কখনো কি এমন হয়েছিল যে আপনার মনে হচ্ছে আপনার প্রাণ আপনার হাতের মধ্যে আছে। এখন আপনি যদি খুব শক্ত করে না ধরে রাখেন, তবে আপনার প্রাণ আপনার হাত থেকে হারিয়ে যাবে।
আমার সাথে হয়েছিল, আজকে ১৩ জন তরুণ-যুবকের সাথে এমনটিই হয়েছিল। এমন ১৩ জন যাদের জীবন কেবল শুরু। পাহাড়ি উপজাতি সন্ত্রাসীদের হাতে ঝড়ে যেতে পারতো অথবা অপহৃত হতে পারতো আজ ১৩ টি তাজা প্রাণ।
আজ (২৫-০৮-২০২৪), রাঙামাটি সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মাঝে কিছু ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা ১২ জন শিক্ষার্থী, সাথে ছিলেন আমাদের ট্রাক চালক। আমাদের গন্তব্য ছিল খাগড়াছড়ি জেলার সদর উপজেলার কিছু এলাকা যেখানে কোন ত্রাণ পৌঁছেনি, এবং দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নে।
আমরা বেলা ১২:৩০ এর দিকে রওনা দিয়ে বেলা ২:৩০ এর দিকে নানিয়ারচর উপজেলার বগাছড়ি এলাকা পার হয়ে ১৯ মাইল এলাকায় একটি দোকান থেকে গাড়ি থামানোর ইশারা পাই। আমাদের চালক সাথে সাথেই গাড়ি থামান এবং তারপর লোকটি এসে আমাদের চালকের কাছে চাঁদার টোকেন দাবি করে। আমাদের গাড়িটি এই রুটের না হবার কারণে চালকের কাছে কোন টোকেন ছিল না। টোকেন না থাকার কারণে তখনই লোকটি বলে দেয় এ গাড়ি নিয়ে আর সামনে যাওয়া যাবে না। আমরা লোকটিকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে এটি ত্রাণের গাড়ি এবং আমরা বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা কিছু ছাত্র কেবল। তাছাড়া এ ত্রাণের অধিকাংশ আপনাদের পাহাড়িদের কাছেই যাবে। কিন্তু লোকটি কোন ভ্রুক্ষেপ না করে একনাগাড়ে বলতে থাকে টোকেন অথবা ৩০০০/- টাকা না দিলে যেতে দিবে না। পরে আমরা বললাম যেহেতু আমাদের কাছে টোকেন নেই এবং আমাদের কাছে তেমন টাকাও নেই, কেননা আমরা নূন্যতম কিছু টাকা নিজেদের দুপুরের খাবারের জন্য রেখেছিলাম। অবশেষে মহোদয়ের হৃদয় নরম হলে উনি বলেন অর্ধেক টাকা অর্থাৎ ১৫০০/- টাকা দিতে হবে কিন্তু শর্ত হলো এ ট্রাক টোকেন ছাড়া আর কখনও এ রাস্তায় প্রবেশ করতে পারবে না। তখন আমরা নিজেদের কাছে যা ছিল তাই দিয়ে কোনরকমে ১১০০/- টাকা জোগাড় করে তার হাতে দেই। তখন সে বললো যে কাজ হবে না এ টাকায়। আমরা অনেক অনুনয় বিনয় করে বলছিলাম তাকে যে এ ত্রাণ আমরা আপনাদের মানুষের কাছেই পৌঁছাবো, তার পরেও তার মন গলছিল না। যাই হোক এক পর্যায়ে তাকে মানানো গেল। আমরা সবাই আবার ট্রাকে উঠে যাচ্ছিলাম। ইতমধ্যে আমাদের একজন সাথী তার স্মার্টফোনে গোপনে ফুটেজ ধারণ করছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের একজনের সাথীটিকে দেখে সন্দেহ হলে লোকটিকে জানায়। জানানোর পর সে দাঁড়াতে বলে। এবং বলে যে আমরা ভিডিও কেন করেছি। সে আমাদের কাছ থেকে ফোন কেড়ে নেয় এবং বলে ভিডিওটি বের করে দিতে। তারপর ভিডিওটি দেখে সে ডিলেট করে দেয়। তারপরও সে ফোনে আরেকজনের সাথে কথা বলতে থাকে। কথা বলতে বলতে সে বলে রিসাইকেল বিন ওপেন করতে। তারপর সে রিসাইকেল বিন থেকে ভিডিওটি ডিলেট করে দিতে বলে। এর মধ্যে পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়। লোকটি আমাদেরকে একনাগাড়ে হুমকি দিতে থাকে। সে একটি ছেলেকে পাঠায় তাদের সশস্ত্র লোক ডেকে আনতে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব লোকটিকে বোঝানোর চেষ্টা করে পালানোর চেষ্টা করি। এরপর আমরা কোনভাবে বুঝিয়ে চলে আসি খাগড়াছড়ি।
যারা উৎফুল্ল হয়ে ত্রাণ দিতে যাচ্ছিলাম, তাদের মুখের ভাষা হারিয়ে গিয়েছিল। প্রাণচঞ্চল সব চেহারা গুলি মূহুর্তেই নিষ্প্রাণ হয়ে পড়লো। ১২ জন ছাত্র, মৃত্যুর মুখ থেকে অথবা বড় কোনো বিপদের হাত থেকে ফিরে এলো।
কিছুদিন আগে একটি ছবি বেশ ভাইরাল হয়, নিরাপত্তার স্বার্থে ২৫০ গ্রাম শুটকি নিতে সেনাবাহিনীর অনুমতির প্রয়োজন হয় বলে কিছু মানুষের খুব কষ্ট। কিন্তু, যখন ত্রাণ দিয়ে মানুষের জীবন বাচাতে গেলে প্রাণনাশের হুমকি নিয়ে চাঁদা দিয়ে তারপর যেতে হয় তখন?
আপনারা যারা এরপর থেকে পার্বত্য অঞ্চলে ত্রাণ দিতে আসবেন অবশ্যই সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করে তাদের প্রহরায় যাবেন। নয়তো আমাদের মতো সিচুয়েশনে আপনাদেরও পড়তে হতে পারে।
– আসিফ ইকবাল


