একটি পাথর ও একটি বিশেষ আর্কিটেকচার

টেম্পল মাউন্ট অথবা হারাম শরিফ

আল – আকসা মসজিদ লিখে গুগলে সার্চ দিলে যে সোনালী গম্বুজ ওয়ালা দালানের ছবি আসে, আমরা ছোটবেলা থেকে প্যালেস্টাইনদের মুক্তি আন্দোলনের পোস্টারে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা যে ঘরটার ছবি দেখেছি ওটা কিন্তু মোটেও আল-আকসা মসজিদ না। এমনকি ওটা কোন মসজিদ-ই না।

ওটার নাম টেম্পল মাউন্ট অথবা হারাম শরিফ। প্রকৃত আল আকসা মসজিদ এর থেকে খানিকটা দুরে।

তাহলে এটা কিসের দালান?  কী আছে এর ভেতরে? কেন পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এই দালানকে এত আপন মনে করে ? কেন এই একটা পাথরকে ঘিরে মানব জাতির ইতিহাস যতদিন ধরে লেখা হয়েছে, তারও আগে থেকে যুদ্ধ চলছে? কেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সহ আধুনিক প্রায় সব যুদ্ধের সাথে এই ভবনটা নানভাবে জড়িত?

কি আছে ঐ ভবনের ভেতরে?

আসলে আছে বড় সড় সাইজের একটা পাথর, আর কিছুই না। এবার আসি কেন ওই পাথরের এত গুরুত্ব? কেন মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি সহ আরও অনেক ধর্মের কাছে একটা পাথরের দখল নিয়ে এত লড়াই?

উত্তরটা বেশ জটিল। ইহুদিদের ধর্মমতে সৃষ্টিকর্তা এই পাথর দিয়েই বিশ্ব সৃষ্টি শুরু করেন। আদম আঃ ও পৃথিবীতে নেমে এই পাথরেই পা রেখেছিলিনে। ইব্রাহিম আঃ এই পাথরেই তার সন্তানকে কুরবানি করতে নিয়েছিলেন।

দাউদ আঃ এর পুত্র সোলাইমান আঃ এই পাথরের উপরেই প্রথম উপাসনার ঘর বানিয়েছিলেন, যেটা ইহুদিদের কাছে ফার্স্ট টেম্পল নামে পরিচিত ও সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় ভবন।

এটুকু ব্যাপারে ইহুদি, খ্রিষ্টান বা মুসলিমদের মধ্যে তেমন কোন মতবি্রোধ নাই, কারণ উল্লেখিত সবাই তিনটা ধর্মেরই নবী এবং অত্র অঞ্চলের অন্যান্য ধর্মালম্বীদের কাছেও সম্মানিত।

মুসলমানগনের কাছে এই যায়গাটা বিশেষ সম্মানের, কারণ এখানে কোন মসজিদ তৈরি হবার আগেই ( যদি সোলায়মান আঃ এর বানানো ফার্স্ট টেম্পল কে মসজিদ বলা যায় তাইলে আলাদা কথা ) মহানবী সঃ সাহাবী্দেরকে নিয়ে কাবাকে কিবলা ঘোষণা আসার আগে পর্যন্ত তার জীবনের শুরু থেকে জীবনের বেশির ভাগ সময় এদিকে তাকিয়েই নামাজ আদায় করেছেন।

মেরাজের রাতেও তিনি বেহেস্তে যাবার জন্য মক্কা থেকে এই পাথর পর্যন্ত ট্রাভেল করে এই পাথরের উপর থেকে উর্ধাকাশে রওনা হয়েছেন এবং এখানেই আসমান থেকে মাটিতে নেমে এসেছেন।

এই ভবন ও অত্র অঞ্চলের দখল নিয়ে যুদ্ধ চলছে প্রায় চার হাজার বছর ধরে। অতি জটিল এই যুদ্ধে ফারাও সম্রাট, আলেকজান্ডার, রোমানগন, বাইজান্টাইনগন, মেসোপটেমিয়ান বিশেষ করে নেবুচাদনেজারনেজার, খোলাফায়ে রাশেদিন, সালাহউদ্দিন, অটোম্যান সাম্রাজ্য, আরবগণ, ইত্যাদি কেউ বাদ যাননি।

