রাজধানীর কলাবাগানের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল মাস্টারমাইন্ডের ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার একমাত্র আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
আদালত ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দিহান স্বীকার করেন – আনুশকা নূর আমিনের মৃত্যু ধর্ষণের কারণেই হয়েছে।
ধর্ষণের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে মামলার একমাত্র আসামি ইফতেখার ফারদিন দিহান বন্ধুদের ডেকে তাদের সহযোগিতায় আনুশকাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এরপর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শুক্রবার (০৮ জানুয়ারি) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
বিকেল সোয়া ৪টার দিকে জবানবন্দি রেকর্ডের পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
জবানবন্দিতে দিহান জানান, আনুশকার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্র ধরেই আনুশকা তার বাসায় যায় এবং তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত আসামির জবানবন্দির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। ঘটনা সংশ্লিষ্ট আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে।
এখন চিকিৎসকের ফরেনসিক রিপোর্ট পেলে পারিপার্শ্বিক বিষয় ও জবানবন্দির বর্ণনা পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে সিএমএম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরন বলেন, এই আসামি নিজেকে সম্পৃক্ত করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
এর মাধ্যমে মামলার তদন্তে বড় অগ্রগতি হলো। আশা করছি দ্রুতই তদন্ত শেষ করে পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করবে এবং বিচারে আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।
এর আগে শুক্রবার দুপুর ১টায় তাকে আদালতে হাজির করা হয়। এসময় আসামি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা কলাবাগান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আ ফ ম আসাদুজ্জামান তার জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদন করেন।
সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুপুর সোয়া ২টার দিকে তাকে একই বিচারকের আদালতে নেওয়া হয়। বিকেল সোয়া ৪টার দিকে জবানবন্দি রেকর্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
বৃহস্পতিবার (৭ জানুয়ারি) দিনগত রাতে নিহত আনুশকার বাবা মো. আল-আমিন বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেন। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয়েছে আনুশকার প্রেমিক ইফতেখার ফারদিন দিহানকে।
মামলায় তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ এর ২ ধারায় ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
আজ শুক্রবার দুপুরে ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশিদের আদালতে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির অর্থ হলো তার উপর আনীত অভিযোগ স্বীকার।
তার উপর ধর্ষণ এবং হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিলো।
ময়নাতদন্ত সম্পন্ন
এ ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীর (১৭) ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদের নেতৃত্বে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।
ময়নাতদন্ত শেষে ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘বিকৃত যৌনাচারে মৃত্যু হয়েছে মাস্টারমাইন্ড শিক্ষার্থীর। ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। ধর্ষণের ফলে যৌন ও পায়ু পথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তার মৃত্যু হয়েছে।’
এসময় তিনি জানান, তার শরীরের অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি মর্মে ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘জোর জবরদস্তির কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
চেতনানাশক কোনো কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কিনা তা জানতে নমুনা সংগ্রহ এবং ঘটনাস্থলে একাধিক ব্যক্তি ছিল কিনা তা জানতে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তার ভিসেরা সংগ্রহ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘থানা পুলিশ সুরতহাল রিপোর্টে বয়স জানতে চেয়েছে। তাই মরদেহ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক্সরে বিভাগে পাঠানো হয়েছিল।
সেখানে এক্সরে করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। এক্সরে ছাড়াই মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ‘
বয়স নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ায়, তার শারীরিক গঠন, দাঁতের সংখ্যা ও ডিএনএ টেস্টের পরেই বয়স নির্ধারণ হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘ মৃত্যুর পূর্বে চেতনানাশক কিছু খাওয়ানো হয়েছে কিনা, তার জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করে কেমিক্যাল পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে। এসব রিপোর্ট পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা যাবে।’
এর আগে বয়স নির্ধারনের জন্য ওই ছাত্রীর মরদেহের এক্স-রে সহ প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করা হয়। পরে স্বজনরা তার মরদেহ নিয়ে যান।
ওই স্কুলছাত্রীকে (১৭) ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় তার ‘বন্ধু’ তানভীর ইফতেফার দিহানকে (১৮) একমাত্র আসামি করে কলাবাগান থানায় মামলা করেন নিহতের বাবা আলামিন।
কলাবাগান থানার পুলিশ পরিদর্শক আ ফ ম আসাদুজ্জামান বলেন, গত রাতে তানভীর ইফতেফার দিহানকে (১৮) আসামি করে ছাত্রীর বাবা ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে মামলা করেছেন।
মামলাটির তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় আরও কেউ জড়িত আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গতকাল রাতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর বাবা বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, গতকাল সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা মা কর্মস্থলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যান।
এর এক ঘণ্টা পরে তার বাবাও ব্যবসায়িক কাজে বাসা থেকে বের হয়ে যান। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ওই শিক্ষার্থী মাকে ফোন করে কোচিং থেকে পড়ালেখার পেপার্স আনার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন।
এই মামলার একমাত্র আসামি ‘ও’ লেভেল পড়ুয়া শিক্ষার্থী দুপুর আনুমানিক ১টা ১৮ মিনিটে ফোন করে ওই শিক্ষার্থীর মাকে জানান, মেয়েটি তার বাসায় গিয়েছিলেন। হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ায় তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়েছে।
অফিস থেকে বের হয়ে আনুমানিক দুপুর ১টা ৫২ মিনিটে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মা হাসপাতালে পৌঁছেন। হাসপাতালের কর্মচারীদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, গতকাল আসামি তার কলাবাগান ডলফিন গলির বাসায় ডেকে নিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন।
প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে অচেতন হয়ে পড়লে বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আসামি নিজেই তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে যান।
খবর পেয়ে কলাবাগান থানা পুলিশের একটি দল হাসপাতালে গিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায় বলে উল্লেখ করা হয় এজাহারে।
এর আগে দীহান পুলিশকে বলেছিলো,
তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্মতির ভিত্তিতে শারীরিক মেলামেশা হয়। এরপর ওভার ব্লিডিং হয়, এ কারণে আনুশকা সেন্সলেস হয়ে যায়। তখন তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে তার মৃত্যু হয়।
এছাড়া, মেয়ের বয়স যদি ১৮ এর কম হয় তাহলে সম্মতিতে মিলন ঘটলেও তা ধর্ষণ বলে স্বীকৃত হয়।
জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হোক বা স্বেচ্ছায় মিলিত হোক না কেন, দুটোই এখন ধর্ষণ হিসেবে স্বীকৃত হবে।
বয়স নির্ধারণের পর চূড়ান্ত ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর প্রকৃত ঘটনা ও কারণ জানা যাবে।
এই কনফিউশন দূর করার জন্য দীহানের পুর্ণাঙ্গ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।