চাই।

তাদেরকে আমার নিজের গল্প শোনাতে চাই,অন্য কারো ধার করা গল্প নয়। আর বলতে চাই,আমি যদি পারি, তোমরা কেন নয়?

Dr. Behnaz Mobashwera
DMC K-63
Member of the Royal College of Physicians, UK
Senior QEH fellow, The Queen Elizabeth Hospital, Norfolk, UK

You cannot copy content of this page