তবে আধুনিক কালের সবচেয়ে বড় প্যাচটা লাগিয়েছে বৃটিশরা। তারা তাদের শাসন আমলে ভারতকে তিন টুকরা করে যেভাবে প্যাচ লাগিয়ে গেছে একই ভাবে ফিলিস্তিন কে তিন টুকরা করে এক টুকরা ইসরায়েল নামে ইহুদিদের জন্য, এক টুকরা আরবদের জন্য আর তৃতীয় ছোট এবং সবচেয়ে আকর্ষনীয় শেষ টুকরা অর্থাত এই পাথরের আশে- পাশের অঞ্চল যেটাকে জেরুজালেম নামে আমরা চিনি সেটাকে জাতিসংঘের হাঁতে তুলে দিয়ে গেছে।

ম্যাপে ইসরায়েল, পশ্চিম তীর এবং গাজার অবস্থান
ম্যাপে ইসরায়েল, পশ্চিম তীর এবং গাজার অবস্থান

তখন থেকে আজ প্রায় পঁচাত্তর বছর এটা এক ধরনের বিনা মালিকানায় রয়েছে। পৃথিবীর একেক দেশ এবং একেক জাতি এটার মালিকানা কার হবে তাই নিয়ে আজ বিভক্ত। অবশ্যই ইহুদিরা এবং আমেরিকান সরকার মনে করে এটার অধিকার ইস্রায়েলীদের, মুসলিম দেশ গুলো মনে করে এটার অধিকার ফিলস্তিনিদের আর বাকি দেশ গুলো এটাকে এখনো জাতি সংঘের তত্ত্বাবধানে থাকা এবং ইসরায়েলি -প্যালেস্টাইন শান্তি চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত কোন দিকে মত দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

মাসজিদ আল আকসার পুরো এলাকা

বর্তমানে এই ভবন ও পাশের আল আকসা মসজিদ নিয়ে যে কম্পাউন্ড তা ইসরায়েলের জবরদখলে আছে এবং ইসরায়েলি মুসলিম পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান ‘জেরুজালে ইসলামিক ওয়াকফ’ কে দিয়ে তত্বাবধান করা হয়। এই কম্পাউন্ডে ইসরায়েলি মুসলিমদের নামাজ পড়া কিছুটা বাধামুক্ত তবে ফিলিস্তিন বা বিশেষ করে গাজা অঞ্চলের ফিলিস্তিনদের কে এখানে ঢুকতে অধিকাংশ সময়ে নানা বাধায় পড়তে হয়।

জেরুজালেম

বিশেষ করে জুম্মার সময় এখানে খুবই কড়াকড়ি আরোপ করা হয় এবং ইসরায়েলি বর্বর পুলিশ বাহিনীর হাঁতে বহু ধর্মপ্রাণ মুসলিম নির্যাতিত হয়। একই সাথে উল্লেখ্য যে এই কম্পাউন্ডের মধ্যে ইহুদীদের তাদের ধর্মীয় পোশাক পড়ে ঢোকা বা তাদের উপাসনা করাও নিষিদ্ধ এবং প্রার্থনারত দেখা মাত্র গ্রেফতার করা হয়।

তাদেরকে এই কম্পাউন্ডের ওয়ালের বাইরে দাঁড়িয়ে উপাসনা করতে হয়। ট্যুরিস্টদের জন্য টিকেট কেটে কম্পাউন্ডে যাওয়ার অনুমতি আছে।

এই পাথর ধারণ কারী ভবনটা তাই অসংখ্য ধর্ম গ্রন্থের পাতায় পাতায় স্বাক্ষর রেখেছে। অসংখ্য জাতি ও কোটি কোটি মানুষ তাদের নিজেদের অধিকারে রাখতে চেয়েছে।

অসংখ্য যুদ্ধ, সন্ধি চুক্তি, চুক্তি ভঙ্গ, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে এই এক ভবনকে ঘিরে। মানব জাতির কাছে দ্বিতীয় আরেকটা আর্কিটেকচার নাই নাই যেটা এত হাজার বছর ধরে এত মানুষদের সংঘাতের কেন্দ্র হয়ে রয়েছে।

( প্রথম ছবিটা ভবেনের বাইরের আর দ্বিতীয় তৈলচিত্রটা ভবনের ভেতরের সেই পাথরের।)

ডোম ওব দ্য রক এর ভবনের ভেতরের সেই পাথর

লেখকঃ আমিনুল ইসলাম ইমন,

স্থপতি

You cannot copy content of this page